somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চর্যাপদের কবিদের খোঁজে

০৮ ই মে, ২০১৩ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলা সাহিত্যের গর্বের ঝুলি চর্যাপদ । চর্যাপদের মোট কবি ২৩ জন।হাজার বছর আগে এই সাহিত্য যাদের হাত ধরে লিখা হয়েছে তাদের সম্বন্ধে জানার ইচ্ছা ছিল। দেখলাম এখানে সন্যাসীদের অনেকেই রাজ বংশধর ছিলেন । কেউ কেউ রাজা আবার কেউবা ছিলেন রাজপুত্র । কারও তান্ত্রিক ক্ষমতা ছিল, ছিল নানা কারিশমা। এখানে যেমন আছেন আমাদের দেশে জন্ম নেয়া কবি তেমনি আবার আছেন সুদুর সিংহল এ জন্ম নেয়া কবি। কারও কারও জন্ম মহাভারতে। চলুন দেখি তাদের পরিচয়, জন্ম আর জীবন বৃত্তান্ত ---

১.লুইপা

চর্যাপদঃ
“কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল ।।”

আধুনিক বাংলায়ঃ
“দেহ গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল/
চঞ্চল মনে কাল প্রবেশ করে।

লুইপা বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদের প্রবীণ কবি, কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতে, লুইপা ছিলেন শবরপার শিষ্য। তাঁর মতে লুইপা ৭৩০ থেকে ৮১০ খ্রীঃ মধ্যে জীবিত ছিলেন। লুইপা বাংলাদেশের লোক ছিলেন।‘ব্‌স্তন্‌-গু্যরে শ্রীভগবদভিসময়’ নামক একটি তিব্বতী পুস্তকে তাকে বাংলাদেশের লোক বলা হয়েছে। আবার, তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের লোক।


২.কুক্কুরীপা
চর্যাপদঃ“দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই ।।”

বাংলাঃ “দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় /
রাত হলে কামরূপ না গেলে নয়

এটি চর্যাপদের দ্বিতীয় পদ,কুক্কুরীপা রচিত। ধারনা করা হয় তিনি ছিলেন তিব্বতের কাছাকাছি কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা (কপিলসক্র) ডঃ শহীদুল্লাহ্‌ মনে করেন, কুক্কুরীপা আমাদের বাংলাদেশেরই লোক। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে তার জন্ম। ড. সুকুমার সেন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, কুক্কুরীপা নারীও হতে পারেন। চর্যাপদে কুক্কুরীপার তিনটি বৌদ্ধগান ছিল।একটি পাওয়া যায়নি। কুক্কুরীপার পদযুগল ছিল তুলনামূলক গ্রাম্য ।

৩.বিরুপা

চর্যাপদঃ“এক সে সুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই
চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই ।।”

বাংলায়ঃ “এক সে শুঁড়িনী দুই ঘরে সান্ধায়
/ চিকন বাকলেতে মদ বাঁধে।”

বিরুপা রচনা করেছিলেন চর্যাপদের তৃতীয় পদটি। তিনি জন্মেছিলেন রাজা দেবপালের রাজ্য ত্রিপুরায় । অষ্টম শতকে তার জন্ম বলে ধারনা করা হয়। কিন্তু মুহঃ শহীদুল্লাহ্‌র মতে বিরুপা ছিলেন জালন্ধরীপার শিষ্য, বাংলার লোক। বিরুপা অন্যান্য কবিগণের তুলনায় সামান্য পৃথক ছিলেন। তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলন । তিনি মদ্যমাংসভোজনের অপরাধে বিহার থেকে বিতাড়িত হন।পরে আশ্চর্য ক্ষমতা বলে গঙ্গা পার হয়ে উড়িষ্যার কনসতি নগরে যান।সেখানেও নানা বুজরুকি বিদ্যা দেখান।

৪.গুণ্ডরীপা

চর্যাপদঃ “জোইনি তইঁ বিনু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমল রস পিব্‌মি ।।”

বাংলাঃ “রে যোগিনী, তুই বিনা ক্ষণকাল বাঁচি না /
তোর মুখ চুমিয়া কমল রস পান করি।”

গুণ্ডরীপা চর্যাপদের চতুর্থ পদটি রচনা করেন। কার্দিয়ার ক্যাটালগে তার এই নাম পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন গুণ্ডরীপা জাতিবাচক নাম। তিনি বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের কবি ধরে নিলেও, ভিন্নমত তিনি বিহারের লোক। রাজা দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৯-৮৪১) সময়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ।

৫. চাটিল্লপা:

চাটিল্লপা সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, পাঁচ নং পদটি তার শিষ্যের রচিত। তিনি ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছে দক্ষিণবঙ্গে জীবিত ছিলেন বলে মনে হয়। তার পদে সহজ সাধনভজন তত্ত্বকথা ও নদীমাতৃক অঞ্চলের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।যেমনঃ নদী, কাদা, জলের বেগ, খনন,সাঁকো,করা ইত্যাদি।

৬.ভুসুকুপা

চর্যাপদঃ“বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।

বাংলায়ঃ “ বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। / চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল”।

ভুসুকুপা বাঙালি ছিলেন। অনুমান করা হয় তিনি পূর্ব বাংলা কবি।। তার আসল নাম শান্তিদেব। “ভুসুকু অষ্টম থেকে এগার শতকের সৌরাষ্ট্রের রাজা কল্যাণবর্মার পুত্র ছিলেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম শান্তিবর্মা ছিল।” তাকে শান্তিদেব নামেও ডাকা হয়। বৌদ্ধাচার্য জয়দেব ভুসুকুকে শিক্ষাসমুচ্চয়, সূত্রসমুচ্চয় ও বোধিচর্যাবতার নামক তিনটি বই দিয়েছিলেন। ভুসুকু একমনে লেখাপড়া করতেন বলে ভিক্ষুরা তাকে অলস মনে করত। এজন্য তারা তাকে উপহাস কোরে ভুসুকু নামে ডাকত।

৭.কাহ্নপা

চর্যাপদঃ“ভন কইসেঁ সহজ বোলবা জাই
কাআবাক্‌চিঅ জসু ন সমাই ।।
আলেঁ গুরু উএসই সীস ।।
জেতই বোলী তেতবি টাল ।
গুরু বোব সে সীসা কাল ।।”

বাংলায়ঃ বল কেমনে সহজ বলা যায়, যাহাতে কায়বাক্‌চিত প্রবেশ করিতে পারে না ? গুরু শিষ্যকে বৃথা উপদেশ দেন। বাক্‌পথাতীতকে কেমনে বলিবে ? যতই তিনি বলেন সে সবই টালবাহানা। গুরু বোবা, সে শিষ্য কালা।

চর্যাপদের সমস্ত কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। কাহ্নপা তার সমকালে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন।কাহ্ণপা খ্রীঃ অষ্টম শতকে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কাহ্ণপা উড়িষ্যার কবি। তিনি থাকতেন সোমপুরী বিহারে। বর্তমানে পাহাড়পুরে যে বিহারটি আবিষ্কার করা হয়েছে, সেটিই কাহ্ণপার বসতভিটা বলে ধারণা করেন অনেকে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে- কাহ্ণপা, দেব পালের রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন। সুতরাং তিনি ৮৪০ এর দিকে বর্তমান ছিলেন।
এ বিষয়য়ে সন্দেহ ওঠে যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাহ্ণপা রচিত একটি বই ‘শ্রীহেবজ্রপঞ্জিকাযোগ-রত্নমালা’ পাওয়া যায়।কাহ্ণপার গুরু ছিলেন জালন্ধরী; যার অন্যনাম হাড়িপা। জালন্ধরীর গুরু ছিলেন ইন্দ্রভূতি। ইন্দ্রভূতির সময়কাল আনুমানিক ৭০০ খ্রীঃ। যেহেতু সোমপুরে কাহ্ণপার একটি লিপি পাওয়া যায়, তাই বলা যায়- গোপীঁচাদের যুগের লেখক। যিনি ৭ম শতকের শেষভাগে ধর্মপাল দেবের রাজত্বকালে সোমপুর বিহারে অবস্থান করেছেন। তাই মোটামুটি সন্দেহাতীতভাবে ৭৬০-৭৭৫ এর মধ্যকার সময়কালে কাহ্ণপা চর্যার পদ রচনা করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।


৮.কম্বলারম্বপা

চর্যাপদঃ“সোনে ভরিতী করুণা নাবী ।
রূপা থোই নাহিক ঠাবী ।।
বাহতু কাম্লি গঅন উবেসেঁ।
গেলী জাম বাহুড়ই কইসেঁ ।।

আধুনিক বাংলায়ঃ “আমার করুণা-নৌকা সোনায় ভর্তি রয়েছে; তাতে রূপা রাখার ঠাঁই নেই। অরে কম্বলি পা, গগনের (নির্বাণের) উদ্দেশ্যে তুমি বেয়ে চলো; যে জন্ম গেছে সে ফিরবে কি কোরে ?

চর্যার আট নং বৌদ্ধগানটি কম্বলারম্বপার রচিত। তিনি ইন্দ্রভূতি ও জালন্ধরীপার গুরু ছিলেন।এ ক্ষেত্রে তার সময়কাল আনুমানিক ৭৫০-৮৪০ শতকে দেবপালের রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি কানুপার পূর্ববর্তী এবং কুক্কুরীপা ও লুইপার সমকালীন কবি (কারণ তিনি লুইপার একটি গ্রন্থের টীকা লিখে দিয়েছিলেন)কম্বলারম্বপা কঙ্কারামের বা কঙ্করের রাজপুত্র ছিলেন। অনেকে মনে করেন- তিনি উড়িষ্যা কিংবা পূর্ব-ভারতবাসী ছিলেন।

৯.ডোম্বীপা

চর্যাপদঃ“গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ
তহিঁ চড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই ।।
বাহ তু তোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা
সদ্গুরু পাও-পসাএঁ জাইব পুণু জিণউরা ।।

আধুনিক বাংলায়ঃ গঙ্গা যমুনা মাঝে রে বয় নৌকা,
তাউ চড়িয়া চণ্ডালী ডোবা লোককে অনায়াসে পার করে ।।
বা তুই ডুমনি ! বা লো ডুমনি ! পথে হইল সাঁঝ,
সদ্‌গুণ পায়ের প্রসাদে যাইব পুনরায় জিনপুর ।।

ডোম্বীপা চর্যার অষ্টম পদটি রচনা করেছেন। ডোম্বীপা ছিলেন হেরুক পূর্ব দিকের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা। ডোম্বী রাজার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, ডোম্বীপা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষালাভ করায় তার প্রজারা তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। এতে দেশে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী শুরু হয়। যখন তিনি দেশে ফিরে আসেন তখন তা দূর হয়। এতে তান্ত্রিকরা রাজাকে ধর্মবান মনে করেন এবং দেশের প্রজারাও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভে অনুপ্রাণিত হয়।

এছাড়া রাঢ়দেশের হিন্দু রাজা বৌদ্ধধর্মের ক্ষতি সাধন করায় ডোম্বী সেখানে উপস্থিত হন এবং অলৌকিক বলে রাজা-প্রজা সকলকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি কর্ণাটকের সমুচ্চয় নামক রাজার তৈরি লিঙ্গাইত মথে ৮০০ টি স্তূপ আধ্যত্মিক শক্তি বলে মাটিতে মিশিয়ে দেন।সেখানে উল্লেখ হয়েছে, ডোম্বী মগধের রাজা।

বিরূপা তার গুরু। একটি অলৌকিক ঘটনা হল- প্রজাদের অনুরোধে যখন রাজা বন হতে দেশে ফিরে আসেন ও সঙ্গিনী ডুমনিসহ নিজেকে সাত দিন অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে রেখে নতুন দেহ নিয়ে বের হয়ে আসেন। তখন তার নাম হয় আচার্য ডোম্বী। তার সময়কাল মোটামুটি ৭৯০ থেকে ৮৯০ খ্রীষ্ঠব্দের মধ্যে, দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৬-৪৯ খ্রীঃ)।

১০.শান্তিপা

চর্যাপদঃসঅসম্বেঅণসরুঅবিআরেঁ অলক্‌খ লক্‌খণ ন জাই।
জে জে উজূবাটে গেলা অনাবাটা ভইলা সোই॥ ধ্রু॥
কুলেঁ কুল মা হোই রে মূঢ়া উজূবাট সংসারা।
বাল ভিণ একু বাকু ণ্ ভূলহ রাজ পথ কন্ধারা॥ ধ্রু॥

আধুনিক বাঙলায়ঃ
স্বয়ং-সংবেদন-স্বরূপ বিচারে
অলখ হয় না লক্ষণ;
সোজা পথে, আর হয় না রে
তাদের প্রত্যাবর্তন!

শান্তিপা চর্যার পনের এবং ছাব্বিশ নং পদ রচনা করেন।দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশের গুরু ছিলেন তিনি তার প্রকৃত নাম ছিল রত্নাকর শান্তি। খ্রিষ্টীয় এগার শতকের প্রথম দিকে জীবিত ছিলেন। বিহারের বিক্রমশীলায় বাস করতেন তিনি। বিক্রমশীল বিহারের দ্বার পণ্ডিত চিলেন। ।
একাদশ শতকে সজহযান বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সিংহল যাত্রা করেন। প্রাচীন মৈথিলী ভাষা ব্যবহার কোরে তিনি রচনা করেছেন ।

১১.মহীধরপা

মহীধরপা চর্যার ষোল নং পদ রচনা করেন। তার অন্য নাম মহিল।বিগ্রহ পাল-নারায়ন পালের রাজত্বকালে খ্রিষ্টীয় নবম শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন বলেন ধরা হয়। এবং তার জীবৎকালের নিম্নসীমা ৮৭৫ সাল। তিনি ত্রিপুরাতে ছিলেন সে সময়ে ত্রিপুরা মগধ অন্ধলের মধ্যে ছিল। তাই বলা যায় মগধ অঞ্চলে বাস করতেন। । চর্যার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কবি কাহ্ণপার শিষ্য ছিলেন তিনি। কারও মতে তিনি দারিক পার শিষ্য। কাহ্ণপার সাথে তিনি চটিগায়েঁ ভ্রমণে করেন। প্রাচীন মৈথিলী ভাষা ব্যবহার করেছেন তার পদে।


১২.বীণাপা
বীণাপা চর্যার সতের তম পদটি রচনা করেন। তিনি গহুর (গৌড়) অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি দোম্বীপাদের সমকালীন. মনে করা হয়, বীণা তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র হওয়ার কারণে তার নাম বীণা ছিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতকের সময়ে তিনি বর্তমান ছিলেন বলে সর্বজন গৃহীত। তার গুরু ভাদ্রপা। অন্য ভাষাবিদের মতে, তিনি বুদ্ধপার শিষ্য ছিলেন। তার শিষ্য ছিলেন বিলস্যবজ্র এবং । প্রাচীন বাংলা ভাষা ব্যবহার করে চর্যার পাশাপাশি তিনি একটি গ্রন্থ ‘ব্র্তডাকিনীনিষ্পন্নক্রম’ রচনা করেন।


১৩.সরহপা

চর্যাপদঃ
হিঅ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই।
সূণ নৈরামণি কণ্ঠে লইআ মহাসুহে রাতি পোহাই ।।”

আধুনিক বাংলাঃ ,
হৃদয়-তাম্বুলে মহাসুখে কর্পূর খায়,
শূন্য-নৈরাত্মাকে কণ্ঠে লইয়া মহাসুখে রাত্রি পোহায় ।।

চর্যায় আরেকজন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হলেন সরহপা। তখন কামরূপের রাজা ছিলেন রত্নপাল। তার সময়কাল ১০০০ থেকে ১৩০০ খ্রীঃ অঃ। সরহের শিষ্য ছিলেন এই রাজা। সরহ তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে রাজাকে দীক্ষা দেন। সরহের নিজ জাতি ছিল বাহ্মণ। যেমন, অনেকে মনে করেন, নাগার্জুনের গুরু হলেন সরহপা।পূর্ববঙ্গের রাজ্ঞীদেশের উত্তরবঙ্গ-কামরূপে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি ভিক্ষু ও সিদ্ধা হন। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়।চর্যায় রচিত তার চারটি পদাবলির ভাষা ছিল বঙ্গকামরূপী।


১৪.তন্ত্রীপা(পাওয়া যায় নি)

চর্যাপদ গীতিকায় একমাত্র তন্ত্রীপার পদটিই খুঁজে পাওয়া যায় নি। এজন্য তার সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না।

১৫. শান্তিপা

দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশকে তিনি বৌদ্ধে দীক্ষা দেন।রত্নাকর শান্তি, সংক্ষেপে শান্তিপা। তিনি একাদশ শতকের প্রথমদিকের কবি। বিক্রমশীলা বিহারের দ্বারপণ্ডিত হিসেবে খ্যাত ছিলেন। এছাড়া একজন বোউদ্ধপ্রচারক হিসেবে তার পরিচয় পাওয়া যায়। এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারের লক্ষে সিংহল যাত্রা করেন। চর্যায় তার রচিত পদের ভাষা প্রাচীন মৈথিলী।

১৬.আর্যদেবপা

আর্যদেবপা চর্যার একত্রিশ নং পদটি রচনা করেন।সিংহল দ্বীপে তার জন্ম হয়। আর্যদেব মূলত মেবারের রাজা রাজা ছিলেন। তার আসল নাম হল আজদেব। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের প্রথমার্ধের কবি ছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি কম্বলারপার সমকালীন ছিলেন। পরে গোরক্ষনাথের কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করেন এবং তার শিষ্য হিসেবে পদলাভ করেন। তার ভাষা বাংলা ও উড়িয়া মিশ্রিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “তাঁহার ভাষা অনেকটা বাঙ্গালা বটে, কিন্তু উড়িয়া ভাষা বলাই সঙ্গত।”

১৭.ঢেণ্ডণপা

চর্যাপদঃ
“টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী
হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী”

আধুনিক বাংলায়ঃ

লোক শূণ্য স্থানে প্রতিবেশীহীন আমার বাড়ি
হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রেমিক এসে ভিড় করে।

ঢেণ্ডণপা চর্যার (তেত্রিশ নং) রচনা করেন। তার জন্মস্থান অবন্তিনগরত-উজ্জয়িনী। তার জীবৎকাল ৮৪৫ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তার আসল নাম হল ঢেণ্‌ঢস। খ্রিষ্ট্রীয় নবম শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি দেবপাল-বিগ্রহপালের সমকালে ছিলেন। ঢেণ্ডণপা মূলত তাঁতি এবং সিদ্ধা ছিলেন। তার পদে বাঙালি জীবনের চিরায়ত দারিদ্রের চিত্র পাওয়া যায় ,

১৮.দারিকপা

দারিকপা চৌত্রিশ নং বৌদ্ধগানটি রচনা করেন।সালিপুত্র নামক স্থানের রাজা ছিলেন।যার জন্মস্থান উড়িষ্যার শালীপুত্রে। তার আসল নাম ইন্দ্রপাল। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষভাগে ও নবম শতকের শুরুতে তার সময়কাল ছিল বলে ধারণা করা যায়। । সিদ্ধা পদলাভের পরে তিনি দারিক নাম ধারণ করেন। লুইপার কাছ থেকে তিনি সিদ্ধ লাভ করেন এবং তার শিষ্য হিসেবে মর্যাদা পান।

19.ভাদেপার

চর্যাপদঃ
এতকাল হঁউ আচ্ছিলোঁ স্বমোহেঁ
এবেঁ মই বুঝিল সদ্‌ গুরু বোহেঁ ।।

আধুনিক বাংলায়ঃ

এতকাল আমি স্বমোহে ছিলাম
এখন সদগুরু বুঝলাম।

ভাদেপার চর্যায় ভদ্রপাদ নামে পরিচিত। পঁয়ত্রিশ নং বৌদ্ধগানটি তিনি রচনা করেছেন। তার জন্ম হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে। ভাদেপা বিগ্রহ ও নারায়ন পালের রাজত্বকালের সময়ে বর্তমান ছিলেন।ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র মতে তার জন্ম মণিভদ্র। কিন্তু অন্য অনেকে মনে করেন শ্রাবন্তী এলাকায়। তিনি কাহ্নপা, মতান্তরে জালন্ধরীপার শিষ্য ছিলেন। তিনি পেশায় চিত্রকর চিলেন।

২0.তাড়কপা

Albert Gruenwedel যে ৮৪ জন মহাসিদ্ধের নাম প্রকাশ করেন, তার মধ্যে তাড়কপা উল্লেখ নেই। ফলে তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

২১.কঙ্কণপা

কঙ্কণপা চর্যার চুয়াল্লিশ নং বৌদ্ধগানটি রচনা করেন।তিনি বিষ্ণুনগরের রাজা ছিলেন।তার ভাষা ছিল বাঙলা এবং অপভ্রংশ মিশ্রিত। তিনি খ্রিষ্টীয় নবম শতকের শেষভাগের কবি ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে অনেক গবেষক এ মত প্রকাশ করেন- কঙ্কণপা ৯৮০ থেকে ১১২০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন। প্রথম জীবনে পরবর্তিতে তার গুরু কম্বলাম্বরের কাছ থেকে বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষা লাভ করে সিদ্ধ হন। তবে অনেক ভাষাবিদ এ মত-ও প্রকাশ করেন যে- তিনি কম্বলাম্বরের বংশধর ছিলেন এবং দারিকপাদের শিষ্য ছিলেন।

২২.জয়নন্দীপা

জয়নন্দীপা-এর আসল নাম জয়ানন্দ।জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। কোনো এক রাজার মন্ত্রী ছিলেন বলেও জানা যায়। চর্যার ছেচল্লিশ নং পদটি তিনি রচনা করেন। তার জন্ম বাংলাদেশে। তার ভাষা ছিল গৌড় অপভ্রংশের পরবর্তী আধুনিক আর্যভাষার প্রাচীন রূপ। যা মিথিলা প্রদেশের মৈথীলা, উড়িষ্যার ওড়িয়া, বাংলা ও আসামের ভাষার সংমিশ্রণ .

২৩. ধর্মপা

চর্যার সর্বশেষ কবি হলেন ধর্মপা। তিনি চর্যার সাতচল্লিশ নং পদটি রচনা করেন। ধর্মপা বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিষ্টীয় নবম শতকের শুরুর দিকে তার জন্ম হয় এবং প্রায় ৮৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। গোত্র ছিল ব্রাহ্মণ। এ থেকে বোঝা যায় বিগ্রহ নারায়ণ পালের রাজত্বকালে তিনি জীবিত ছিলেন এব এবং ঢেণ্ডণপার সমকালীন ছিলেন। ধর্মপা কাহ্নপার শিষ্য। বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষালাভের পর তিনি ভিক্ষু ও সিদ্ধা হন। চর্যায় তার রচিত পদটির ভাষা বাংলা।

চর্যাপদ মূলত গানের বই, এতে অনেকগুলো পদ বা গান বা চর্যা আছে। পণ্ডিতরা বলেন, এই গানগুলো হলো বৌদ্ধ সহজিয়া বা সহজযানী বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকদের সাধন সঙ্গীত। মানে গানগুলোতে সাধকরা তাদের মন্ত্র গোপনে লুকিয়ে রেখেছেন। যে সহজযানী বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা করে, কেবল সে-ই ওই গোপন অর্থ বুঝতে পারবে.


তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলা সাহিত্যের কথা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌
২ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মাহবুবুল আলম
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৬
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×