সরকারি চাকরিতে পার্শ্বীয় প্রবেশ
মোঃ আবদুস সালাম
বিএসএস (অনার্স, ঢাবি) এমএসএস (সমাজ কল্যাণ, ঢাবি)
বিএড (প্রথম শ্রেণি) এমএড (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম)
সহকারী শিক্ষক, নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা
সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি।
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষকের বিষয় পরিবর্তন। সংশোধনের জন্য মাউশির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত জ্যেষ্ঠতার তালিকায় দেখা যায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষক তাদের নিয়োগের বিষয় পরিবর্তন করে অন্য বিষয়ের শিক্ষক হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেইসবুকের পাতা গরম করছেন অন্য কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষক। এখন বিষয় হলো এক বিষয়ে নিয়োগ পেয়ে বিষয় পরিবর্তন করে অন্য বিষয়ের শিক্ষক হওয়া কতটা আইন সম্মত।
এক পদে নিয়োগ পেয়ে অন্য আরেকটি সম পদে যাওয়ার নাম হল পার্শ্ব প্রবেশ। এর ইংরেজি হল Lateral entry । পৃথিবীর সব দেশে সব চাকরিতে এই পার্শ্বীয় প্রবেশ বা Lateral entry এর বিধান রয়েছে। নিয়োগযোগ্যতা থাকলে একই নিয়োগ পরীক্ষায় নিয়োগ হয় এমন পদগুলোতে পার্শ্বীয় প্রবেশ বা Lateral entry এর সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানের সবচেয়ে বড় চাকরি বিসিএস ক্যাডার পদেও এই বিধান আছে। বিসিএস কম্পোজিশন এন্ড ক্যাডার রুল ১৯৮০ এর ধারা ৬ এর উপধারা (২) এ বলা হয়েছে, “Lateral entry up to 20% of the duty posts in exceptional cases,” বর্তমানে ১০% কোটায় প্রতি বিসিএস থেকেই শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারে প্রবেশ করে।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ কল্যাণ (সম্মান) এর ছাত্র ছিলাম। সেই সময় আমাদের ফারজানা মেডাম ছিলেন সমাজ কল্যাণের প্রভাষক। আমরা ২য় বর্ষে উঠার পর মেডাম অর্থনীতি বিভাগে চলে যান। কারণ তিনি অর্থনীতিতেও ডিগ্রি নিয়েছিলেন। সম্প্রতি আমি Public Procurement নামে একটি প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করেছি। সেখানে ১ম দিন একজন রিসোর্স পার্সন ছিলেন নাম জনাব অজিত কুমার চক্রবর্তী। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে গণপূর্তের ইঞ্জিনিয়ার হন তিনি। পরে MBA করেন। বর্তমানে তিনি ক্যাডার পরিবর্তন করে বিসিএস প্রশাসনে আছেন। দেখেন Public Procurement। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের খ্যাতনামা প্রফেসর জিল্লুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। চাকরিতে প্রবেশের পর ইংরেজিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগদান করেন। এই রকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যাবে, যা বইয়ের পাতায় কুলাবে না।
Lateral entry বা পার্শ প্রবেশের বিধান মতে নিয়োগবিধিতে উল্লেখিত প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকলে এক বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়ে পরবর্তীতে বিষয় পরিবর্তন করতে পারেন। কলেজে নিয়োগ হয় বিষয় ভিত্তিক, পদোন্নতি হয় বিষয় ভিত্তিক। কখনই এক বিষয়ের শিক্ষক ছুটিতে থাকলে অন্য বিষয়ের শিক্ষককে ক্লাশে যেতে হয় না। আর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পত্রে স্পষ্ট করে লেখা থাকে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ইচ্ছানুযায়ী যে কোন বিষয় পড়াতে বাধ্য থাকবে।
চাকরি ক্ষেত্রে দুটো জিনিস গুরুত্বপূর্ণ যথাঃ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা। অনভিজ্ঞদের চেয়ে অভিজ্ঞদের গুরুত্ব ও চাহিদা অনেক বেশি। এইরূপ ধারণা থেকেই বড় বড় চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা প্রদানের পর বাই নেমে গেজেট করার জন্য চাকরি স্থায়িকরণ করা জরুরী হয়। স্থায়ীকরণ করার জন্য আবার বিষয় দরকার। কিন্তু দেখা যায় ছয় হাজার শিক্ষকের মধ্যে প্রায় দুই হাজারের নামের পাশে বিষয় নাই। তখন মাউশি কর্তৃপক্ষ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, এইসব শিক্ষকদের ডিগ্রি পর্যায়ে পঠিত বিষয় ও বিদ্যালয়ে পাঠদানের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ তাদের বিষয় নির্ধারণ করে দিবেন। সেই সময় অনেক সম্মানিত শিক্ষক তাদের ডিগ্রি পর্যায়ে পঠিত বিষয়, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও বিদ্যালয়ে পাঠদানের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট উপস্থাপন করে বিষয় নির্ধারণ করেন। মাউশি প্রতিষ্ঠান প্রধানগণের সুপারিশ ছাড়া একজন শিক্ষকেরও বিষয় পরিবর্তন গ্রহণ করেন নাই। সেই অনুযায়ী শিক্ষকগণের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়েছে এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ক্রমে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশ করা হয়েছে।
চাকরি স্থায়ীকরণ হয়েছে ২০১৩ সালে। গেজেট প্রকাশ পেয়েছে ২০১৪ সালে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৬/৫ বছর। অফিস ব্যবস্থাপনার নিয়ম অনুযায়ী একটি অফিসকে সর্বোচ্ছ ৫ (পাঁচ) বছর পর্যন্ত কাগজ-পত্র প্রমাণস্বরুপ সংরক্ষণ করতে হয়। সেই নিয়ম অনুযায়ী মাউশি প্রতিষ্ঠান প্রধানগণের পাঠানো সুপারিশ ৫ (পাঁচ) বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করেছে। এতদিন পরে যারা অভিযোগ তুলেছেন বিধি অনুযায়ী তাদের অভিযোগ টাইম বারের কারণে বাতিল। আদালতও এত দীর্ঘদিন পরের কোন আভিযোগ আমলে নেয় না। আবার অভিযোগ তারাই করতে পারে যারা সংক্ষুদ্ধ। সংক্ষুদ্ধ না হলে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যায় না। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পদোন্নতি কলেজের মত বিষয়ভিত্তিক নয়। এই জন্য একজনের বিষয় পরিবর্তনে অন্য জন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। তাই এখানে কেউ সংক্ষুদ্ধ না। আমার জানা মতে এখনো ইংরেজি ও গণিতের প্রায় পাঁচ শতাধিক পদ শুণ্য রয়েছে। সে কারণে বিষয় পরিবর্তনে এই দুটি বিষয়ের শিক্ষকগণও সংক্ষুদ্ধ নয়। ট্রেড বা অন্য বিষয়ের শিক্ষকগণ তো কোন ভাবেই সংক্ষুদ্ধ নয়।
ফাইল ওয়ার্কের কর্মী হিসাবে এখানে আমার কৈফিয়ত আছে। আমাদের জানা মতে স্থায়ীকরণ ও গেজেটে যার যে বিষয় আছে প্রকাশিত জ্যেষ্ঠতার তালকায় তার ব্যতিক্রম নাই। এই দুইটির সাথে কোন গড় মিল থাকলে তা অবশ্যই কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কল্যাণে ডিগ্রিধারী। সরকারি মাধমিকে নিয়োগ পেয়েছি সামাজিক বিজ্ঞানে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তাই আছি। আমার পিডিএস আইডি ২০১৬৭০০০২৩।
সর্বশেষ কথা হলো কর্মকর্তা-কর্মচারি (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা) নিয়োগবিধিমালা ১৯৯১ এর সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদদুটি। যথাঃ- (১) সিনিয়র শিক্ষক ও (২) সহকারী শিক্ষক। সহকারী শিক্ষক (বাংলা), সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি), সহকারী শিক্ষক (আরবী-ইসলামিয়াত), সহকারী শিক্ষক (সামাজিক বিজ্ঞান) এই রুপ ব্রাকেট বন্দী কোন পদের অস্তিত্বই এখন নাই। তবে সহকারী শিক্ষকের ক্ষেত্রে আলাদা কলামে বিষয় লেখতে হবে। শুনতে পাচ্ছি মাধ্যমিক স্তরে ভবিষ্যতে বিজঙান, ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক – এইসব বিভাগই আর থাকছে না। সুতরাং কোন ধরণের অভিযোগ তুলে বা মামলা দায়ের করে আমরা যেন আমাদের বহু কাঙ্খিত পদোন্নতি কার্যক্রমকে নিজেরাই বাধাগ্রস্থ না করি। আর যারা বাধার সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:৫৭