২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানায় সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর নিখোঁজ সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন প্রিয় স্বজনরা। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানেই একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি পাওয়া গেল কর্নেল জাহিদের রক্তাক্ত লাশ। প্রাণপ্রিয় স্বামীর নিথর শরীর জড়িয়ে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন অকাল বৈধব্যের শিকার স্ত্রী ছন্দা। এই কান্না, এই শোক বর্ণনার মতো ভাষা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব । মাহবুব হোসেন নবীননারকীয় হত্যাযজ্ঞ
সকাল ৯টায় বসেছিল দরবার। মঞ্চে
বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল
শাকিল আহমদ। বিপুলসংখ্যক বিডিআর সদস্যে পরিপূর্ণ দরবার হল। কিন্তু সে আনন্দমুখর পরিবেশ ঘণ্টাখানেকও স্থায়ী হয়নি। বিপথগামী একদল বিডিআর জওয়ান বিদ্রোহ ঘোষণা করে
মেতে ওঠে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে।
হ পিনাকি দাসগুপ্ত/মাহবুব আলম লাবলু
২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, বাংলাদেশের ইতিহাসের দুটি কলঙ্কিত দিন। গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় বিদীর্ণ শোকাবহ দুটি দিন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত মাত্র দেড় মাস বয়সী মহাজোট সরকারের জন্য যেমন ছিল এক চরম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দিন, তেমনি গোটা জাতির জন্যও ওই দুটি দিন বয়ে এনেছিল অনিশ্চয়তা আর ভয়াল আতঙ্ক। পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত বিডিআর বিদ্রোহের উৎকণ্ঠার প্রথম দিন আর অন্ধকার রাত শেষে ২৬ তারিখ যে করুণ ট্র্যাজেডির চিত্র উৎকীর্ণ হতে শুরু করে, তা স্তম্ভিত করে দেয় পুরো দেশবাসীকে। বিডিআর বিদ্রোহে রক্তাক্ত পিলখানার সেই ভয়াল স্মৃতির একটি বছর পূর্ণ হতে চলেছে আজ। কিন্তু এক বছর পরও দেশবাসী মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেননি সে দুঃসহ স্মৃতি।
অন্যান্য দিনের মতো ২৫ ফেব্রুয়ারিও ফাল্গুনের বাসন্তী হাওয়ায় মৃদুমন্দ গুঞ্জরণ ছিল পিলখানার সবুজশোভিত বিশাল চত্বরে। সূর্য উঠেছিল যথারীতি আলোর ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে। কিন্তু সে দিনের সকালটি ঘড়ির কাঁটা ১০টা না পেরুতেই ভয়ের অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল সর্বত্র। সেদিন সকাল যেন ছিল রাতের চেয়েও অন্ধকার। প্রথমে পিলখানায়, কিছুক্ষণের মধ্যে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আর এফএম রেডিওর সুবাদে রাজধানী এবং দুপুরের আগেই দেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে দিয়েছিল এক ভয়াবহ আতঙ্কের খবর। কারণ সেদিন হঠাৎ গোলাবারুদের গর্জন ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল বিডিআর দরবার হলসহ গোটা পিলখানা এবং সংলগ্ন পুরো এলাকা। হতচকিত হয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র সাধারণ মানুষও। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী হচ্ছে বিডিআর সদর দফতরের অভ্যন্তরে! বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সুবাদে কেবল বারবার দেখা যাচ্ছিল পিলখানার বিভিন্ন গেটের রেলিংয়ের কাছাকাছি হলুদ-লাল নানারঙের কাপড়ে মুখবাঁধা বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানদের ছোটাছুটি আর গোলাগুলির গা ছমছমে দৃশ্য। তখনও কেউ কল্পনা করেননি যে কী ভয়াবহ নৃশংসতার দৃশ্যপট সৃষ্টি হচ্ছে এই গোলাগুলির অন্তরালে। পরদিন পিলেচমকানো সব খবর প্রচার হতে শুরু করে।
বিদ্রোহের সূত্রপাত ও পূর্বাপর : ঠিক একদিন আগেই পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে তিনদিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বর্ণাঢ্য ওই আয়োজনের দ্বিতীয় দিন। শেষ হওয়ার কথা ছিল ডিনার আর সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তার আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘটে যায় এ করুণ মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ। সকাল ৯টায় যথারীতি দরবার হলে বসেছিল বার্ষিক দরবার। সারাদেশ থেকে আসা বিডিআরের জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ বিপুলসংখ্যক সদস্যে তখন পরিপূর্ণ দরবার হল। মঞ্চে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদসহ বিডিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সে এক আনন্দমুখর পরিবেশ। কিন্তু সে আনন্দ ঘণ্টাখানেকও স্থায়ী হয়নি। এরই মধ্যে বিপথগামী একদল বিডিআর জওয়ান বিদ্রোহ ঘোষণা করে মেতে ওঠে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে। মুহূর্তেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের অন্যান্য বিডিআর ব্যাটালিয়নেও। বিদ্রোহীরা পাখির মতো গুলি করে সামরিক, বেসামরিক ও সাধারণ মানুষকে হত্যা শুরু করে। ধর্ষণ, লুটপাটের মতো ঘৃণ্য ঘটনাও ঘটেছিল সেদিন। এখানেই শেষ নয়, ঘাতকরা নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ গুম করতে গণকবরও দিয়েছিল, ফেলেছিল ম্যানহোলে। সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্বরিত সিদ্ধান্ত এবং গৃহীত পদক্ষেপের ফলে দুপুরের পর থেকে জওয়ানদের আত্মসমর্পণ শুরুর মধ্য দিয়ে অবসান হয়েছিল রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের। বিদ্রোহ দমনে সেনা অভিযানের যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত সব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে সরকারের উদ্যোগে এর শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সবার অজান্তে চলে হত্যা আর লুণ্ঠন।
যেভাবে বিদ্রোহের সূত্রপাত : প্রথম দিকে শোনা গিয়েছিল বিডিআর জওয়ানদের নানা অসন্তোষ আর ক্ষোভের কথা। শোনা গিয়েছিল ২৪ তারিখ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিডিআর সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল
দীর্ঘদিনের দাবি-দাওয়া জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু বিডিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের দেখা করতে না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় জওয়ানরা। তাছাড়া এমনও শোনা গিয়েছিল যে, বিডিআরের 'ডাল-ভাত' কর্মসূচিতে পরিচালিত ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলোতেও যে সৈনিকরা দায়িত্ব পালন করত, তারা লভ্যাংশ না পেয়ে, বাড়তি শ্রমের মূল্য না পেয়ে ক্ষুব্ধ ছিল ডিজির ওপর। আরও বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কারণেই নাকি এ ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে পরদিন দরবার হলে। বার্ষিক বৈঠক চলাকালে এক দল বিডিআর জওয়ান দরবার হলে ঢুকে মহাপরিচালকের সামনে তাদের দাবি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলে কর্মকর্তারা ধমক দিয়ে তাদের শান্ত করতে চাইলে হঠাৎ ক্ষুব্ধ বিডিআর জওয়ানরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে ব্যারাক থেকে শত শত বিডিআর সদস্য বেরিয়ে দরবার হল ঘিরে ফেলে। এরপরই বিদ্রোহ ঘোষণা করে পুরো পিলখানা এবং অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিডিআর সদস্যরা। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায় এ ঘটনাটি নিছক দাবি-দাওয়ার কারণে নয়। এর পেছনে ছিল অজ্ঞাত ষড়যন্ত্রও।
নারকীয় হত্যাযজ্ঞ : বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদকে দরবার হল থেকে টেনেহিঁচড়ে সামনের রাস্তায় নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রায় একই সময় ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় ছয় কর্মকর্তাকে। রক্তের বন্যায় ভেসে যায় দরবার হল। বিদ্রোহীদের একটি গ্রুপ একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে সদর দফতরের ভেতরে কর্মকর্তাদের বাসায় বাসায় ঢুকে হামলা চালায়। ঘাতকরা মহাপরিচালকের বাসায় ঢুকে তার স্ত্রী ও গৃহপরিচারিকাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তার বাসায় বেড়াতে আসা স্বজনদেরও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দরবার হলে যখন বিদ্রোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালাতে যায়, তখন দেহরক্ষীরা বাধা দিতে গেলে তাদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়। এখানে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন সাত বিডিআর সদস্য। বিডিআর ৩ নম্বর গেট দিয়ে বিদ্রোহীরা মর্টার শেল ছুড়তে থাকে। সদর দফতরের প্রবেশপথগুলোতে বিডিআরের আরমার্ড কারসহ গোলাবারুদের গাড়ি ও এসএমজি বসিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়া হয়।
সেনাবাহিনীর অবস্থান : বিদ্রোহ দমনে সকাল ১০টার দিকে সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে সাঁজোয়া যান এবং ভারি অস্ত্র নিয়ে পিলখানার দিকে রওনা হন সেনাসদস্যরা। সাড়ে ১০টার দিকে তারা ধানমণ্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের গুলি ও মর্টার শেলের মুখে সেনাসদস্যরা জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে অবস্থান নেন। বিডিআরের ১ নম্বর ও ৫ নম্বর গেটের আশপাশসহ বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়, যা গোটা রাজধানীতে ছড়িয়ে দেয় চরম আতঙ্ক। কারণ যদি সশস্ত্র বাহিনী আর বিডিআর বিদ্রোহীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হতো তা হলে শুধু রক্তগঙ্গাই বয়ে যেত না, বহু অসামরিক সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারত। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও নস্যাৎ হয়ে যেতে পারত। শেষ পর্যন্ত তা আর ঘটেনি প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপে।
লাশ গুম করতে গণকবর : ২৫ ফেব্রুয়ারি সারাদিন এবং রাতভর পিলখানায় যে হত্যাযজ্ঞ আর লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। নির্বিচারে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পর এক পর্যায়ে লাশের মিছিল দেখে দিশেহারা হয়ে যায় ঘাতক বিডিআর সদস্যরা। তাই লাশ গুম করতে একের পর এক গণকবর দেওয়া হয়। পিলখানা পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। একদিনে গণকবর খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় ৪২টি লাশ। এর মধ্যে দুটি গণকবর থেকেই ৩৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়। কিছু লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্যুয়ারেজ লাইনের স্রোতেও; যা উদ্ধার করা হয় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে।
বিদ্রোহ সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা : বিদ্রোহ সামাল দিতে শুরু থেকেই অত্যন্ত তৎপর ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার বাসভবনে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ও বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। মাঠপর্যায়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার জন্য কয়েকদফা বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মির্জা আযম, সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি, মেহের আফরোজ চুমকী এমপিসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা গেছেন পিলখানায় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে রেখেছেন উজ্জ্বল ভূমিকা। যে কারণে বিদ্রোহী বিডিআররা আত্মসমর্পণে সম্মত হয় প্রধানমন্ত্রীর কৌশলী পদক্ষেপে। প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও সামরিক হস্তক্ষেপে সমস্যার সমাধান না করে প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শী ভূমিকা পালন করেন। বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ শুরুর পরও রাতের অন্ধকারে চালায় বর্বর হত্যাকাণ্ড, যা ছিল অকল্পনীয়। ফলে দেশ হারায় অর্ধশতাধিক উজ্জ্বল সেনা কর্মকর্তাকে_ যারা এ জাতিকে এগিয়ে নিতে রাখতে পারতেন অনেক উজ্জ্বল ভূমিকা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




