ইডেনের ঘটনায় সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন, বদরুন্নেসা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের বিবেকবান মানুষ স্তম্ভিত, হতবাক, হতাশ। ঘটনাটি ছিল শনিবারের ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনে রীতিমত আড্ডার প্রধান খোরাক ছিল ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের একে অপরকে দেহব্যবসায় জড়িত করার অভিযোগটি। এ ব্যাপারে আরও খোঁজ নিতে গিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপের সন্ধান’ মিলেছে। নাম প্রকাশ না করে একাধিক ছাত্রী ও ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মী অভিযোগ করেছেন, শুধুনেতাদের বাসায় নয়, বিভিন্ন শিল্পপতি এবং আজিমপুর, হাজারিবাগ, নিউমার্কেট ও ধানমন্ডি এলাকার ব্যবসায়ীদের বাসায়ও পাঠানো হয় ছাত্রলীগের ওই জুনিয়র কর্মীদের। এতে রাজি না হলেই ছাত্রীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন।
এদিকে ছাত্রলীগের খোদ সভাপতির বিরুদ্ধেই ইডেনে নেত্রীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় ছাড়াও তার বাসায় নেত্রীদের যাতায়াতের অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ‘ম’ আদ্যাক্ষরের জনৈক সাবেক হল সভাপতির সঙ্গে তার (সভাপতি) দীর্ঘদিনের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘদিন ওই নেত্রীর সঙ্গে তিনি ধানমন্ডির শঙ্কর এলাকার বাসায় স্বামী-স্ত্রীর মতো কাটিয়েছেন। বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতাকর্মীদের মুখে মুখে ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে সম্প্রতি ওই নেত্রীকে বাদ দিয়ে দেশের একজন প্রথম শ্রেণীর শিল্পপতির অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে। জানা গেছে, শামসুন্নাহার হলের ওই নেত্রী এখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে ধরনা দিচ্ছেন অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বিপরীত দিকে বিষয়টি ‘সুরাহা’র জন্য সভাপতির পক্ষ থেকেও ছাত্রলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে নিয়োগ করা হয় ওই নেত্রীর পেছনে। এভাবে বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে দর-কষাকষি চলছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সংযোগ কেটে দেন।
নারী কেলেঙ্কারি, অভিযোগের পাহাড় : ছাত্রলীগ নেত্রীদের পাশাপাশি নেতাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। ‘র’ ও ‘ল’ আদ্যাক্ষরের দুই সহ-সভাপতি এবং ‘র’ ও ‘ব’ আদ্যাক্ষরের দুই যুগ্ম সম্পাদকের বিরুদ্ধে ইডেন ও বদরুন্নেসায় নবাগত নেত্রীদের বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব লুটে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এদেরই মধ্যে একজন গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে মাইক্রোবাস নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মিছিল-সমাবেশ শেষে তারা বদরুন্নেসা থেকে আসা কয়েকজন ছাত্রীকে জোর করে ধরে অজানা স্থানে নিয়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই মাইক্রোবাসে দুই যুগ্ম সম্পাদক আগে থেকেই বসা ছিলেন। মাইক্রোবাসে ছাত্রীরা ঢুকেই তাদের দেখতে পেয়ে কয়েকজন লাফিয়ে নেমে পড়ে। যারা নামতে পারেনি, তাদের নিয়ে যাওয়া হয় অজানা স্থানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেও একইভাবে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ এখন ক্যাম্পাসে ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। রোকেয়া হলের ‘ম’ আদ্যাক্ষরের জনৈক ছাত্রীকে গত ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে মাইক্রোবাসে করে এনে হলের পশ্চিমের গেটে নামিয়ে দেন ওই নেতা। অভিযোগ রয়েছে, তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ার একটি বাসায় ওই নেতা কেবল রোকেয়া হলের ওই ছাত্রীকে নিয়েই নয় আরও বেশকিছু নেত্রীকে নিয়ে অভিসারে যান। সর্বশেষ কয়েকদিন আগে ঘোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রোকেয়া হলের ওই নেত্রীকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকের পদ দিয়ে ‘দায়-পরিশোধ’ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় একজন সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে ‘মক্ষিরানী’ বনে যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ওই নেত্রী বিভিন্ন তদবির নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে থাকেন। তার মহড়ায় ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই নেত্রী ছাত্রত্ব না থাকা সত্ত্বেও কুয়েত-মৈত্রী হলে থাকেন। ওই সহ-সভাপতির দৌরাত্ম্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ছাত্রী হলেই আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মিছিলে ধরে আনা নিত্যনতুন ছাত্রীদের টার্গেট করে বিভিন্ন নেতার বাসায় পাঠানোর পাশাপাশি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে আসীন ব্যক্তিদের বাসায়ও পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবসা করে থাকেন ওই নেত্রী। ওই নেত্রীকে মগবাজার এলাকার বিভিন্ন হোটেলে গমন করতে দেখেছেন পরিচিত অনেকেই। কিছুদিন আগে শামসুন্নাহার হলের আরেক নেত্রীকে মধ্যরাতে জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ির একটি কক্ষ থেকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন কর্মচারীরা। পরে ঘটনা বেশি ছড়ানোর আগে দ্রুত ওই নেত্রীকে হল থেকে সরিয়ে দেয়া হয় বলে ছাত্ররা জানায়।
আতঙ্ক যখন বৃহস্পতিবার : ইডেনের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ এবং জুনিয়র কর্মীদের কাছে বৃহস্পতিবারটি আতঙ্কের দিন। ওইদিন বিকাল হলেই তাদের কদর আর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। নেত্রীরা খোঁজাখুঁজি করে তাদের আদর-যত্ন করে ঠিকানা ধরিয়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রে কলেজের সামনে আবার পলাশী, নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত মোড়ে মাইক্রোবাস এবং প্রাইভেটকার অপেক্ষা করে। ইডেন কলেজের ছাত্রীদের বিশেষ করে গ্রাম থেকে আসা অসহায় ছাত্রী এবং সংগঠনের জুনিয়র কর্মীদের নেতাদের বাসায় পাঠানোর অভিযোগের ব্যাপারে জানা যায়, মূলত বিভিন্ন নেতার বাসায় পাঠানো হয় তদবির সফল হওয়ার জন্য। এসব নেত্রী দীর্ঘদিন ধরে নেতাদের বাসায় নিজেরা যাতায়াতের পর এখন অন্যদের পাঠান। বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের তদবির বাগিয়ে নেন। এই একই অভিযোগ বদরুন্নেসার নেত্রীদের ব্যাপারেও।
বদরুন্নেসারও একই চিত্র : কয়েকদিন আগে একইভাবে ইডেনের মতো বদরুন্নেসা কলেজেও দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ এবং আহত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওই কলেজের নেত্রীদের ব্যাপারে অভিযোগ, তারা ছাত্রীদের ধরে ধরে হোটেলে বা বাসায় পাঠিয়ে থাকেন। এতে কেউ রাজি না হলে তাকে হল থেকে বের করে দেয়াসহ মারপিট পর্যন্ত করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনৈতিক কাজে রাজি না হওয়া ছাত্রীদের ‘শিবির’ সমর্থক বলে পিটিয়ে হল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে।
হল ছাড়ছে ছাত্রীরা : এদিকে গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক ছাত্রী চরম উদ্বেগ নিয়ে হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন অভিভাকদেরও কলেজের সামনে ভিড় করতে দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করে কিছু অভিভাবক ও ছাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আমরা কি সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে এলাম, যেখানে আমাদের মেয়েরা তাদের ইজ্জত ও সম্মান নিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিগত আমলেও একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নাসিরউদ্দিন মানিক নামে জনৈক ছাত্রলীগ নেতা ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি’ উত্সব পালন করেছিলেন। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তত্কালীন সরকার কোনো ব্যবস্থা তো নেয়নি, উপরন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। মানিক বর্তমানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী কলেজ পরিদর্শক। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রগতিশীল দলের প্রধান সহযোগী সংগঠনের নেতানেত্রীদের এই গর্হিত অন্যায় এবং সভ্যতা-ভব্যতাতীত কর্মকাণ্ড সংঘটনের পেছনে ‘লাগাম’ টেনে না ধরাই প্রধানত দায়ী। এর দায়ভার কিছুতেই ‘ফাদার সংগঠন’ হিসেবে আওয়ামী লীগ এড়াতে পারে না। তারা বলেছেন, অভিযোগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, জুনিয়র নেত্রী বা সাধারণ ছাত্রীদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগেরই সিনিয়র নেতাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। বিষয়টি ‘যে ভূত ছাড়াবে, তাকে ভূতে আছর করার মতো’ হয়েছে। যে কারণে দলের হাইকমান্ড তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই এ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা দরকার বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বিশিষ্ট নারী নেত্রী আয়শা খানম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কী বলব লজ্জার কথা! এর চেয়ে দুঃখ, কলঙ্কজনক কিছুই হতে পারে না। আমি নিজেও একসময় ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছিলাম। কিন্তু আমাদের সময়ে এই অপসংস্কৃতি ছিল না। আমরা এ রকম হেলেন জেরিনদের দেখিনি। এটা কোনো দলের বা সংগঠনের গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না। তিনি বলেন, যে কোনো মূল্যে এই কলঙ্কজনক সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কথার ফুলঝুরি নয়, অ্যাকশনে যেতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক তাজমেরী এসএ ইসলাম বলেন, ‘ছাত্র সংগঠনকে যারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে, তাদের কাছে অনৈতিক কলঙ্কজনক কর্মকাণ্ড, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি—কোনো ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। দেশে অন্যায়ের শাস্তি হচ্ছে না। অতীতে ওইসব দলের এরকম নানা কেলেঙ্কারি রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।’
চার ছাত্রলীগ নেত্রী বহিষ্কার : অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় একপক্ষীয়ভাবে কলেজ সভাপতি নিঝুম গ্রুপের বিপক্ষের চার ছাত্রলীগ নেত্রীকে গতকাল বহিষ্কার করেছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি। এরা হলেন কলেজ শাখার সহ-সভাপতি চম্পা খাতুন, সাংগঠনিক সম্পাদক শারমিন সুলতানা শর্মী, তানিয়া সুলতানা হ্যাপী ও সহ-সম্পাদক কানিজ ফাতেমা। এ বিষয়ে বহিষ্কৃতরা জানান, সভাপতি নিঝুম ও সাধারণ সম্পাদক তানিয়ার নানা অনৈতিক কাজ ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করেছেন। কেন্দ্রীয় সভাপতি নিঝুম ও তানিয়ার কেলেঙ্কারি আড়াল করতে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারা এ বহিষ্কারাদেশ মানেন না।
আমার দেশ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




