গ্যাস-বিদ্যুত সঙ্কট সমাধানে গত ১৬ মাসে সরকারের অর্জন নেই। আছে সেই পুরনো সিদ্ধান্তহীনতা ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা। এতে নতুন বিদ্যুত আসছে না, বরং গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিদ্যমান বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনায় ঘাটতি নেই, আছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। ফলে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুত না পৌছে, আসছে লোডশেডিং আর লোড ব্যবস্থাপনার একের পর এক নির্দেশনা। সর্বশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পিক আওয়ারে পাঁচ ঘণ্টা এসি চালানো যাবে না। দিনের বেলায় চালালেও ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে চালানো যাবে না। এর আগে প্রতিবার লোডশেডিং এক ঘণ্টার জায়গায় দুই ঘণ্টা করা হয়েছে। এতে জনদুর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে। নির্দেশনার পাশাপাশি এবার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঠ পর্যায়ে বিদ্যুত ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে। কৃষকরা সেচকাজে কখন বিদ্যুত ব্যবহার করবে আর কখন করবে না_ এ ব্যাপারে কৃষকদের অবহিত করবে। এভাবে একের পর এক নির্দেশনা এলেও স্থায়ী কোন সমাধানের দিকে এগোচ্ছে না বিদ্যুত সঙ্কট। বরং অতীত সরকারগুলোর সিদ্ধান্তহীনতার সঙ্গে মহাজোট সরকারেরও সিদ্ধান্তহীনতা যোগ হতে চলেছে। এ সরকারও শুধু একের পর এক পরিকল্পনা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোন পরিকল্পনাই দ্রুত বাসত্মবায়নের দিকে এগোচ্ছে না। যে কারণে অতীতের সরকারগুলোর সিদ্ধান্তহীনতার পাল্লা ভারি হয়েছে, সে কারণ দূর করতে না পারলে মহাজোট সরকারকেও বিদ্যুতের ব্যর্থতা মাথায় নিয়েই বিদায় নিতে হবে।
বর্তমান সরকারের প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বিদ্যুত সঙ্কটের সমাধান। সে লক্ষে ক্ষমতায় এসেই বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে মহাজোট সরকার। এ মহাপরিকল্পনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুত সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের সুনির্দিষ্ট কথা উল্লেখ রয়েছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্বল্পসময়ে বিদ্যুত সঙ্কট সমাধানের জন্য ৫৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ৮২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দশটি ভাড়া পিকিং বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক চারটি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেচ মৌসুমের আগেই ৩১ মার্চের মধ্যে ভাড়ায় বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসার কথা ছিল। কিন্তু দরপত্র আহ্বান ও প্রক্রিয়াকরণ করতে গিয়ে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে। ফলে আটটির স্থলে মাত্র ৩০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি স্বাৰর সম্ভব হয়েছে। চার মাসের মধ্যে বিদ্যুত পাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। যদিও এতে প্রতি ইউনিটের বিদ্যুতের খরচ পড়বে ফার্নেস অয়েলের চেয়ে দ্বিগুণ প্রায় ১৫ টাকা। বেশি দামে নেয়া হলেও জুলাইয়ের আগে ওই বিদ্যুত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ বিদু্যত কেন্দ্রগুলো বসানোর চুক্তিই হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে।
দশটি পিকিং বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত কোন চুক্তি হয়নি। এ পর্যন্ত অগ্রগতি হচ্ছে- সরকারী ক্রয় কমিটি গত ২১ মার্চ ২৭০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি পিকিং বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এ বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো স্থাপনে চুক্তি স্বাৰরের পর উৎপাদনে আসতে ১৫ মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড বলছে, শীঘ্রই এ কেন্দ্রগুলোর ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এছাড়া সরকারী খাতে সিলেটে ১৫০ মেগাওয়াট ও চাঁদপুরে ১৫০ মেগাওয়াট ৰমতার দু'টি বিদু্যত কেন্দ্রের চুক্তি হয়েছে এ সরকারের আমলে। এ দু'টি বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সম্পন্ন হয়। এ কেন্দ্র দু'টি আগামী বছরে চালু হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বিদু্যতের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদু্যত প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে অত্যধিক বেশি সময় লাগছে। দরপত্র আহ্বান করে কার্যাদেশ দিতে চার বছর পর্যনত্ম সময় লেগে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা। দরপত্র আহ্বানের পর বর্তমানে কারিগরি মূল্যায়ন দ্রম্নত সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু ওই প্রসত্মাব মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে থাকছে। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে অকারিগরি পর্যায়ে সিদ্ধানত্ম নিতে ছয় থেকে এক বছর সময় ব্যয় হচ্ছে। একটি প্রকল্পের কারিগরি কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ে সিদ্ধানত্ম নিতে এত দীর্ঘ সময় লাগাটা দুঃখজনক ব্যাপার।
বিদু্যত সঙ্কট এতটাই নাজুক আকার ধারণ করেছে যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টাই বিদু্যত থাকছে না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে আসায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দেশে বিদু্যতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। কিন্তু ওই চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন বাড়েনি। বরং গ্যাস সঙ্কটের কারণে পুরো উৎপাদন ৰমতাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ছয় হাজার মেগাওয়াটের বিপরীতে বর্তমানে বিদু্যত সরবরাহ করা হচ্ছে চার হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ফলে এবার গ্রীষ্মে বিদু্যত সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। আরইবির গ্রাহকদের দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদু্যত সরবরাহ দেয়া হচ্ছে অর্ধেক। ঢাকায় ১৪শ' মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ছয় শ' থেকে সাড়ে ছয় শ' মেগাওয়াট। ডেসকো এলাকায় পিক আওয়ারে ৫০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ৩শ' থেকে সাড়ে ৩শ' মেগাওয়াট। দেশের ওয়েস্ট জোনে ৭৩০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদু্যত দেয়া হচ্ছে ৩৫০ মেগাওয়াট।
এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে আরও সময় চেয়েছেন। বিদু্যত সঙ্কটের জন্য চারদলীয় জোট সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেছেন, বিদু্যত সঙ্কটের সমাধান রাতারাতি করা যায় না। এজন্য সময় প্রয়োজন। বিদু্যত সঙ্কটের জন্য প্রধানমন্ত্রী গ্যাস সঙ্কটকে দায়ী করেছেন। কিন্তু মহাজোট সরকার ৰমতায় এসেছে ১৬ মাস হয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যনত্ম গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হয়নি। অথচ মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানি কনকো ফিলিপস ও আইরিশ কোম্পানি তালেস্না গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য মনোনীত হয়ে আছে। বিদ্যমান গ্যাসৰেত্রগুলো থেকেও আরও বেশি গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। এ ১৬ মাসে ওই ৰেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এতদিনে গ্যাস সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যেত। অথচ গ্যাস সঙ্কটের কারণে ৭০০ মেগাওয়াটেরও বেশি বিদু্যত উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বসে থেকে থেকে এ বিদু্যত কেন্দ্রগুলোর যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হ্রাস পাচ্ছে উৎপাদন ৰমতা।
শুধু তাই নয়, দেশ কয়লার বিশাল জ্বালানি ভা-ার নিয়ে বসে আছে। অথচ সেই কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রায় চূড়ানত্ম নীতিমালাও ১৬ মাসে চূড়ানত্ম করতে পারেনি সরকার। ফলে নিজের কয়লা রেখেই বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে দীর্ঘমেয়াদে ২০০০ মেগাওয়াট ৰমতার বিদু্যত কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৩৯ বছর ধরেই বাংলাদেশের উন্নয়ন সিদ্ধানত্মহীনতার বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে। কোন সরকারই ওই সিদ্ধানত্মহীনতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। রাশিয়ান বিদু্যত কেন্দ্রগুলো সংস্কারের সময় ছিল তিন বছর। সেই সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে দশ বছর। মহাজোট সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ৰমতায় এসেছে। এ সরকারের সিদ্ধানত্মহীনতার বেড়াজাল ভাঙতে না পারাটা দুঃখজনক। বিদু্যত সঙ্কটের সমাধানের জন্য দ্রম্নত সিদ্ধানত্ম গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণের ৰেত্রে তদ্বির-সুপারিশ কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। বিদু্যত কেন্দ্রের দরপত্র আহ্বানের পর নানা মহলের হসত্মৰেপের কারণে দ্রম্নত প্রকল্প বাসত্মবায়ন বাধাগ্রসত্ম হচ্ছে। সরকারকে সিদ্ধানত্ম নিতে হবে_ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাবে, কোন তদ্বির বা সুপারিশে নয়। কোন কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্র নীতিমালায় কোন পরিবর্তন আনা যাবে না। কঠোরভাবে দরপত্র নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। তাহলে ভাল কোম্পানি বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পাবে এবং সময়মতো বিদু্যত কেন্দ্র স্থাপিত হবে। সিদ্ধানত্মহীনতা দূর করার পাশাপাশি প্রতিটি কাজে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। দরকার আছে দৰ লোকের। বিদু্যত কেন্দ্রগুলো বাসত্মবায়নে দৰ প্রকল্প পরিচালকের জরম্নরী প্রয়োজন রয়েছে। কারণ ওই পরিচালকের ওপরই নির্ভর করে নির্দিষ্ট সময়ে তা উৎপাদনে আসা
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




