লেখকের মুখবন্ধ
বর্তমান প্রবন্ধগুলোর রচনার পরিপ্রেতিটাই এর উপযুক্ত ভূমিকা হতে পারে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে অবসর সময় কাটাচ্ছি। সম্বল ছিল পারিবারিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষা সাথে স্কুল থেকে শেখা বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা। এ দুই জাতীয় শিক্ষা মানসিকতায় বিশেষ কোনো বিরোধ না জাগিয়েই সহাবস্থান করছিল-হয়তো আমাদের দেশের স্কুলগুলোতে এক বিশেষ সচেতন রণশীল ভঙ্গিতে বিজ্ঞান শেখানোর ফলে। গোলযোগটা বাধে মরিস বুকাইলি প্রণীত বাইবেল-কোরআন ও বিজ্ঞান বইটা হাতে আসার পরে। বলতে হবে বইটা পড়ে আমি তীব্র প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলাম, বিশেষত বইটার কোরআন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত তুলনামূলক আলোচনার অংশতে। লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী সপ্তম শতক থেকে প্রচলিত মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনে যেসব তথ্য বা ইঙ্গিত রয়েছে সেগুলোর সত্যতা নাকি আমরা চৌদ্দ শতক পরে এসে আজ উদ্ধার করতে পারছি। লেখকের উপস্থাপিত উদাহরণগুলোর বেশিরভাগ ছিল প্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কিত, বিশেষত জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত। তিনি কোরআনের বিভিন্ন অংশ উল্লেখ করে দেখাতে চেয়েছেন যে বর্তমানে জ্যোতির্বিদ্যায় সে তথ্যগুলোই আবিষ্কৃত হচ্ছে! বলা ভালো যে মানব ইতিহাসের ক্রমোন্নতির কোনো স-বিস্তারিত ধারণা তখনো আমার ছিল না, তাই এত দীর্ঘ সময় ব্যবধানের দুটো ঘটনার এহেন সম্মেলন আমার অতীত শিার সাথে একটা বোঝাপড়া করার তাগিদ যোগালো। ধর্মগ্রন্থ আর ধর্মীয় বিষয়ের খুঁটিনাটি আমার ভালোই জানা ছিল, ছিল না জ্যোতির্বিদ্যায় বর্তমান অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা। এখন বুঝি যে মরিস বুকাইলির চিন্তা বা প্রস্তাবনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কষ্টকল্পনার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। অথবা বলা যায় কষ্টকল্পনায় অতি অভ্যস্থ হয়ে ওঠা প্রায়-সহজাত কল্পনা!
সে সময় জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহী কিছু সঙ্গী-সাথী খুঁজে পাওয়াটা ছিল একটা আশীর্বাদ। দেয়াল আঁটা একটা বিজ্ঞাপন থেকে “বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন” নামে একটা সংগঠনের খবর পাই, যারা জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক আলোচনা সভা, পাঠচক্র পরিচালনা আর আকাশ পর্যবেণের মতো অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সে দলে ভিড়ে গেলাম, আর ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর সংগঠনটির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। এই সংগঠনটিরই মুখপত্র মহাকাশ বার্তা নামক পত্রিকার জন্য বর্তমান প্রবন্ধগুলো লেখা হয়েছিল।
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে মৌলিক কোনো অবদান রাখার অবস্থা আমার প্রবন্ধগুলো রচনা করার সময়ও ছিল না, এখনো নেই। তাই ‘লেখক’ না বলে নিজেকে এই রচনাগুলোর ‘সংকলক’ বলাই শ্রেয় মনে করবো। রচনাগুলো সংকলন করতে এত বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি যে সেসব উৎসের কোনো নির্ভুল তালিকা উপস্থাপন করা সম্ভব নয়, আর কোনো সংক্ষিপ্ত তালিকা সংযুক্ত করে সে দায় না সারাই সমীচীন। বর্তমান বিজ্ঞানের যে কোনো শাখার সাথে পরিচিত হতে হলে ঐ শাখায় ব্যবহৃত ধারণাগুলোর সাথে সাথে ধারণাগুলোর ঐতিহাসিক বিবর্তনের সাথেও পরিচিত হতে হবে-তা না হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংহতি ই শেখাটা হবে যান্ত্রিক, নিষ্ফলা। তাই জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক পরিচিতিমূলক বর্তমান প্রবন্ধগুলো ঐতিহাসিক প্রোপটে সাজানো। জ্যোতির্বিদ্যায় নিউটনীয় মেকানিক্সের পরবর্তী ক্রমোন্নতির পর্যায়গুলো বর্তমান বইয়ে ঠাঁই পায়নি-সেজন্য ভিন্ন পরিসর আবশ্যক। তবে খানিকটা অভাব পূরণ করতে আমেরিকা থেকে সম্ভবত ১৯৯২ সালে প্রকাশিত () নামক একটা ছোট বইয়ের উল্লেখযোগ্য অংশের অনুবাদ “মহাবিশ্ব” প্রবন্ধে অন্তর্গত করা হলো-ঐ বইয়ের লেখকের নাম এখন আর স্মরণ করতে পারছি না; তবে তিনি একজন চীনা জ্যোতির্বিদ, আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে “কবিদের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা” বিষয়ের অধ্যাপক। বিগত পাঁচ-ছয়শ’ বছরে জ্যোতির্বিদ্যায় যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তা বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোর অবদান, আর তাদের সম্বল ছিল পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। এেেত্র ভারতীয় উপমহাদেশের অবদানের ব্যাপকতা মোটেই কোনো স্বল্প পরিসরে আলোচনার বিষয় নয়। গ্রিক পরবর্তী ইউরোপীয় ধারাবাহিকতাটুকু অনুসরণ করার ফলে জ্যোতির্বিদ্যায় প্রাচীন ভারতীয় ও অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীব্যাপী মুসলমানদের অবদানের নিতান্ত পরিচিতিমূলক বিবরণ উপস্থাপন করতে না পারার খেদ পোষণ করছি। আর ‘সংকলক’ হিসেবে আমার ভাষা ব্যবহারের দুর্বলতা টের পেতে পাঠককে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
এতসব অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও আমি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে অন্তত এই একটা কাজকে সম্পূর্ণতা দিতে আরো অনেকের নিরলস সম্পৃক্ততা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সংহতি প্রকাশনকে নিছক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে দায় না সেরে নিজেও সংহতি প্রকাশ করছি।
আলীফ হোসেন
জানুয়ারি ২০০৮ ৩৮ মদন পাল লেন
নবাবপুর রোড, ঢাকা
লেখক পরিচিতি
আলীফ হোসেন, ১ আগস্ট ১৯৭৭ ঢাকায় জন্ম। উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুল ও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের পর শাহজলাল বিজ্ঞঅন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিা সম্পন্ন করে বর্তমানে ঢাকায় গণিত শিক হিসেবে পেশায় নিয়োজিত। ছাত্রাবস্থা থেকে বিজ্ঞান আন্দোলনের সাথে যুক্ত। বিজ্ঞান ও দর্শনের বিভিন্ন শাখায় লেখালেখি ও অনুবাদ কর্মে নিয়োজিত। অনূদিত পাণ্ডুলিপি সিগুমুন্ড ফ্রয়েডের সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকন্টেট।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




