মায়ের বকুনি খেয়ে প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া। স্কুলটা তেমন সাজানো ছিল না। টিনের তৈরী, তাতে কোন রকমে গাদাগাদি করে বসা যায়। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম না থাকার কারণে প্রায় সময়ই আমগাছতলায় আমাদের ক্লাস হতো। মাঝে মধ্যে শিক্ষক ছড়া কাটতেন, আমরা মনযোগ দিয়ে শুনতাম আর গুনগুন করে গাইতাম। কখনো কখনো স্কুলে যেতে মন চাইত না। আমি গরিবের সন্তান। দারিদ্রতা ছোটবেলা থেকেই আকঁড়ে ধরেছিল। তবুও স্কুলের ফার্স্টবয় ছিলাম।
হাইস্কুলে উঠলাম। দায়িত্ববোধ যেন আরেকটু বেড়ে গেল। প্রথম ক্লাসেই স্যার ঘোষণা দিলেন স্কুল ড্রেস তৈরী করার জন্য। আমি স্কুল ড্রেসের ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। বাড়িতে বলার পর বাবা-মা মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার ওপর স্কুল ড্রেস! জোড়াতালি দেয়া সংসারে বাড়তি খরচ গায়ে লাগে বেশি। তবুও তারা কষ্ট স্বীকার করে আমার স্কুল ড্রেস তৈরী করে দিলেন। গ্রামের একজনের পুরনো বইও সংগ্রহ করে দিলেন।
স্কুলে অনেক বন্ধু হলো। তাতে কী হবে, গরীবের যে বন্ধু নেই তা তখন থেকেই আন্দাজ করতে পারলাম। অনেক সময় তারা আমাকে এড়িয়ে চলত। টিফিনের সময় অনেকে হোটেলে খেয়ে নিত। আমি শুধু স্কুলের টিউবওয়েল থেকে ঠান্ডা পানি পান করতাম। বৃহস্পতিবার আনন্দ বেশি হতো, কারণ ওই দিন তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ায় টিফিনের প্রয়োজন হতো না।
টাকার অভাবে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে পারিনি। নবম ও দশম শ্রেণীতে নিজের চেষ্টায় ভালো রেজাল্ট করলাম। পরীক্ষার সময়ও ঘনিয়ে এল। আমার একটা মাত্র শার্ট, তাও জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। মেসিনে সেলাই করা হলেও স্পষ্ট বোঝা যায়। অতসব দেখার মতো সময় নেই আমার। মনযোগ দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেলাম। আমাকে পাস করতেই হবে।
যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। অনেকে নানান ডিজাইনের দামি পোশাক পরে পরীক্ষা দিতে এসেছে। তাদের দিকে তাকালে আমার কষ্ট হতো। অন্য স্কুলের এক ছেলে পরীক্ষা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করল তোমার কি আর ভাল জামা নেই। আমি উত্তর দিতে পারিনি। দু চোখে শুধু না পাওয়ার ক'ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কে বলে আমি কিছু পাইনি, পরীক্ষায় আমি ফার্স্টক্লাস পেয়েছি। তখন তো রীতিমতো সবাই বাহবা দিতে লাগল। অনেকে আমাকে নিয়ে উদাহরণ দিত তাদের সন্তানকে মানুষ করার জন্য। আমার স্কূল থেকেও তখন আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম।
সেই পুরস্কার আমার পিতা-মাতার নামে উৎসর্গ করি। ছেড়াঁ স্কুল ড্রেসটা আজ কোথায় আছে জানি না। পড়ালেখা শেষে করে আমি এখন অনেক দূর এগিয়েছি। মানুষকে সাহায্য করার মতো সামর্থ্য হয়েছে। অনেককে দেখেছি দামি পোশাক পড়েও পাস করতে পারেনি। তারা ব্যর্থ হয়েছে। আজো মনে পড়ে সেই স্মৃতি। কখনো হাসায়, কখনো কাদাঁয়, আবার কখনো ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভালবাসাযুক্ত স্মৃতির অতল তলে।
মোঃ লুৎফর রহমান (সম্রাট)
০১৯২৫২৬৬২৬৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




