মেয়েটি চলল প্রবাসের পথে - আগমনী বার্তা (সামু পাগলার নতুন সিরিজ )
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আহা! লম্বা একটা জার্নি করে, রাজ্যের যত ঘাম ময়লা শরীরে শাওয়ারের নিচে দাড়ানোর পরে যখন ঠান্ডা পানির ফোঁটা মাথায় পড়ে - মনে হয় জান্নাত এটাই! সব ক্লান্তি যেন এক নিমিষে পানির সাথে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। হাজারটা চিন্তা ভাবনা শাওয়ারের সময়েই মাথায় আসে। মাথায় শ্যাম্পু ঘষতে ঘষতে ড্রয়িং রুমে কি হচ্ছে সেটা মনে মনে ভাবছি।
বাব্বাহ বাড়িতে এসে যা দেখলাম! রঙিন ফুল যুক্ত সাদা চাদর বিছানো একটা ছোট খাট ড্রয়িং রুমের দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছে। সেখানে আমার দাদী ও ফুপি বসে আছেন। দাদা ও চাচা চাচীরা সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। দাদীর ফোলা ফোলা চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষন কেঁদেছেন।
আমরা বাড়িতে ঢোকা মাত্র ফুপি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন, "তোমরা কি করলে বলতো, তোমাদের বিদেশ যাবার খবরে আম্মুর তো কাঁদতে কাঁদতে শরীর খারাপ! আমাদের সবারো মন খারাপ! দেশে থাকতে সমস্যা কি? হুট করে কি এমন হলো যে বিদেশে যেতে হবে!?"
এসব শোনামাত্র বাবা মার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেল, আর আমি হলাম অবাক। বাবা মা তো বলেছিল দাদী খুশি আামাদের বিদেশে যাবার খবরে তাহলে বাড়িতে এমন শোকের পরিবেশ কেন? মনে হচ্ছে কেউ যেন মারা গিয়েছে! আমাদের বাড়ির পুরোন নিয়ম, বড়দের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ছোটদের রাখা যাবেনা।
আমি জুতো খুলে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে গিয়েছি কি মায়ের চোখ রাঙানি; "যাও আগে গোসল করে এসো, তারপরে দাদীর কাছে বসবে।"
আমি ইশারায় বোঝালাম দাদীর কাছে যাব, মাও ইশারায় বুঝিয়ে দিল জেদ করলে খবর আছে!
আর কি! এখন শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে ভাবছি দাদী কি এখনো মুখভার করে আছেন? থাকলে ভালো, প্লিজ দাদী আমাকে যেতে দিও না বিদেশে, সাবানার মতো কান্নার এক্টিং করে আটকাও বাবা মাকে। বাড়ির সবাই না মানলে বাবা মা জীবনেও দেশের বাইরে পা রাখবেনা সে ব্যাপারে আমি শিওর। এতসব বিড়বিড় করতে জলদি করে ভেজা চুলের জট ছাড়াচ্ছি, গিয়ে দেখতে হবে তো এখন বাড়ির আবহাওয়া কেমন? উত্তেজনায় তর সইছেনা।
কোনমতে রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে পা দিয়েই কয়েক ভোল্টের ঝটকা খেলাম! দাদী হাসিমুখে চা খাচ্ছে আর মা হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ছে দাদীর গায়ে!
আমার দিকে চোখ যেতে দাদী মিষ্টি হাসি হেসে ডাক দিল "আসো দাদুভাই বলে" আর পাশে বসিয়ে বলল "দাদু আমার বরফ দেশে যাব, বিদেশী মেমদের মতো লাল চুল করব!" হাহাহা।
দাদী হাসে, একটু আগে রেগে থাকা ফুপি সহ বাড়ির সবাই হাসে। সবার মনে যেন ঈদ লেগেছে!
আমি অবাক হয়ে একবার দাদীর দিকে আরেকবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছি। তারপরে ড্রয়িং রুমের এককোণে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাচ্ছি। শাওয়ার করতে গিয়ে কি কয়েক মাস নিয়ে নিলাম যে দুনিয়াই পাল্টে গেল! শোকের বাড়ি হুল্লোরে বাড়ি হয়ে গেল? খোলাখুলি কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না বড়দের সামনে।
রাতে মায়ের কাছে জানতে চাইলাম, তখন মা বলল,
"তোর দাদীকে কিছু হিংসুটে প্রতিবেশি আর আত্মীয়রা উল্টোপাল্টা বুঝিয়েছিল। বিদেশে গেলে নাকি তোর বাবা আর আমার গলার স্বরও শুনতে পারবেনা। ওখান থেকে ফোন করতে অনেক টাকা লাগবে। তুই একবার গেলে আর আসতে চাইবি না দাদীর কাছে, তোর চেহারা কখনো দেখতে পারবেনা। আমরা সবাই তাকে ভুলে যাব ইত্যাদি অনেককিছু। সরল মানুষ তো, তাই ঘাবড়ে আমাদেরকে আটকাতে চেয়েছিলেন!"
"মা! তুমি কিভাবে এত তাড়াতাড়ি দাদী আর বাড়ির সবার মন পাল্টালে?"
মা মুচকি হেসে রহস্য করে বলল, "কিছু কারিশমা আছে তোর মায়ের, বলা যাবেনা!"
আমি জোরাজুরি করলাম, "মা বলোনা বলোনা।"
মা বলল, "এখন বললে বুঝবি না, বড় হ তখন বলব।
কোনভাবেই মায়ের কাছ থেকে ব্যাপারটা জানতে পারলাম না। বাবার কাছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছেও করলনা, কেন যেন মনে হলো এসব বিষয় মায়ের কাছেই জানতে হয়। তখনকার মতো আমার কাছে রহস্যই থেকে গেল।
বিদেশে যাবার পুরো বিষয়টাতে খুশি হবার মতো কিছুই আমার ছিলনা। অন্যবার দাদার বাড়িতে গিয়ে আমার ঠোঁট থেকে হাসি সরত না আর এখন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ঢাকায় যাবার কদিন পরে এক ছুটির দুপুরে সবাই ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত দিয়ে লাল টকটকে মুরগীর মাংস খেয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। আর আমি শুয়ে আছি ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে। বাইরে তীব্র রোদ এবং তীক্ষ্ণ মেঘের আনাগোনার খেলা চলছে। জানালা দিয়ে একবার মুখে রোদ এসে পড়ছে আবার ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে - তাতেই বাইরে না তাকিয়েও রোদ/মেঘ এর স্কোরকার্ডটা ভালোমতোই বুঝতে পারছি।
দুপুর শেষ হতে চলেছে, তখন মা আমার কাছে এসে সোজাসুজি বলল, "মন খারাপ করে থাকিস কেন এতো? স্কুল নিয়ে ভয় হচ্ছে?"
সাথে সাথে আমার কি হলো কে জানে! কেঁদে দিলাম আর মনে জমে থাকা কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলাম, "মা ওরা সবাই আমাকে নিয়ে হাসবে। আমি তো সিএনএন এর খবরও বুঝিনা - ওরা তো ওভাবেই কথা বলবে। আমি বছর বছর ফেল করব মা, তারপরে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেবে, আমি অশিক্ষিত থেকে যাব। আমাকে কেউ পিওনের চাকরিও দেবে না। লটারি না জেতা পর্যন্ত আমাকে ঝালমুড়ি বেচে যেতে হবে!"
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঠোঁটস্থ পড়ার মতো একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে গিয়ে কখন আমার মাথা মায়ের কোলে গিয়েছে খেয়ালও হয়নি।
মা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, "গাধী মেয়েটা আমার। তোর চেয়ে বড় বয়সে চৈতি আপুরা গেল না? ও তো তোর মতো ভালো স্টুডেন্টও ছিলনা। কিন্তু কি সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে।!"
আমার কান্নার গতি কিছুটা থেমে এসেছে কিন্তু চোখ দিয়ে পানি পড়ে যাচ্ছে। নি:শ্বব্দে কাঁদতে কাঁদতে বললাম - "আপু তো ইংলিশ মিডিয়ামের, ইংলিশ মিডিয়ামের ঘাস চিবানো গাধারাও ইংলিশ পারে, বাংলা মিডিয়ামের দুধ খাওয়া মেধাবীরা গ্র্যামার মুখস্থ পারলেও ইংলিশে কথা বলতে পারেনা।
মা আমার কথা শুনে হেসে ফেলল আর বলল, "তোর বয়স কম, এখন তোর জন্যে নতুন ভাষা শেখা সহজ হবে। ওখানকার সিস্টেমটাই এমন যে সবাই মানিয়ে যায়। তুই গেলে দেখবি দেশের স্কুলের কথা মনেই পড়বেনা। তুই নিজেই জানিস না তোর কত বুদ্ধি! আমি বলছি তো তুই মানিয়ে নিবি আর ভালো রেজাল্টও করবি! মিলিয়ে নিস আমার কথা!"
সেদিন মায়ের কথা শুনে কি ভীষন স্বর্গীয় একটা স্বস্তি যে পেলাম! সেই অনুভূতি কিছু কালো অক্ষরে বর্ণনা করা অসম্ভব। মায়ের কথাগুলো নিছক সাহস জোগানো কথা মনে হয়নি, ওর চোখেমুখে আমার ওপরে বিশ্বাস স্পষ্ট ছিল। যাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, আমাকে নিয়ে তার বিশ্বাসে নিজের প্রতি আস্থা বেড়ে গেল হুট করেই। সত্যিই - মায়ের কোল আর কথায় যে শক্তি আছে, সেটা এই পৃথিবীর অন্যকিছুতে নেই....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পূর্বের কুইজ: প্রশ্ন ছিল - দাদার বাড়িতে গিয়ে অবাক কেন হলাম? সবচেয়ে কাছাকাছি উত্তর দিয়েছেন সবার প্রিয় ব্লগার আনমোনা এবং আমার মনা আপু। তাকে অভিনন্দন এবং প্রাইজ হিসেবে কিছু ফুল রইল।
আনমোনা আপুর উত্তরটা ছিল - "আমার মনে হয় দাদা-দাদী হঠাৎ মত পাল্টে তোমাদের আসতে দিতে চায়নি। তাদেরও মন খারাপ হয়েছিলো। হয়তো ফোনে তোমাকে সান্তনা দিয়েছে, তুমি ভেবেছিলে সবাই খুব খুশী। পরে দেখলে তাদেরও মন খারাপ।"
ওনার জবাবে যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটা হলো, আমি ইচ্ছে করে যে হিন্টটা ছেড়েছিলাম পোস্টে - উনি সেটাকেই ব্যবহার করে উত্তর দিয়েছেন। শুধু একটা ব্যাপার, প্রথমে ওনারা আসলেই খুশি হয়েছিলেন - সেটা স্বান্তনা ছিলনা। পরে অন্যদের নানা কথায় তারা ভীত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এ পর্বের কুইজ - বাড়ির সবাইকে মা এত কম সময়ে মানালো কি করে?
সঠিক উত্তর এবং উত্তরদাতার নাম পরের পোস্টে যোগ করে দেওয়া হবে।
ছবিসূত্র: অন্তর্জাল!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ৯:০৯