somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হবার পর’-ঘোরগ্রস্থ সময়ের গল্প

১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আপনাদের হাতে অনেকগুলো অপশন থাকতে পারে কিন্তু আমি এই মুহূর্তে এমনটা ভাবতে চাই- যখন কোন একটি বই পড়তে গিয়ে লেখকের নামটা ভুলে যাই, ভুলে যাই ভাষা ও বাক্যের প্রয়োগ, কাহিনীর বিন্যাসে গল্পের আবিষ্টতায় চারপাশকে ভুলে গিয়ে বইয়ের ভেতর বুঁদ হয়ে থাকতে পারি, সেই বইটিকে আমি নিশ্চয়ই উৎকৃষ্ট মানের বই বলবো। ‘লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হবার পর’-বইটির পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াটি ঠিক এমনটাই হয়েছিল। আমি এই বইটির পাঠ শুরু করেছিলাম প্রচণ্ড কোলাহলের ভেতর। বরিশালের লঞ্চের ঢেকে যাবার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা বুঝবেন এর ভেতরে বইয়ে মনোযোগ দেয়াটা কতটা কঠিন! ভিড়টা টের পেয়ে একটু আগেই পৌঁছে গেছিলাম লঞ্চে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। সবগুলো লঞ্চ লোকে গিজগিজ করছে! লঞ্চে আনসারদের সহযোগিতায় বসার মতো একটা জায়গা পেয়ে গেলাম। মানুষের কোলাহল আর হকারের ডাক-চিৎকারের ভেতরেই নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে পড়া শুরু করলাম- ‘লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হবার পর’ গল্পবইয়ের প্রথম গল্প ‘চাঁদের মুখোমুখি রাতে’।

চিরায়ত বাংলা গল্পের সেই পুরনো নিয়মে গল্পের শুরুতে লেখক আটকে আছেন। আকাশ, নদী, চাঁদ, জোৎস্না- এসব ছাড়া যেন বাংলা গল্প লেখা বারণ আছে! সেই চাঁদের চিরায়ত আলো কিন্তু প্রথম বাক্যে যে বাউন্স দিয়ে লেখা শুরু হল বিরক্ত হবার আগেই ফাঁদে পড়ে গেলাম- ‘চাঁদটা আস্তে আস্তে কালোর দিকে আগাচ্ছে। তার মুখে বসে আছে অনাগত সকালের মুখোশ।’ ভাবনার আগেই জোৎস্নার আলো এসে এক রহস্যের পর্দা টেনে দিলো আমাদের সামনে। রাত তখন কয়টা বাজে? ঠিক অনুমান করা যায় না! সময়টা জানা কি খুব জরুরী? একদম না কিন্তু লেখক আমাদের মনে সময়ের ভাবনাটা টেনে আনেন। তার গল্পের সুক্ষè চালে আমরা সময়ের চিন্তায় আটকে পড়ি। আর তখনই তিনি আমাদের সামনে একটি ঘড়িকে উম্মোচন করেন। আর ঘড়ি দেখতে গিয়ে সময় ভুলে আমরা একটি হৃদয় জয়ের গল্প দেখে ফেলি। হৃদির যখন প্রতিদিনের হাত খরচ এক-দুইশত টাকা, তখন চারশত টাকার ঘড়ি তো সস্তার মনে হবে। কিন্তু রাফির দেয়া এই চারশত টাকার ঘড়িটা অমূল্য হয়ে ওঠে। হৃদির কাছ থেকে শোনা যাক- ‘২০১৩ সালের এক বিকেলে রাফি আমাকে ঘড়িটা গিফট করেছিলো। তিন থেকে চারশ টাকার ঘড়িটি পেয়ে মুহূর্তের জন্য তখন নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে হয়েছিলো। সেদিন সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে রিকশায় রাফির ঠোঁট ভিজিয়ে দিয়েছিলাম আমার ঠোঁটের উষ্ণতায়। আমার ঠোঁটের লিপিস্টিকে রাফির ঠোঁটও পান খাওয়া মানুষের মতো লাল হয়ে গিয়েছিলো। সেই লিপিস্টিক রাফি তার জিহ্বা দিয়ে মুখের ভেতরে নিতে নিতে কি যে এক তৃপ্তির হাসি দিয়েছিলো...সেই হাসি এখনো আমার চোখের সামনে হাসে। আমি জানতাম থার্ড ইয়ারে পড়া রাফির কাছে এই তিন, চারশ টাকা অনেক। এটা তার টিউশনির জমানো টাকা। হয়তো একশ টাকা করে জমা করে এটা সে কিনেছে। ঘড়িটা অনেকটা ব্যসলেটের মতোন। সে কারণে রাফির আবেগের সাথে আমার ভালো লাগাটাও এই স্বল্প দাম উতরে হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলো।’ হৃদয়ের এই আবেগকে কখনো অস্বীকার করতে পারেনি বলেই একদিন পালিয়ে বিয়ে করে। সিদ্ধান্তটা যে সঠিক ছিল না বিয়ের আট মাসের মধ্যেই সেটা বুঝতে পারে কিন্তু রাফির ভালোবাসার কাছে ভুলটা ঠিক পাত্তা পায়না! সব কিছু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টায় নির্জন গ্রামের বাড়িতে হৃদিকে রেখে রাফি শহরে যায় সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে। গল্পটা ঠিক এখান থেকেই শুরু হয়। জোৎস্নার আলোয় স্মৃতির ভেতর থেকে নিজের অতীতের কাছে আশ্রয় চায় হৃদি। মূলত কবর খোঁড়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার ভেতরে ক্রমশ তিনটি ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হতে হতে পৌঁছে দেয় ভোরের কাছাকাছি। রহস্যের ভেতর থেকে স্পষ্ট হয় একটি সমান্তরাল প্রেমের গল্প, একক পরিবারের নিসঙ্গতা, গ্রামীণ নির্জনতা, যৌন লালসা, ক্রোধের বিকার...

‘ওয়াদুদ ম্যানশন’ গল্পের শুরুটা সতের বছর আগে তৈরি হওয়া একটি বাড়িকে ঘিরে। বাড়ির মালিক তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারি। কিন্তু শাহজাহান রোডের এই বাড়িটা ছাড়াও ঢাকায় চারতলা বাড়ি, ব্যাংকে পঁচিশ লক্ষ টাকা! গল্পের শুরুতে সরকারি চাকুরির উপরি কামাইয়ের একটি চিত্র দেখাতে চেয়েছেন। ‘একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এতো টাকা পেলো কোথায় যে ঢাকায় চারতলা বাড়ি থাকার পরও বরিশালে আবার পাঁচতলা বাড়ি বানালো। এই প্রশ্নের উত্তর একটাই সে বাংলাদেশের নাগরিক(!) এবং সরকারি চাকুরিজীবি।’ গল্পে যে চিত্র তিনি নির্মাণ করেছেন তাতে পাঠক নিজেই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তর পেয়ে যাবেন। বরং আমার মনে হয় নৈতিকতা নির্মাণ করতে গিয়ে লেখক পাঠককে এই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে গল্পের ইমেজকে স্থুল করে তুলেছেন। কিন্তু গল্পটা শেষ পর্যন্ত স্থুল থাকতে পারেনি গল্পের ধারাবাহিকতায়। গল্পের নায়ক ওয়াদুদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া। উত্তম পুরুষে গল্পের বয়ানে লেখক একবারও ভাড়াটিয়ার নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেন নি, নিজের বয়ানে আড়াল করে রেখেছেন। গত আড়াই বছর ধরে এই বাড়িতে ভাড়া আছেন তিনি। একা থাকেন। তবে মাঝে মাঝে গোপনে বান্ধবীরা আসে। সকলে জানে বউ ঢাকা থাকে। বৌয়ের চরিত্রে মাঝে মাঝে এসে তিন চারদিন থেকে যায় রিমু। একসাথে চারজন বান্ধবী তার। চারজনকেই ভালোবাসেন তিনি। এই ভালোবাসার পেছনে যুক্তি আছে। সংসারের বাউন্ডুলে তিনি ছিলেন না। একদিন সংসারের স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে করেছিলেন মিমকে। কিন্তু বিয়ের পরই জানিয়ে দেন পুরনো প্রেমিকের কাছে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত। মিমের অনঢ় সিদ্ধান্তের কাছে ধরে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তার চিহ্ন হিসেবে রেখে গেছে পাঁচবারের সঙ্গমস্মৃতি! মিমের চলে যাবার পর কারো প্রতি যেন আর দায়বোধ কাজ করেনা। কিন্তু তবু মধ্যরাতে যখন রিমুর ফোন আসে বিচলিত হয়ে পড়ে। রিমুর চৌদ্দ বছরের মেয়ের ধর্ষিত হবার খবরে ভেঙে পড়ে। কিছু না করতে পারার অসহায়ত্বে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। মধ্যরাত্রিতে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। একটা সিগারেট টানতে টানতে হাঁটতে থাকেন। এই উদভ্রান্ত রাতে দেখা হয়ে যায় বুড়ো হয়ে অচল অবস্থায় মারা যাওয়া ওয়াদুদ সাহেবের সাথে। কিন্তু তিনি আর বুড়ো নেই, লেখকের সমবয়সী। কেনই বা তার সাথে এই উদ্ভ্রান্ত রাত্রিেেত দেখা করতে আসেন ওয়াদুদ? কেন তার পরদিনই তার স্ত্রী আত্মহত্যা করে? এইসব রহস্যের ভেতর থেকে গল্প এগিয়ে যায় পরিণতির দিকে।

‘গন্তব্য’ গল্পে এগারো বছর পরে নাটকীয় ফোনে একটি ঠিকানা হয়ে ওঠে গন্তব্য! যে গন্তব্যের টানে শুনশান রাতে কুমিল্লার কোটবাড়ি থেকে শালবনের দিকে ছুটছে রাজিব। ‘ঢাকা থেকে এসে কোটবাড়ি বিশ্বরোড নামা পর্যন্ত তার মধ্যে এক ধরনের চিন্তা ঢেউ তুলেছিলো। কিন্তু রয়েল কোচ থেকে নামার পর সিএনজির জন্য অপেক্ষার বাইশ মিনিট তাকে হাঁটিয়েছে প্রায় এগারোটি বছর। এই এগারোটি বছরের প্রতিটি মাস, সপ্তাহ, দিন, ঘন্টা মিনিটেরা পর্যন্ত রাজিবের কানে মুখ ঘষেছে। তবে তারা কোন কথা বলেনি। শুধু ঘোঙাচ্ছিলো। তাহলে কি তারা বোবা হয়ে গেছে! রাজিব নিজের মধ্যে ডুব দেয়। তুলে আনতে চায় সেই কথাবলা সময়। যারা পর্যায়ক্রমে কথা বলা শিখাবে এই বোবাঘড়িকে। যে টিকটিক করে বাজবে। আর সিনেমার দৃশ্যের মতো কথা বলে যাবে অর্নগল। কথা বলবে-শিফা-সীতাকুণ্ড, সেই বদ্দারহাট, সেই অদম্য উচ্ছ্বাস...।’ সিনেমার মতো দৃশ্যগুলো আমাদের সামনে দৃশ্যমান হতে থাকে। সীতাকুণ্ড পাহাড়ে শিফার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ, মাত্র সাতদিনের নাটকীয় প্রেম, পালিয়ে বিয়ে, ঢাকায় এক অপরিচিত লোকের বাসায় বাসর রাত কাটানো, মেয়ের বাবার করা মামলায় জেলে যাওয়া, শিফাকে দিয়ে প্রভাবশালী বাবার ডিভোর্স করানো, শিফার কাছ থেকে দূরে থাকার শর্তে একটা মিমাংসা, শিফার বয়স আঠারো হওয়ার অপেক্ষা, এইচএসসি পাশের পর লেফটেন্যান্ট ছেলের সাথে শিফার সম্মতিতে বিয়ে, রাজিবের বেঁচে থাকার লড়াই, বিডিআর বিদ্রোহে স্বামীর মৃত্যু। সবকিছু জানার পরও রাজিব নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু আজ শিফাই তাকে ডেকেছে! কিন্তু কেন? রাজিব কেন ছুটছে শিফার কাছে? রাজিব কি শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে? গল্পের অবয়ব জুড়ে লেখকের স্বভাবজাত নাটকীয় মেজাজ বহাল তবিয়তে, রহস্যের ঘোরটাও অটুট। স্বাদটা পেতে হলে গল্প পাঠের বিকল্প নেই।

‘বৃত্ত’ গল্পটি বইয়ের অন্য সকল গল্প থেকে স্বতন্ত্র। এক্সপ্রেরিমেন্টাল গল্প। একই সাথে ভাষা ও আঙ্গিকের নিরিক্ষা! পাঁচটি খণ্ডচিত্রে একটি বৃত্ত এঁকেছেন। একটি ইচ্ছে গদ্যে সে, আমি, তুমিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনটি স্বপ্নে। আর তিনটি স্বপ্নকে পরিণতি দিতে দাঁড় করিয়েছেন আরেকটি অলৌকিকতায়। জীবনস্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকার অভিশাপে। নিদারুন সে বেঁচে থাকা- ‘আর তোমরা যদি কিছু নাও করতে পারো আমরা তোমাদের চোখ হত্যার অভিযোগে বাঁচিয়ে রাখবো। সকল ধ্বংস দেখাই হবে তোমাদের শাস্তি।’ এই গল্পের ভাষা কাব্যময়-আঙ্গিকও নতুন। এরকম গল্পের ভাষা ও আঙ্গিক নিয়ে মান্নান সৈয়দের সফল চেষ্টা আছে। সেই সফলতার পথ ধরেই হেঁটেছেন সানাউল্লাহ সাগর। তবে মান্নান সৈয়দের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন ভাষা নির্মাণে। আগ্রজের গল্প কাব্য প্রধান। সাগর সে ক্ষেত্রে কাব্যভাষায় গল্পে ফিরতে পেরেছেন। গল্পের চরিত্রগুলোকে শেষাংশে একটি বিন্দুতে এনে পূর্ণতা দিয়েছেন। ‘হাতঘড়ি খুঁজতে থাকলাম। আমরা তো ইদানিং হাতঘড়ি ব্যবহার করি। ঘড়ি পেলাম। ঘড়ির কাঁটা চলছে না। ঘন্টার কাঁটায় জয়নব বসে আছে। এক জয়নবের ভেতরে চার জয়নব। আবার কখনো জুলেখা হা করে আকাশের চোখে চোখ রেখে বসে আছে আবার কখনো দেখেছি একটি সরু রাস্তা। একা একা হাঁটছে। যার শেষ প্রান্তে একটা মান্দার গাছ দাঁড়িয়ে ছয় হাতে আমাদেরকে ডাকছে... ডেকেই যাচ্ছে...’

‘চোখ’ গল্পটি সরলরৈখিক। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় চরিত্রটিকে নিয়ে কল্পনায় স্মৃতিমন্থন। গল্পের শুরুতে ঢাকা শহরে অফিস ফেরত ক্লান্ত মানুষের একটি চিত্র। ধানমন্ডি থেকে গন্তব্য মিরপুর ১২। জানালার পাশের সিটে বসে জ্যামের বিরক্তি আর শহরের ডাস্টবিনের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে ঘুমিয়ে নেয়াটাই মোক্ষম মনে হলেও পাশের স্বাস্থ্যবান লোকের অনর্গল পা নাড়ায় সেটা আর সম্ভব হয়না। বরং ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে নেয়া যায় নিজেকে। ভাবনার মধ্যে একটি পরিচিত ঘ্রাণ ফিরিয়ে নেয় অথইর কাছে। সামনের সিটে বসা মেয়েটির দিক থেকেই ঘ্রাণটা আসছে। কিন্তু এই বাসে অথই! হিসেবটা মিলে না। ভাবনারা এগিয়ে যেতে থাকে। দৃশ্যমান হতে থাকে ফেলে আসা দশটি বছর! ভাবনার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া। হঠাৎ কন্টাকটরের চিৎকারে ঘুম ভেঙে নাটকীয়তায় প্রায় চলন্ত বাস থেকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে তালতলা নেমে পড়া। ‘তালতলা! যেন আমার চোখ সীমা ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছে। আর আমার নাকে লেগে থাকা স্মেল আরো ভেতরে, খুউব ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমি দৌড়াচ্ছি। ঘ্রাণের সম্ভাব্য ঠিকানার দিকে। আমার যেন কোন চোখ নেই। আমার চোখহীন চোখ নিয়ে ভেজা দেহটা দৌড়াচ্ছে। বৃষ্টি আরো বাড়ছে। মনে হচ্ছে অথইয়ের চোখের পানি আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। অথই কাঁদছে। আর দুই চোখে আগুন নিয়ে একটি আকাশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে...’

‘আগুন’ গল্পটি স্বপ্নহারা এক নারী মাইরুমির। বজলুর সাথে বিয়ে হলেও সংসার ঠিক হয়ে উঠেনা। নিঃসন্তান হবার সমস্ত দায়ভার কোন রকম পরীক্ষা ছাড়া তাকেই নিতে হয়! ঘরে আগুন লাগলে জ্বরগ্রস্থ স্বামী পুড়ে মরলে সন্তানহীন-স্বামী নির্যাতিতা মাইরুমি যেন মুক্তি পায়। ভাইয়ের সংসারে ফিরে আসে। প্যারালাইস মা আর ভাইয়ের যতœ নিতে নিতে তার দিন কেটে যায়। নিঃসঙ্গ জীবনে সঙ্গ পায় রতনের। তার ভেতরে তৈরি হয় রতনপুর। টের পেয়ে রতন পালিয়ে যায়। আগুন তার জীবনকে বারবার উল্টেপাল্টে দেয়! শেষবারের মতো যখন মোল্লাবাড়িতে আগুন লাগে, সবাই যখন সেই আগুন নিভাতে ব্যস্ত মাইরুমি তখন অন্য আগুনে পুড়তে থাকে। বাবুল বাড়ি ফিরে টের পায় পেয়ারা গাছে অনেক আগুনে অজানা সুখে উড়ছে মাইরুমি...

আত্মমগ্নতার পাঠে নিজেকে উম্মোচনের গল্প ‘জানালা’। জানালার বাহিরে একটি অজানা পাখির সলুক সন্ধান করতে করতে উড়ে আসে আরেকটি পাখি। পাখিদের ভাষা আয়ত্ত করার চিন্তার ভেতরে বিড়াল ঢুকে ভেঙে ফেলে কাচের গ্লাস। ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগুলো উম্মোচন করে জীবনের গূঢ়তত্ত্ব!

একজন লেখকের লিখতে না পাড়ার যন্ত্রণার ভেতরে বেড়ে ওঠে ‘গল্পের ঠিকানা’। একজন খ্যাতিমান লেখকের বিরম্বনা, মার্কেট ভ্যালুকে পুঁজি করে ছাইপাশ ছাপানো কাগজ, বর্তমান সাহিত্যের হাল হাকিকত, বাংলা কবিতার দিকভ্রান্ত যাত্রার আক্ষেপ নিয়ে তৈরি হয় গল্পের প্লট। ব্যক্তি জীবন, বিগত চরিত্রগুলো গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠে, বিচ্ছিন্নতার ভেতরে সেতু তৈরি করে মায়া! এই মায়ার কাছে নত হতে হতে হারিয়ে যাওয়া গল্পরা ফিরে আসে...

বিদেশ থেকে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসা এক হতাশাগ্রস্থ যুবকের বেঁচে থাকার লড়াইকে কেন্দ্র করে ‘মজনু’ গল্পের শুরু হলেও গল্পটি বাঁক বদল করে। বাল্যবন্ধু শুক্কুরের সাথে দেখা হলে অন্য এক জীবনের সন্ধান পায় মজনু। গাঁজা ও চানপুরা হোটেল তাকে নেশায় জড়িয়ে রাখে। গল্পের শরীর জুড়ে মজনুর যৌন জীবন বর্ণিত হলেও গল্পটি যৌনতার নয়। নিম্নবিত্তের বঁচে থাকার লড়াই ও যৌন অবদমনের চিত্র আঁকতে গিয়ে যৌনতাকে লিড করেছেন।

বইয়ের সর্বশেষ নামগল্প ‘লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হবার পর’। বিষয় ও পাঠ সংযোগ গল্পটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। লেখক জীবনের অভিজ্ঞতালবব্ধ গল্প। জীবনের গল্প বলতে বলতে অজানা সত্যের সামনে পাঠক দাঁড়িয়ে পড়েন! গল্পটি বাস্তবতা ছাড়িয়ে কাব্যময় এক জগতের দিকে যাত্রা কিন্তু এর স্থান, ঘটনার পরম্পরা, খুলে দেয়া গোপন দরজাগুলো সত্যের কাছাকাছি থেকে যায়। লেখকের ছাত্রাবাসের বন্দি নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র বন্ধু সীমান্ত। মাদ্রাসা আর বাহিরের জগৎ-দুইয়ের মাঝখানে কাঁটাতার হয়ে থাকে কতগুলো কঠোর নিয়ম। নিয়ম ভাঙতে সব অভিনব কৌশল আবিস্কার হয়! কঠোর জীবনের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এক রহস্যর ভেতরে ঢুকে পড়ে দুই বন্ধু। কৃত্তিপাশা জমিদার বাড়ি দেখতে গিয়ে লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হয় লেখকের। আর সীমান্ত নিষিদ্ধ বইয়ের হাতছানিতে প্রেমিক বনে যান তসলিমার! সেই সর্বনাশের শুরু। লেখক নিজের ভেতর একটি কল্পনার জগৎ তৈরি করেন- সেখানেই তার বিচরণ। লাবণ্য দাশের কল্পনা তাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। গল্পে দৃশ্যমান হতে থাকে- মাদ্রাসার কঠোর নিয়ম, নিয়মের ভেতরের অনিয়ম, ছাত্র বলাৎকার, নিষিদ্ধ বইয়ের গোপন কালেকশন আর লাবণ্য দাশ। লাবণ্য দাশ তাকে এতটা মোহগ্রস্থ করে রাখে যে সবাই সন্দেহ করা শুরু করে। মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে খবর পাঠানো হয়-তাকে পরীতে পেয়েছে। মাদ্রাসা থেকে মুক্তি পেলেও লাবণ্য দাশ তাকে মুক্তি দেয়না! জীবনানন্দ ঘোরগ্রস্ত এক যুবকের লাবণ্য দাশের প্রেমে পড়া...

রহস্য ও গল্পের ফাঁদে মোহগ্রস্থ হয়ে থাকি। কোলাহল কমে চারদিক নিরব হয়ে আসে। সবাই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে... লঞ্চের পর্দা ঠেলে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ছে। আমারও অল্প অল্প শীত করছে। চাঁদরটা জড়িয়ে নিতে নিতে টের পাচ্ছি আমারও ঘুম আসছে। লাবণ্য দাশ আবার আমার স্বপ্নে ভড় করবেন নাতো...!

দশটি গল্পের সংকলনগ্রন্থ ‘লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হবার পর’। নানামুখী গল্পে বিষয় বৈচিত্রের সাথে সাথে আছে ভাষা বৈচিত্র। শিল্পর পাশাপাশি সমাজের দায়বদ্ধতাকে স্মরণে রেখেছেন। ব্যক্তি অস্তিত্ব প্রধান গল্পের ভেতরে নিখুতভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সমাজ, রাজনীতি, দর্শন। শুধু গল্প পাঠের আনন্দ নয়, পাঠককে অস্তত একটি ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন। সাগরের কৃতিত্ব এই যে, লেখকের দায়বদ্ধতা কখনো গল্পকে স্থুল করে তুলেনি।

তুলির একটানে ক্যানভাস আঁকার মতো শিল্পী নন তিনি। ছোট ছোট ইমেজ তৈরি করে করে একটি ক্যানভাস আঁকেন। একটি ক্যানভাসে একাধিক ইমেজ, প্রতিটি অবিচ্ছেদ্য কিন্তু স্বতন্ত্র রূপ আছে। সবগুলো মিলে একটি পরিপূর্ণ ক্যানভাস আঁকার মতো লেখক ছোট ছোট ইমেজ তৈরি করে খুব ধীরে গল্পকে নিয়ে যান পরিণতির দিকে। গল্পের মেদ নেই, বাক্যের আধিক্য নেই, বয়ানের ধারাবাহিকতায় পাঠ বিচ্যুতির সুযোগ নেই।

(কবি-সম্পাদক অনিন্দ্য দ্বীপ -এর পাঠপ্রতিক্রিয়া)

ঘরে বসে সংগ্রহ করতে চাইলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
https://www.rokomari.com/.../labonyo-dasher-sathe-dekha...
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:৪০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার ১৫ বছর

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:১৭

১৫ বছর পূর্তির এই পোস্টটা যখন লিখছি, তখন আমি একটা বড় পারিবারিক দূর্বিপাকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার ছোটভাইয়ের কনিষ্ঠ পুত্র, যার বয়স ১১ মাস, সে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

জিম্মি বিনিময়ের সুনামে হামাস দেশ ত্যাগ করলে, ফিলিস্তিনের জন্য ভালো হতো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫৬



হামাস জিম্মি/বন্দি বিমিয়মে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে: তারা নেতানিয়াহুর সামরিক নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা, অসফলতা ও বিশ্বের চাপকে কাজে লাগিয়ে, জিম্মি বিনিময়ের কন্ট্রোল নিজের হাতে রেখেছিলো। তারা জিম্মিদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিব্যক্তি

লিখেছেন আরোগ্য, ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:০০





১. অদ্ভুত মোহ মায়ার জগৎ এটা। সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে জেনেও বারবার আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টায় রত থাকি। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে কেউ আর বেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতা কিংবা বচন-২

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:২৪

আগের বচনগুলোর লিংক :

১। অম্লতিক্ত অপ্রিয় সত্যাবলি

২। অম্লবচন-১

৩। অম্লবচন-২

৪। অম্লবচন-৩

৫। রম্যমধুর অম্লবচন

৬। অম্লবচন মধুরবচন - আমাদের মন ও মানবতা

৭। কবিতা কিংবা বচন

নিঠুর পৃথিবী

আমি এক আলাভোলা ঘরকুনো প্রেমখোর বাঁদর
ভালো লাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদিন প্রেম খুলবে স্বর্গ দ্বার।

লিখেছেন সামরিন হক, ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ২:০৪

একদিন অভিমানি সব চোখ,জলে ভরে উঠবে ।
একদিন তোমারআমার ক্ষোভ ওপারে ফিরবে ।

২৫শে জুলাই ২০২০

একদিন আধাঁর ,আলোকিত করবে সব বোধ।
একদিন তোমারআমার হাসি ,আকাশের নেবে কোল।

২৮শে জুলাই ২০২০

একদিন ধু ধু মরুভূমি ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×