somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাও বনাম ‘মাওবাদ’ (২)

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সংসদ বয়কট, গণপতির অর্ধেক লেনিনপাঠ

শান্তনু দে


‘সংসদকে শূয়োরের খোঁয়াড়’ বলেছিলেন লেনিন। বলেছিলেন, ‘স্রেফ বাজে বকবক করার বাজার ছাড়া কিছু নয়।’
চারু মজুমদাররা বলতেন। এখন গণপতিরা বলছেন।
কিন্তু লেনিন কখন একথা বলেছিলেন?
যে ডুমা (সংসদের রুশ নাম) লেনিনের মূল্যায়ণে ‘আদৌ কোনও সংসদ ছিল না’।
তাছাড়া, লেনিন তখনই সংসদ বয়কটের কথা বলেছিলেন, যখন জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ, ধর্মঘটে উত্তাল গোটা রাশিয়া।
জার জমানা তখন আক্ষরিক অর্থেই রাজতন্ত্র। সমস্ত আইনী ও প্রশাসনিক ক্ষমতাই কেন্দ্রীভূত জারের হাতে। ‘বলশেভিকরা বয়কট করার ফলে যে পুরনো ‘আলোচনা সভা’ ‘বুলিগিন ডুমা’ অপসৃত হয়ে গিয়েছিল, তার পরিবর্তে নতুন, আইন প্রণয়নী ডুমা আহ্বান করা সম্পর্কে ১৯০৫সালের ডিসেম্বর মাসে জার-সরকার এক আইন জারি করে। জারের নির্বাচনী বিধিগুলি অবশ্যই ছিল গণতন্ত্র-বিরোধী। ছিল না সর্বজনীন নির্বাচন প্রথা। লোকসংখ্যার অর্ধেকের বেশি — যেমন, মহিলা ও ২০লক্ষের বেশি শ্রমিক — একেবারেই ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। নির্বাচনে ছিল না কোনওরকম সমান অধিকার।...ছিল না প্রত্যক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচন হতো কয়েকটি স্তরের মধ্যে দিয়ে। কার্যত গোপন ‘ব্যালট’ ভোটের ব্যবস্থা ছিল না।’১
তাছাড়া, ‘জারের মতলব ছিল, জনগণকে বিপ্লব থেকে সরিয়ে আনার জন্য ব্যবহার করা যাবে ডুমাকে। সেসময় কৃষকদের অনেকে বিশ্বাস করত, তারা ডুমার মধ্যস্থতায় জমি পাবে।...জনগণকে এই প্রতারণার প্রভাব থেকে উদ্ধার করার জন্যই বলশেভিকরা প্রথম স্টেট ডুমা বয়কট করার সিদ্ধান্ত প্রচার করে। এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে।’২
১৯০৬এর জানুয়ারি। মেনশেভিকরা বলছেন, নির্বাচনে পার্টির অংশ নেওয়া উচিত। অন্যদিকে, বলশেভিকরা ‘ডুমাকে সক্রিয় বয়কটের’ পক্ষে সওয়াল করে চলেছেন। এসময়ে বলশেভিকদের উদ্দেশে এক লিফলেটে লেনিন বললেন, এই ‘ডুমা আদৌ সংসদ নয়, এটি স্বৈরতন্ত্রের একটি ফন্দি মাত্র। নির্বাচনে কোনওরকম অংশ না নিয়ে এই ছলচাতুরিকে আমাদের বেআব্রু করে দেওয়া উচিত।’৩
লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়, লেনিন বলছেন, এই ‘ডুমা আদৌ সংসদ নয়’। ‘স্বৈরতন্ত্রের একটি ফন্দি মাত্র’।
তাই বলে কি বরাবররের জন্য বয়কট?
আদৌ না। মেনশেভিকদের উদ্দেশে ওই লিফলেটে লেনিন আরও লিখছেন, ‘মেনশেভিকদের যুক্তি হলো, পৃথিবীর সব দেশে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা সংসদে অংশ নিচ্ছে, এমনকি খারাপ সংসদেও। এটি অসত্য যুক্তি। আমরাও সংসদে পুরোপুরি অংশ নেব। তবে মেনশেভিকদেরও নিজেদের বুঝতে হবে, এই ডুমা আদৌ একটি সংসদ নয়।’
লক্ষ্য করার মতো কথাটা হলো, লেনিন সেদিনই বলেছেন, ‘আমরাও সংসদে পুরোপুরি অংশ নেব।’
বলশেভিকরা সাফল্যের সঙ্গে এই ডুমাকে বয়কটের পক্ষে প্রচার-আন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রথম ডুমাকে বয়কটের ডাক সেসময়ের বিপ্লবী সম্ভবনার জন্য নিশ্চিতভাবেই ছিল একটি সফল রণকৌশল। পুরনো জমানার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তখন চলছে সশস্ত্র অভ্যুত্থান। সেসময় আরও একটি স্থিতিশীল সময়ের জন্য সংসদীয় কৌশলের ওপর ভরসা রাখা হতো চরম ভ্রান্তি।
লেনিনের কথায়, সেসময়ের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছিল, ‘বয়কটই একমাত্র নির্ভুল পথ, এবং তা ঘটনা দ্বারা প্রমাণ হয়েছিল।’
এই বয়কটে সাফল্যের কারণ কী?
এই বয়কট শুধু ‘জারের হুকুমমাফিক, নিয়মমাফিক, নিয়মতান্ত্রিকতার পথে চলার বিপদ সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক করে দেয়নি, এটি ডুমার অধিবেশনকেই বাতিল করে দিয়েছিল। বয়কট সফল হওয়ার আরও কারণ হলো, বিপ্লবের জোয়ার যখন বেড়ে চলেছে, তখন বয়কট আন্দোলন সেই স্রোতের ক্রমবর্ধমান বেগ থেকে সাহায্য পেয়েছিল। বিপ্লবের প্রবাহে তখনও ভাটা পড়েনি। বিপ্লব যখন উজান বেয়ে চলছে, তখনই ডুমার অধিবেশনকে বাতিল করা সম্ভব ছিল।’৪
১৯০৬, বিপ্লবী অভ্যুত্থান তখন ধীরে ধীরে ক্ষীণ ও নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। গ্রামের কৃষকরা ক্রমশ আকর্ষণ হারাচ্ছেন এই আন্দোলনের প্রতি। সেদিন বলশেভিকরা যদিও পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হন। ভাবেন আবারও বিপ্লবী গণআন্দোলনের পুনরুজ্জীবন হবে। এবং আবারও তাঁরা ডুমা বয়কটের ডাক দেন। এবারে দ্বিতীয় বয়কটের ডাক ব্যর্থ হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ডুমা।
যে লেনিন প্রথম ডুমা বয়কটের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন, সেই লেনিনই কিন্তু দ্বিতীয় ডুমা বয়কটের নীতি ‘পুনর্বিবেচনা’ করার কথা বলেন।
কেন?
‘পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় ও বিপ্লব অবসন্ন হয়ে পড়ার দরুন।’
‘শূয়োরের খোঁয়াড়’ জেনেও, দ্বিতীয় ডুমা সম্বন্ধে লেনিনের মত ছিল, পরিস্থতি বদলে যাওয়ায় ও বিপ্লব অবসন্ন হয়ে পড়ার দরুন বলশেভিকদের ‘নিশ্চয়ই স্টেট ডুমা বয়কট করার নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।’৫
পরে ‘বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ পুস্তিকায় লেনিন নিজে বলেন, ‘১৯০৬এ ডুমা-বয়কট ভুল হয়েছিল, যদিও এই ভুল সাঙ্ঘাতিক হয়নি এবং সহজেই এই ভুল সংশোধন করা গিয়েছিল।’
লেনিনের কথায়, ‘ব্যক্তির সম্বন্ধে যা খাটে, তা দরকারী অদলবদল করে নিয়ে — রাজনীতি সম্পর্কেও খাটে। যে কখনও ভুল করেনি সে-ই জ্ঞানী, এমন কোনও কথা নেই। সংসারে ভুল করে না এমন লোক নেই, থাকতে পারে না। যে খুব গুরুতর কোনও ভুল করে না, এবং ভুল করলে সহজে ও শীঘ্র তা সংশোধন করে নিতে পারে, সে-ই হলো জ্ঞানী।’
এরপর জার সরকার বোঝে ডুমাকে ভেঙে দিতে হবে। গঠন করতে হবে এমন কিছ, যা অনেক বেশি বিশ্বস্ত।
১৯০৭এর ৩জুন, জার সরকার ভেঙে দেয় ডুমাকে। গ্রেপ্তার করে শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিদের। পুরে দেয় জেলে।
বলশেভিকদের একটি বড় অংশ তৃতীয় ডুমার নির্বাচনও বয়কটের ডাক দেয়। লেনিন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বলশেভিকরা বয়কটের বিরোধিতা করেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নির্বাচনে। কয়েকজন নির্বাচিতও হন। তৃতীয় ডুমা থাকে ১৯১২পর্যন্ত, যখন চতুর্থ ডুমার নির্বাচনের কথা ঘোষণা করা হয়, যা ছিল ১৯১৭’র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত।
তৃতীয় ডুমা জার জমানার ইচ্ছেকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছে জেনেও কিন্তু চতুর্থ ডুমার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লেনিন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বলশেভিকরা।
কেন? সংসদের প্রতি কোনও মোহ থেকে?
গণপতিরা কি তাহলে বলশেভিকদের ঘোর সংশোধনবাদী বলবেন? লেনিনকে কি মাওবাদীরা বলবেন ‘সংশোধনবাদের পান্ডা’?
না কি লেনিন ‘পার্লমেন্টারি ক্রেটিনিজিম’ অর্থাৎ পার্লামেন্টারি সংগ্রামই হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রামের একমাত্র ও সব অবস্থায় প্রধান রূপ — এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন?
লেনিন কি জানতেন না ‘জার্মানিতে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’ নামক রচনায় এঙ্গেলস বলছেন, ‘পার্লমেন্টারি ক্রেটিনিজিম হলো চিকিৎসাতীত একটি রোগ, এক ব্যাধি’?
বরং, বিলক্ষণ জানতেন। এই লেনিনই ‘পার্লমেন্টারি ক্রেটিনিজিম’কে তীব্র কষাঘাত করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। সঙ্গে এও বলেছেন, নীতি হিসেবে বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে বয়কট করা চলবে না, যেখানেই সম্ভব সেগুলিকে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামকে শক্তিশালী করার কাজে, সেগুলির শ্রেণী চরিত্র উদ্ঘাটন করার কাজে ব্যবহার করতে হবে। মূল আন্দোলনের নিচে স্থান দিয়ে তাকে সংগ্রামের সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, তা না করলে মারাত্মক ভুল হবে।
তৃতীয় ডুমা জার জমানার ইচ্ছেকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছে জেনেও, সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে মনে রেখেই যথেষ্ট জেনেবুঝে চতুর্থ ডুমার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লেনিন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বলশেভিকরা।
তাঁদের পত্রিকা প্রাভদা লেখে, ‘ডুমা তার তাবৎ কাজকর্মই করেছে তার শ্রেণীস্বার্থের সংখ্যাগরিষ্ঠের দিকে তাকিয়ে। সেকারণে এই পাঁচ বছরে ‘দক্ষ’ ডুমা কোনওভাবেই দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জরুরী প্রশ্নগুলিকে সমাধানে কোনওভাবেই সহযোগিতা করেনি। বামপন্থী দলগুলির সমস্ত প্রচেষ্ঠা, প্রশ্নোত্তর পর্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের প্রশ্ন করা থেকে রুশ জনজীবনের অন্ধকার দিকগুলিকে আলোকপাত করা, দেশের প্রতি নজর ঘোরানোর কাজ ব্যহত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে।’
গণপতি, আপনার কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘সংসদে যেতে ও বিষয়গুলিকে উত্থাপন করতে কেন আপনারা নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেন না?’
পুরানো পিপলস ওয়ার গোষ্ঠী ও মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র মিলিত হয়ে ‘ঐক্য কংগ্রস’ থেকে সি পি আই (মাওবাদী) তৈরি হওয়ার পর বি বি সিসহ একাধিক সংবাদপত্রের বহু প্রশ্নের সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনি এই প্রশ্নটিরও জবাব দিয়েছেন।
আপনার দাবি, ‘তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রের একমাত্র বাইরের খোলসকেই যাঁরা শুধু দেখেন, তাঁদের কাছে নিশ্চিতভাবেই এটি একটি সঙ্গত প্রশ্ন। শুধু গঠন নয়, যেটা গুরুত্বপূর্ন তা হলো, এর মর্মবস্তু, এর নির্যাস, এর সারমর্ম। যখন আপনি গণতন্ত্রের বাইরের পোশাককে বিবস্ত্র করবেন, তখন আপনি দেখবেন এর মধ্যে রয়েছে পচা, দুর্গন্ধময় ফসল। যেকারণে লেনিন সংসদকে বলেছিলেন শূয়োরের খোঁয়াড়, স্রেফ বাজে বকবক করার বাজার ছাড়া কিছু নয়।’
ঠিকই বলেছেন।
কিন্তু দেশের আমজনতা কি তাই মনে করছেন?
মুলাপ্পা লক্ষণ রাও ওরফে গনপতি, আপনি যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন বলে দাবি করেন, সেই শ্রেণী কি তাই মনে করছে? বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাঁরা কি আপনার মতোই পুরোদস্তুর ওয়াকিবহাল?
আপনি লেনিনের কথা বলেছেন।
লেনিনের শিক্ষা কী?
‘আমাদের কাছে যা অচল তাকে শ্রেণীর পক্ষে অচল, জনসাধারণের পক্ষে অচল ভাবা কিছুতেই চলতে পারে না।’৬
এই ‘আমরা’ কারা? শ্রেণীর অগ্রণী অংশ।
লেনিন বলেছেন, ‘বামপন্থীরা’ (জার্মানির বামপন্থী কমিউনিস্টরা) জানে না, কিভাবে শ্রেণীর পার্টিকে জণসাধারণের পার্টি হিসেবে বিচার করতে হয়, কাজ করতে হয়। জনসাধারণের স্তরে, শ্রেণীর পশ্চাৎপদ অংশের স্তরে আমাদের নেমে এলে চলবে না — এবিষয়ে কোনও মতভেদই থাকতে পারে না। তাদের অতি তিক্ত সত্য শোনাতে হবে। তাদের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক, পার্লামেন্টারি কুসংস্কারকে — কুসংস্কারই বলতে হবে। কিন্তু সেইসঙ্গে ধীরস্থিরভাবে আমাদের লক্ষ্য হবে সমগ্র শ্রেণীর (শুধু এর অগ্রগামী কমিউনিস্টদের নয়), সমগ্র জনগণের (কেবলমাত্র তাদের অগ্রগামী অংশের নয়) শ্রেণী-চেতনা ও প্রস্তুতির প্রকৃত অবস্থাকে।’৭
লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়, লেনিন বলছেন, ‘সমগ্র শ্রেণী’, ‘সমগ্র জনগণের’ ‘শ্রেণী-চেতনা ও প্রস্তুতির প্রকৃত অবস্থা’র কথা। ‘শুধু এর অগ্রগামী কমিউনিস্টদের’ কিংবা ‘কেবলমাত্র তাদের অগ্রগামী অংশের’ কথা নয়।
গণপতি, মনে রাখবেন অর্ধেক লেনিন পড়া বিপদজনক।
কারণ, এই লেনিনই পরে রাশিয়াতে সংসদে যোগ দেওয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বুর্জোয়া পার্লামেন্টে কমিউনিস্টদের অংশগ্রহণ করা সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের পার্টির ভুল ধারণা তিনি সংশোধন করে দিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টিগুলি যাতে বুর্জোয়া পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করার কাজ বর্জন না করে, তার জন্য লেনিন তৃতীয় আন্তর্জাতিকে কর্তব্য নির্ধারণের সময় লিখেছিলেন, ‘(কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এবং তা হবে ব্যতিক্রম) কোনও অবস্থাতেই পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা ও কাজকে এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সমস্ত ‘স্বাধীনতাকে’ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা চলবে না, সেগুলিকে প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী শ্রেণীসংগ্রামের উপজাত হিসেবেই শুধু দেখতে হবে।’
লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়, লেনিন বলছেন, ‘সেগুলিকে (পার্লামেন্টকে) প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী শ্রেণীসংগ্রামের উপজাত হিসেবেই শুধু দেখতে হবে।’
অস্ট্রিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি তখন দেশের বুর্জোয়া পার্লামেন্ট বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লেনিন তাদের ভুল সংশোধন করার জন্য অস্ট্রিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিকে চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠিতে লেনিন কমিউনিস্ট পার্টি কেন বুর্জোয়া পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করবে, সেখানে পার্টি সদস্যদের কাজ কী হবে, সেকাজ কিভাবে সম্পন্ন করতে হবে, তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
জার্মানির স্যোশাল ডেমোক্র্যাটরা যখন প্রায় আপনাদের মতোই সেদেশে সংসদে যোগ দেওয়ার আপত্তি করেছিলেন, তখন এই লেনিনই তাঁদের তীব্র সমালোচনা করে সংসদে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভুল দেখিয়ে দিয়েছিলেন ‘বামপন্থী ডাচ’ কমিউনিস্টদের।
জার্মানির ‘বামপন্থী’ কমিউনিস্টদের ভুল সংশোধন করে দিয়ে লেনিন লিখছেন, পার্লামেন্টারি রাজনীতি ‘ঐতিহাসিক দিক দিয়ে অচল’ হয়ে গিয়েছে — প্রচারের পক্ষে এটি ঠিক। কিন্তু সকলেই জানে যে, কার্যক্ষেত্রে একে ঘায়েল করা এখনও অনেক বাকি। অনেককাল আগে অত্যন্ত ন্যয়সঙ্গতভাবেই পুঁজিবাদকে ‘ঐতিহাসিক দিক দিয়ে অচল’ বলে ঘোষণা করা চলত। কিন্তু তাতে পুঁজিবাদের মাটিতেই দীর্ঘকাল ধরে, ধারাবহিকভাবে লড়াই চালানোর প্রয়োজন মোটেই ফুরোয়নি।
আপনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যবস্থাটাই বড় প্রহসন, আর এজন্য কোনও ব্যাখ্যারই দরকার নেই, এমনকি স্কুলছাত্রও তা জানে। যেখানে মদ, টাকা, জাতের নির্দেশ, ধর্ম এবং জাতিগত ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোট কেনা হয়, তাকে কি আপনি গণতন্ত্র বলতে পারেন? এমনকি নির্বাচনের পরেও আপনি কিনতে পারেন সাংসদ, বিধায়কদের, বাজারের অন্যান্য পণ্যের মতোই। গুজরাটে হাজারো মুসলিমের গণহত্যার কসাই নরেন্দ্র মোদি যদি নির্বাচনে জিততে পারেন, যদি অপরাধীরা, ডাকাতার, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ কুখ্যত রাজনীতিবিদরা জিততে পারেন, যদি বুথ দখল করে বন্দুকের মুখে ভোট দখল করা হয়, তবে আপনি কি সত্যিই মনে করেন, তথাকথিত এই গণতন্ত্রের কোনও অর্থ রয়েছে?’ সঙ্গে আরও বলেছেন, ‘সংসদ হলো বুর্জোয়াদের সেফটি ভালভ, মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করতে তারা ব্যবহার করে সংসদকে।’
‘নির্বাচনের ব্যবস্থাটাই বড় প্রহসন’ — গণপতি, আপনি বুঝেছেন আপনার অভিজ্ঞতায়।
কিন্তু ‘লক্ষ লক্ষ মানুষ’?
তাঁদের উপলব্ধি কি আপনার মতোই?
আপানার দাবি, ‘এজন্য কোনও ব্যাখ্যারই দরকার নেই, এমনকি স্কুলছাত্রও তা জানে।’
সত্যিই কি তাই? আপনি কি নিজেও তাই মনে করেন? যদি তাই হতো, তাহলে তো কাল সকালেই বিপ্লব।
তাছাড়া, আমাদের দেশের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই মূল্যায়ণের কি কোনও মিল আছে?
গণপতি, আপনি বলেছেন, ‘জনগনের মধ্যে এখন ও পরে তাদের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে তারা (সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলি) কিছু করে, তবে অবশ্যই, তা কিছু প্রসাধনী পরিবর্তন মাত্র।’
অর্থাৎ কোনও মৌলিক পরিবর্তন নয়, এমনটাই বলতে চেয়েছেন আপনি। এবং ঠিকই বলেছেন।
কিন্তু, সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ‘তাদের প্রতি’ যে ‘বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে’ চায়, তা কি এখনও পর্যন্ত তারা রাখতে পেরেছে? আপনি কিছু বলেননি। যদি বলতেন, তাহলে বলতে হতো — হ্যাঁ, অন্তত এখনও পর্যন্ত অনেকটাই তারা রাখতে পেরেছে।
নির্বাচনের সময় আমরা কী দেখি? দেশজুড়ে প্রায় সব সাধারণ মানুষই ভোটের লাইনে। পশ্চিমবাংলা, কেরালা, ত্রিপুরাতেও প্রায় ৮০-৮৫ভাগ মানুষ ভোট দেন। বাইরের রাজ্যগুলিতে ভোট পড়ে প্রায় ৬০ভাগের মতো।
লেনিনের শিক্ষা কি?
লেনিন আমাদের শিখিয়েছেন, ‘কথাটা এই নয় যে, অগ্রণী অংশ পুরনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার সম্ভবতা বা তার উচ্ছেদের অনিবার্যতা বুঝছেন কি না? কথাটা এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অনিবার্যতার কথা বুঝতে পারছেন কি না এবং অগ্রণী অংশকে সমর্থনে তাঁরা প্রস্তুত কি না?’
গণপতি, আপনি লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়, লেনিন ‘লক্ষ লক্ষ মানুষের’ কথা বলেছেন।
সঙ্গে লেনিন আরও বলেছেন, ‘জনগণের এই উপলব্ধি কেবলমাত্র তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে আসতে পারে।’ অর্থাৎ, গণপতি শুধু আপনার কথায় ‘জনগণের এই উপলব্ধি’ আসবে না। আসবে ‘কেবলমাত্র তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে’।
এবং এখানেই না থেমে লেনিন টেনে এনেছেন রাশিয়ার বিপ্লবের ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকে। বলেছেন, ‘রাশিয়ার বিপ্লবের ইতিহাস স্পষ্টই দেখিয়ে দিচ্ছে শ্রমিকশ্রেণী, কৃষক, ক্ষুদ্র অফিস কর্মচারীর বিপুল অংশ কোনও যুক্তিতেই সন্তুষ্ট হন না, যতক্ষণ না তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা তাদের উপলব্ধি ঘটাচ্ছে।’
গণপতি, আপনি যাকে ‘সেফটি ভালভ’ বলছেন, মানুষের কাছে তা আদৌ ‘সেফটি ভালভ’ নয়। বরং তার ওপর দস্তুরমতো মানুষের ভরসা আছে। আর সঠিক লেনিনবাদে শিক্ষিত হলে, সংসদকে ব্যবহার করেই এই ‘সেফটি ভালভে’ আঘাত হানার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত।
জার্মানির তথাকথিত বাম কমিউনিস্টরা সংসদ রাজনৈতিকভাবে অনাবশ্যকীয় হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করলে লেনিন ‘বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ পুস্তিকায় দেখিয়েছেন, ঐতিহাসিকভাবে, বিশ্ব ইতিহাসের মানদন্ডে যা অনাবশ্যক, তা বাস্তবের রাজনীতিতে তখনই অনাবশ্যক বলে চালাতে যাওয়া ‘চিৎকৃত তাত্ত্বিক ভ্রান্তি’ মাত্র। জার্মানির তথাকথিত বাম কমিউনিস্টদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে লেনিনের জিজ্ঞাসা, ‘আপনারা বলছেন সংসদ বুর্জোয়াদের লোক ঠকানোর হাতিয়ার। আবার এই যুক্তিকেই আপনাদের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। সংসদের প্রকৃত চরিত্র বুর্জোয়াদের দ্বারা প্রতারিত প্রকৃতিই পিছিয়ে পড়া জনগণকে আপনারা কীভাবে বোঝাবেন? যদি সংসদের বাইরেই থাকবেন, তবে বিভিন্ন দলের স্বরূপকে আপনারা কীভাবে উন্মোচিত করবেন?’
‘যদি মার্কসবাদী হন তাহলে নিশ্চয় স্বীকার করবেন ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণীগুলির সম্পর্ক এবং দলগুলির সম্পর্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। আমি আবারও বলছি যদি সংসদে না থাকেন, সংসদীয় কাজকর্মকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে এসব দেখাবেন কী করে?’ জিজ্ঞাসা খোদ লেনিনের।
গণপতি, আপনারা যদি সংসদেই না থাকেন, তবে কী করে মানুষকে বোঝাবেন ‘সংসদ হলো বুর্জোয়াদের সেফটি ভালভ, মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করতে তারা (বুর্জোয়ারা) ব্যবহার করে সংসদকে।’
লেনিন কী বলছেন? লেনিনের শিক্ষা কী?
লেনিনের ঘোষণা, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনারা (জার্মান স্যোশাল ডেমোক্র্যাটরা) বুর্জোয়া পার্লামেন্ট এবং অন্যান্য সমস্ত ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানকে পর্যুদস্ত করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের অতি অবশ্যই তাদের মধ্যে কাজ চালাতে হবে। কারণ, ঠিক সেখানেই এখনও পুরুতদের ভাঁওতাবাজিতে বিভ্রান্ত ও গ্রাম্য জীবনের একঘেয়েমিতে ক্লান্ত শ্রমিকদের দেখা যাবে। নইলে আপনাদের নিছক বাক্যবাগীশ হয়ে দাঁড়াবার সম্ভাবনা থেকে যাবে।’৮


১. সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস
২. সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস
৩. ‘সুড উই বয়কট দি স্টেট ডুমা?’, ১৯০৬, জানুয়ারি। লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস,প্রোগ্রেস পাবলিশার্স,
১৯৬৫ মস্কো থেকে প্রকাশিত। দশম খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৭-১০০
৪. সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস
৫. লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস, রুশ সংস্করণ
৬.বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা
৭.বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা
৮.বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা


৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×