somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালোপরী

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঘুমাবার সময় প্রতি রাতে সামিনাকে একটা গল্প বলতে হয়। না হলে নাকি তার ঘুম আসে না। সেই কবে স্কুলে থাকতে এক টিচার সবাইকে দিয়ে গল্প লিখিয়ে আনতেন। সবার চাইতে বেশি নম্বর পেতাম, কারণ আমার গল্প একেবারে অরিজিনাল, কেউ কোথাও খুঁজে পেত না। একবার এক ছেলে ধরল, ওকে সিক্রেটটা বলতে হবে, কোথায় আমার লাইব্রেরি। কিছুতেই বিশ্বাস করল না ওগুলো সব নিজের লেখা। এমনকি স্যারও কিছুদিন সন্দেহে ছিলেন, কিন্তু তারপরে বুঝেছিলেন ওতে এক ধরনের আনাড়িপনা আছে যা প্রফেশনাল গল্প-লেখকের নয়, অথচ শুনে মজা পাওয়া যায়। ক্লাস এইটে উঠে নিজের গল্প দু তিনটে পত্রিকায় ছাপিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর থেকে আস্তে আস্তে অংকের জগতে ঢুকে গেলাম। এখন এসব ছেলেমানুষী মনে হয়। এমনকি নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখকের মধ্যে আজকাল লজিকাল গোলমাল দেখে বিরক্ত হই। তাতে কারো কোন লাভ নেই, নিজেই সময় কাটাবার এক সম্মানজনক স্বীকৃত পদ্ধতি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলি, ইশ, আমার আই, কিউ টা আরেকটু কম হলেও পারত। দুনিয়াটা কল্পনা ছাড়া কি বিরক্তিকর, কিন্তু এই ইডিয়ট গল্পলেখকগুলো একটা কমপ্লেক্স সিস্টেম সামলাবার মুরোদ রাখে না। সর্বকালের সব চেয়ে জনপ্রিয় তারকা লেখক হাবিবুর রহমানের লেখা পড়েও গাল দি' - আরে গাধা, তুমি ইংরেজী গল্পটা যেখানে বদলেছ, সেখানেই এক মারাত্মক ভুল করে রেখেছ। একসাথে পুরোটা পড়লেই বুঝতে পারবে। কিন্তু তারকা-লেখক কেন আমার পরামর্শে চলবে? তিনি তাঁর অগণিত লো আই, কিউ ভক্ত নিয়েই সন্তুষ্ট। যে তাঁর বই কেনে না, তাকে খুশী করার কোন কারণ নেই।

- তারপর কি হলো আব্বু? একটুও থামতে দিত না সামিনা। অনর্গল উদ্ভাবনের এবং নিত্য নতুন সৃষ্টিতে ক্লান্তি এলেও রেহাই নেই। শেষে অভ্যাসেই পরিনত হলো। একটা ট্রিক আবিষ্কার করলাম। পনেরো দিন পর পর সাইকেল কিছু রিপিট করলে সামিনা মাইন্ড করত না, যদিও ঠিকই টের পেত। বলত -
- তারপর তো রাজকন্যা বাগানে হারিয়ে গেল, তারপরে কি হলো?

এই পয়েন্টে আমাকে আরো সতর্ক হয়ে নতুন দিকে এগুতে হতো। পুরোটা নয়, শিশুরা একটু একটু বৈচিত্র চায় এক এক বারে। কিন্তু বড় কারো জন্যে লিখলে তো একটা বাক্যও রিপিট করা যাবে না, একটা ঘটনার একটা সম্পূর্ন অংশও না। শুধু এটমের মতো কিছু অবিভাজ্য জিনিস আছে, যা ভাঙা যায় না। সেগুলোর নিত্য নতুন সিকুয়েন্স দিয়ে নতুন গল্প। তাও আবার সম্ভাবনার সূত্র ধরে এগুতে হয়। অবিশ্বাস্য হওয়া যাবে না, আবার পুরোপুরি প্রেডিক্টেবলও হবে না। প্রথম দিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে গল্প বলতে বেশ ঝামেলাই হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে ভাবি রাজনীতিবিদরা নিজের নেতার জন্য দশ বারোটা অতি উত্তম বিশেষণ, আর বিরোধী দলের নেতাদের জন্য দশ বারোটা জঘন্য বিশেষণ, এই বিশটাই তো বিক্রি করে খায় আজীবন, এমন কি দল পরিবর্তন করলেও, নাম পরিবর্তন করে। বেশি বুদ্ধি লাগে না। ছাগলও রাজনীতি করতে পারে। কামাল হোসেনরাও ধীরে ধীরে ছাগল হয়ে যায়, আর যারা জেনেটিকালি তাদের তো কথাই নেই। অথচ ঐ হারামীদের জন্য রাস্তা বন্ধ থাকে, এক ঘন্টা আগে পথে বেরুতে হয়। কাড়িকাড়ি টাকার হরির লুট হয়। আবার কি সাহস, পুকুর চুরি করেও বলে আমরা চুরি করি না, বিরোধীরা করে। একটা ফিউজ দরকার। সব সার্কিট অফ করে দিয়ে নতুন করে সার্কিট তৈরী করা দরকার। কিন্তু সমাজতো থামানো যায় না। গতনুগতিকতা থেকেই সম্ভাব্য উত্তরণ। সময় কোথায়?

না, এ গল্পতে মোটেই কোন রাজনীতি নেই। এটা আমার গল্প, আর সামিনার, আর কালোপরীর।

দশ এগারো বছর বয়স তখন। বাবা নিয়ে গেলেন এক অনুষ্ঠানে। প্রথম পর্বে ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েরা একটা নাটক দেখালো - মিড সামার নাইটস ড্রীম। কি সুন্দর উচ্চারণ মেয়েগুলোর। সব চেয়ে ভালো অভিনয় করল "কালোপরী"। ওদের অভিনয় শেষ হলে আরো কিছু হলো, কিন্তু শিশু আমি তখনো মুগ্ধ হয়ে ওদের কথাই ভাবছি। স্টেজ থেকে নেমে এসে ওরা দর্শকদের মধ্যে আসন নিল। সামনে কোন আসন ছিল না, বাচ্চাদের সাথেই শেয়ার করল। আমার পাশে বসল কালোপরী। বাড়ি ফেরার পরে আমার বোনরা সেই দশ বছরের শিশুকেই টীজ করতে থাকল-
- বাহ, তোর ভাগ্যে তো একটা কালো পরী জুটেছে। ভালোই অভিনয় করে, শুধু একটু কালো, এই যা।
আমি রাগে গর গর করতে ঘরে ঢুকে ঘর বন্ধ করে দিলাম। বাবা হাসতে হাসতে বলল -
- এতো সিরিয়াস্লি নিচ্ছিস কেন? মেয়েটা অবশ্য খুব ট্যালেন্টেড। এত সুন্দর ইংরেজী উচ্চারণ।
আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাংলা মাধ্যমে পড়তাম। উচ্চারণ ভালোই ছিল, কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের মত না।

***********

আজ বাচ্চাকে গল্প বলতে গিয়ে হঠাৎ ছেলেবেলার সেই মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। এবার কালো পরী নিয়ে এক গল্প ফেঁদে বললাম। আমার মেয়ের ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। এর পর রোজই আবদার ধরত কালোপরীর গল্প বলতে। তবে কিছু দিন পরে ও যখন নিজেই বইপড়া শুরু করল, তখন আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল। তবু মাঝে মাঝে আমার কাছে আবদার ধরত কালোপরীর এর পরে কি হলো শোনাতে। অবাক ব্যাপার হলো ও এত কল্পনাপ্রবন ছিল যে আমি যা-ই বলতাম ওর ভীষণ পছন্দ হয়ে যেত। একটু আধটু ব্ল্যাকমেইলও করেছি। তুই দুধ না খেলে কালোপরীর অসুখ হবে। এই জাতীয়।

*******

এক সময় আমার ক্লাসে আসে এক মেয়ে। আমার কাছে মনে হয় অতীতের মিড সামার নাইটসের সেই কালোপরী। কেন মনে হয় আমি জানি না। আসলেই চারদিকে পরীদের রাজ্য। এই মেয়েটা খুব ফর্শা না, আবার ঠিক কালোও না। কথা বলতে পারে না শেক্সপিয়ারের ঢঙে - খুবই লাজুক। মনের মধ্যে একটা ট্যাগওয়ার্ড তৈরী হলো - কালোপরী। আমি পরীক্ষা কমিটিতে ছিলাম না। তবু অনার্স পরীক্ষার ভাইভার সময় ওকে সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম, তারপর আমার চাইতে বড় স্যারের সাথে একটু বাদানুবাদ শুরু করলাম বেশি নম্বর দিতে। আসলেই সেটা ফেয়ার নম্বর ছিল, কিন্তু আমার অস্বাভাবিক উৎসাহ দেখে স্যার অত ওপরে উঠলেন না। আবার ওকেই পরে নিজের রিসার্চ ছাত্রী হিসেবে নিলেন। যখন সেই ঘরে থাকত আমি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সব সময় তার দিকে এক নজর তাকাতাম। কিছুদিন পরে দেখি আরেক ছাত্র একটু হাসাহাসি করছে। এর পর থেকে ঘর বন্ধ রাখত। একদিন হঠাৎ আমাকে বলল, স্যার আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। বললাম-
- বেশ তো বলো।
কিন্তু ও হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেল।
- না থাক, এমন কিছু না।
কিছুদিন পরে এক সায়েন্স কনফারেন্স হলো। ওর টকের পরে আমাকে বলল,
- স্যার, আমার টকের সময় তোলা ছবিটা পাওয়া যাবে?
বললাম , নিশ্চয়ই।
দুটো সেট কিনলাম। ওকে ওর সেট দিতে গেলে খুব লজ্জা পেল। আমাকে দাম দিতে চাইল। আমি উড়িয়ে দিলাম। বাড়িতে আমার কপি এনে মেয়েকে বললাম -
- এই হলো কালো পরী। মেয়ে অবাক হয়ে বলল - আসলেই আছে?
বললাম - কখনো, কখনো।

কয়েকদিন পরে আমার এক বন্ধু বলল, দোস্ত, তুমি তো ভেজাল বাধাইস।
বললাম, কি ভেজাল?
বলল, তুমি যার ছবি নিস, অফিসের বড় সায়েবও তার ছবি নিসে।
চেষ্টা করলাম তাকে বোঝাতে আমার শুধু মেয়েকে দেখাবার শখ ছিল। বন্ধু হিহি করে হাসল। বলল, বুঝলাম তোমার উদ্দেশ্য সাধু ছিল, কিন্তু ওয়াহেদ ভাই কেন নিসেন কিসু বোঝ?
ওয়াহেদ ভাইকে নিয়ে অনেক সমস্যা অতীত থেকে চলে এসেছে, এটা তাঁর পরম বিখ্যাত স্ত্রীও জানেন। আমি তাঁর জিম্মাদার নই, বলে বিরক্ত হয়ে চলে এলাম।
কয়েকদিন পরে বিয়ের কার্ড পেলাম। মেয়েকে নিয়ে গেলাম বিয়েতে, মায়ের অপার বিস্ময় উপেক্ষা করে। ওর সুপারভাইজার স্যারও ছিলেন। আসরে শুনলাম ওরা উত্তর বঙ্গের সব চেয়ে সম্পন্ন জোতদারদের একটি। ছেলেটি আমারই এক ছাত্র, কিন্তু চিনতাম না। এমএস না করে বিবিএ করে এখন বাংলাদেশের এক সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর এম ডি। এক ছাত্র আমার মেয়েকে কণে দেখাতে নিয়ে গেল, কিন্তু একটু পরেই ফিরে এলো। কানের কাছে মুখ এনে বলল -
- কালোপরী ভালো না।
- কেন, কি হলো আবার!
- তোমার ছাত্র যখন বলল, স্যারের মেয়ে এসেছে তোমাকে দেখতে। অমনি বলে উঠল - তাড়াতাড়ি এখান থেকে নিয়ে যাও।
আমি হাসলাম।
- পরীরা খুব ভীতু হয়। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা বরং মজা করে খাই।


**********

খুব সম্প্রতি এক কনফারেন্সে গেলাম। আমি এক্সিডেন্টে এক পায়ের ব্যথায় কাতর হয়েও গিয়েছি। হঠাৎ একজন আমার চেয়ার ধাক্কা দিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি ও-ই, হাসছে। নাহ, কালোপরী, এই ধাক্কাগুলো আমার প্রাপ্য না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৩২
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রফেসদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×