অনেকেই অসাম্প্রদায়িকতার সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুলিয়ে ফেলেন। ইংরেজি secularism , বাংলায় যাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলি, আর অসাম্প্রদায়িকতা আলাদা জিনিস। আমি আজকে চেষ্টা করবো অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমার মতামত প্রকাশ করার, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নয়।এখানে একটা বিষয় বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নানান জনের নানান মত থাকলেও অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে, অন্তত কাগজে কলমে হলেও, সবাই একমত। নাস্তিক থেকে শুরু করে ইসলামসহ প্রতিটা ধর্মই অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গেয়েছেন। তবে secularism প্রশ্নে মতভিন্নতা রয়েছে। এরও অবশ্য কারন রয়েছে। উপমহাদেশে secularism শব্দটাকে এর প্রকৃত অর্থে খুব কমই ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকে নাস্তিকতার সাথে secularism কে মিলিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে secularism এর মোড়কে আড়ালে আবডালে নাস্তিকতাই প্রচার করে থাকেন।এই দুই গ্রুপের কারো উদ্দেশ্যকেই মহৎ বলা যাবে না! যাক গে, সে অন্য প্রসঙ্গ আমি সেদিকে যাব না। কারন আমি কথা বলতে চাই অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে।
অসাম্প্রদায়িকতা আসলে কি? আমি বলবো, “ নানান মানুষ নানান মত, স্বকীয়তা বজায় রেখে, সহাবস্থানের প্রশ্নে এক মত”- এটাই হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। অসাম্প্রদায়িকতা একটা মানসিক ব্যাপার।যার উৎপত্তি মননে।আর ধরা দেয় আচরণের মধ্য দিয়ে।
একটা সমাজকে তখনই অসাম্প্রদায়িক বলা যাবে, যখন ঐ সমাজের প্রত্যেকটা সম্প্রদায় নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে যা যা করনীয় তার সবই ভয়হীন পরিবেশে আর নির্বিঘ্নে করার অধিকার ভোগ করবে। নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে অন্যান্য সম্প্রদায়ও সমাজে সহাবস্থান করবে এমন মানসিকতা মনের মধ্যে যিনি লালন করেন এবং সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতিকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে গ্রহন করার সক্ষমতা রাখেন তিনিই তো অসাম্প্রদায়িক লোক।
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা একটা হট ইস্যু। তবে সাম্প্রদায়িকতার কথা যখনই ওঠে অনেকের সামনেই ভেসে ওঠে পাকিস্তানের জাতির জনকের মুখাবয়ব। কারন অনেকেই মনে করেন দ্বিজাতি তত্ত্ব থেকেই সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব! কথাটা সত্যি নয়। এ কথা বলার মানে অবশ্যই এটা নয় যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব কোন ধরনের অসাম্প্রদায়িক তত্ত্ব। আসলে দ্বিজাতিতত্ত্ব সাম্প্রদায়িকতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে মাত্র।সাম্প্রদায়িকতা আরও পুরনো ইস্যু। বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ভারত তীর্থ কবিতায়, যা ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয়, সমাজে সকল সম্প্রদায়ের মানুষদের একই সাথে লীন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,
“এসো হে আর্য, এসো অনার্য - হিন্দু মুসলমান, এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান”
আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির কথাকে ধরি তাহলে বলতে পারি সমাজে সকল শ্রেণীর মানুষের সহাবস্থানকে কবি আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ কবি অসাম্প্রদায়িকতা চেয়েছেন। তাহলে কথা উঠতে পারে ওই সময়ে কি সমাজে সাম্প্রদায়িকতা ছিল? আমি বলবো, অবশ্যই ছিল। কারন সাম্প্রদায়িকতাই যদি না থাকতো তাহলে কি করে তখন,১৯০৬ সালে, মুসলিম লীগের মত একটা সাম্প্রদায়িক দলের উদ্ভব হয়েছিল? তবে হ্যাঁ তখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মত অসাম্প্রদায়িক ভাবধারার লোকেরা মুসলিম লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।
তেনারা তখন অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেস করতেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি কংগ্রেস তার সেই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধরে রাখতে পারেনি। বিশ দশকের পর থেকেই কংগ্রেস তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারাতে শুরু করে। তবে ত্রিশের দশকে এসে কংগ্রেস পুরোপুরি একটা সাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। যেখানে জিন্নাহ এবং নেতাজীর মত অসাম্প্রদায়িক লোকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে সুভাস বসুর মত সর্বভারতীয় নেতাও কংগ্রেস থেকে বেড়িয়ে গিয়ে তৈরি করেন ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টি। অন্যদিকে এক সময়কার প্রসিদ্ধ অসাম্প্রদায়িক জিন্নাহ, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ নিজের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারিয়ে জিন্নাহও একজন সাম্প্রদায়িক নেতাতে পরিণত হন। জিন্নাহর এই সাম্প্রদায়িক নেতাতে পরিণত হওয়ার পেছনে অবশ্যই কংগ্রেসের দায় রয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের জনতা দলের সাবেক নেতা, বিজেপি থেকে বহিষ্কৃত, যশবন্ত সিং তার “জিন্নাহ,ভারত, দেশ বিভাগ” বইতে বিস্তারিত বলেছেন। এমনকি সেখানে তিনি জিন্নাহকে কোন কোন ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর চেয়েও অসাম্প্রদায়িক বলেছেন!
যাই হোক অসাম্প্রদায়িক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে জিন্নাহ তার বহুল সমালোচিত “সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্ব” প্রদান করেন যার ভিত্তিতেই ‘পাকিস্তান’ এবং ‘ভারত’ নামক দুটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। জিন্নাহই ভারত বিভাগের জন্য একক ভাবে দায়ী একথা যারা বলেন তারা তার প্রতি অবিচার করে থাকেন বলেই আমি মনে করি।কারন, কেন জিন্নাহ কংগ্রেস ছাড়লেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে কংগ্রেসকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।কংগ্রেসের এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
এরপরের ইতিহাস সকলের জানা। সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ থেকে অসাম্প্রদায়িক নেতারা বেড়িয়ে প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরে আওয়ামীলীগ গঠন করেন। যে আওয়ামীলীগের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভর করেই দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে।
একথা অস্বীকার পাওয়ার কোনই উপায় নেই যে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা।আর এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। কাজেই উপমহাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন একমাত্র নেতা যিনি তার নিজের ফিলসফিকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছিলেন। এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়,উপমহাদেশের প্রধানতম আর সফল অসাম্প্রদায়িক নেতা ছিলেন বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছিলেন। যা পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পারেননি।
কথা হচ্ছে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ কি তা ধরে রাখতে পেরেছে?আমি বলবো পারে নাই। যা আমাদের জাতীয় ট্র্যাজেডি! তবে এটা অস্বীকার পাওয়ার কোনই উপায় নেই যে পাকিস্তান তো বটেই ভারতের তুলনায়ও বাংলাদেশে অধিক পরিমানে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা হয়।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাকে স্বাভাবিক ঘটনাই বলতে হবে। কারন যেখানে ভারত-পাকিস্তান দুইটি দেশেরই জন্ম সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ নিয়ে সেখানে বাংলাদেশের জন্ম অসাম্প্রদায়িকতা থেকে! পুরোপুরি আলাদা জিনিস!
আমরা যদি ভারতের দিকে তাকাই দেখবো কাগজে কলমে ভারত আমাদের তুলনায় অধিক অসাম্প্রদায়িক! তবে বাস্তবে তাদের অসাম্প্রদায়িকতা আমাদের তুলনায় কম। অনেকটা কাজীর গরু কেতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নাই ধরনের!আসেন ফিরে তাকাই ৪৭ সালের পরের ভারতের দিকে।
১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতে অসংখ্য দাঙ্গা হয়েছে।মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক আরএসএসের কর্মী। মহাত্মাকে হত্যা করা হয়েছিল কারন শেষ দিকে তিনি মুসলমানদের প্রতি নমনীয় ছিলেন।শুধুই কি আর এস এস কিংবা বিজেপি? ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য বিজেপিকে দায়ী করা হলেও এটা মনে রাখা দরকার তখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও নাকি বিষয়টা জানতেন। যে কারনে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রাক্কালে তিনি পূজা করতে বসেছিলেন আর তার কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে যেন পুজার সময় ডাকা না হয়! অর্থাৎ কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িকতার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করে বাবরি মসজিদ ভাঙনে পরোক্ষ ভাবে হলেও ভূমিকা রেখেছিল। ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত গুজরাট দাঙ্গার, যাতে হাজার হাজার মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে, কথা সকলেরই জানা। আর ভারতের সর্বশেষ সাম্প্রদায়িকতার নজির হচ্ছে সেখানে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে যে কেলেঙ্কারি চলছে তা।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই কিংবা ছিল না এটা ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।তবে তসলিমা নাসরিন যেভাবে তার ‘লজ্জা’ উপন্যাসে ফুলানো ফাঁপানো সাম্প্রদায়িকতা দেখিয়েছেন তা সঠিক নয়। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা এখন অব্দি অন্য সম্প্রদায়কে ধর্ম চর্চায় বাধা দিবে এমন হিম্মতের অধিকারী হতে পারেনি! এটা আশার কথা।তবে নিরাশার কথা হচ্ছে, এখানে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা দিন দিন বাড়ছেই।যে কারনে মুসলমানদের বাইরের অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সাম্প্রদায়িকতা না থাকলে দেশ ছেড়ে নিশ্চয়ই কেউ চলে যেতেন না। দেশ ছেড়ে অনেকেই চলে যান কারন তারা দেশকে ভালবাসতে পারেন না। কেন পারেন না? কারন এখানে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। দাঙ্গা না বাঁধালেও এখানকার প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের লোকেরা হিন্দুদের বাড়ির গাছের নারকেল জোর করে পেড়ে খাওয়া, পুকুরের বড় মাছটা ধরে নেয়া, বরজের পান বিক্রি করে দেয়া,আথালের গরুটা ছেঁড়ে নিয়ে যাওয়া, জমির ফসল কেটে নেয়া, মাঝে মধ্যেই মূর্তি ভাংচুর করা ইত্যাদি টাইপের সাম্প্রদায়িক ঘটনা হামেশাই ঘটিয়ে থাকেন। নির্বাচন আসলে তো দেখা যায় আরেক তেলেসমাতি। যে কারনে হিন্দুরা ভয়হীন পরিবেশে বসবাস করতে পারেন না। আতংকিত হওয়ার মত বিষয় তো সেটাই!
সেদিন এক ছোট ভাই, বাংলাদেশ মেডিকেলে পড়ে, দুঃখ প্রকাশ করে বলল পূজায় তাদেরকে মাত্র দুই দিন ছুটি দেয়া হয়েছে! যে কারনে সে বাড়ি যেতে পারছে না। এ ধরনের আচরণ অবশ্যই অনাখাঙ্খিত।এই ধরনের ঘটনাই রোপণ করে সাম্প্রদায়িকতার বীজ। যে কারনে ম্লান হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক। ফিকে হয়ে যাচ্ছে অসাম্প্রদায়িক নেতার হাতে গড়া অসাম্প্রদায়িক দেশের চেহারা।তাই তো বড় দুঃখ নিয়েই শাহ আব্দুল করিম গেয়েছেন তার সেই হৃদয়স্পর্শী গান,
“গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু- মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদ গাইতাম,আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা; আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম.................................... ”
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ ভোর ৪:০৭