হিন্দুরা গরু খায় না। খা-বে না। মুসলমানদের উচিৎ তারা যেন গরুর স্পর্শ ছাড়া নির্ঝঞ্জাটে জীবন যাপন করতে পারে সেই ব্যবস্থায় সাহায্য করা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে এটা মুসলমানের দায়িত্বও। ইসলাম যদ্দূর বুঝি - পরমতসহিষ্ণুতা ইসলামের সৌন্দর্য্য। মুসলমানদের যে কোন বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতেও নিষেধ করা আছে।
মুসলমানরা গরু খায়। খাক না। হিন্দুদের উচিৎ এ বিষয়টার সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা। গরু শেষ পর্যন্ত একটা জনপ্রিয় আমিষ খাবার মাত্রই। যার প্রধান ভোক্তা মুসলমান বা এশিয়ানরা না! পশ্চিমা/ইউরোপিয়রা? বঙ্গদেশে কেউ গরু খেতে চাইলে নোটিশতো মারলেন ঠিক আছে। কথা হচ্ছে সাদা চামড়াধারীদের ওখানে গিয়ে পারবেন এই জোর খাটাতে?
মুসলমানদের কাউকে কাউকে দেখি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদে ‘গরু খাওয়ায় নিষেধ’ নাই প্রমাণ করার চেষ্টায় মরিয়া। হিন্দুরাও পাল্টা বেদ নিয়ে হাজির। কোরানের অসঙ্গতি প্রমাণে মরিয়া। তারপর হুলুস্থুল-গালাগালি। চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার। ঢাকা বা বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যায় কম বলে হয়তো সেভাবে রাগ ঝাড়তে পারেন না। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে বেদ দেখাতে আসেন! মুখে গোস্তের টোকরা ধরে সেলফি লাগান। ভারতে গিয়ে গরু খান স্বীকার করার মতো সাহস কয়জন মুমিন বান্দার আছে? মাইরা ট্যাংগি হাতে ধরাই দিবে। ওখানে গরু একটা ইস্যু মাত্র। উঠতে বসতে কারণে অকারণে মুসলমানরা লাত্থি/উষ্ঠা খায়।
আজ নিজেরা সংখ্যাগুরু বলে বাহাদুরি দেখান! দেখাইয়েন না। সংখ্যায় যারা কম তাদের অনেক কষ্ট থাকে। সেই কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেন, লাঘবের উদ্যোগ নেন। ধর্ম ও জীবন স্বার্থক হবে। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু মেন্টালিটি কিভাবে মাটি দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবেন। শান্তির সঙ্গী হোন না পারলে অন্তত চুপ থাকেন।
মুসলমানরা 'ইসলাম' সত্য ধর্ম/শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে চিল্লান। চিল্লানের আগে একটু আয়নায় মুখটা দেখেন। দেখবেন এই দেশের বহু সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী আপনাদের ভয়ে, অত্যাচারে বা বেঁচে থাকার তাগিদে খ্রিষ্টান ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নিজেদের করে নিয়েছে। অথচ আপনারা সংখ্যায় ৯০ শতাংশ। তারা ৯০ শতাংশের কাছে আসেনি, আসতে পারেনি বা আসার প্রয়োজন মনে করেনি। হয়তো আসার রুচিও হয়নি। ৯০ শতাংশ তাদের (ভষা-সংস্কৃতি) রক্ষা করতে পারেনি। তারা গিয়েছে ০০.৩৩ শতাংশের কাছে। কি জবাব দেবেন?
কি এমন দুঃখ সাঁওতালরা বয়ে বেড়ায় যে মুসলমান দেখলে ভয়ে আঁতকে উঠে! বাংলাদেশের কোন একটা গীর্জায় গিয়ে দেখেন শতশত মুসলিম তরুণ-তরুণী খ্রিস্টন ধর্ম গ্রহণ করে সেই ধর্ম প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাজার হাজার মুসলমান নিজ ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছে কেন? তখন কোথায় থাকে আপনাদের ধর্মীয় জোশ, উন্মাদনা? এটা কেবল গরুর বেলায় দেখা দেয়! একবারও ভাবেন নিজেদের স্বভাব চরিত্র নিয়ে? বঙ্গদেশে মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্বের জায়গাটা উতরে যাওয়ার চেষ্টা ক’জন মুসলমান করে? আমিতো দেখি না। আশপাশে হঠকারী ধর্মীয় উন্মাদ দেখি, ধর্ম চর্চাকারী, ধর্মকে হৃদয়ের গহীনে লালনকারী কই! এই দেশে সব আছে ভালো মানুষের দেখা মেলা ভার।
বড় ভাইয়ের অনেক দায়িত্ব থাকে। থাপ্পর খেয়েও ক্ষত সারাতে মলম লাগানোর কথা বলতে হয়। বাংলাদেশে মুসলিমদেরও এই ভূমিকা নিতে হবে। কারণ মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি। এই সমাজটাকে সুন্দর ও শান্ত রাখার প্রধান দায়িত্ব মুসলমানদের।
আমার বুঝে আসে না গরু খাওয়া 'বেদে' আছে কি নেই কেন প্রমাণ করতে হবে? কেনরে ভাই? একজন মানুষ খেতে চায় না এটাই কি যথেষ্ঠ না? খাবে না বলার পরতো আপনার দায়িত্ব হলো তার যেন না খেতে হয় সে ব্যবস্থা করা। অথচ আপনি করতে চান উল্টোটা। (একটা গোষ্ঠীকে মিন করছি।)
ভারতে বিজেপির উত্থান বাংলাদেশে হিন্দুদের একটা অংশকে উগ্র করেছে বলেই আমার মনে হয়। আরএসএস এর অখণ্ড আদর্শ রাষ্ট্র গঠন হয়তো কেউ কেউ চোখের সামনেই দেখছেন। সে যাইহোক, হিন্দুদের ভুলে গেলে কেমনে চলবে, আমরা শেষ পর্যন্ত একটা সমাজে বাস করি। সে সমাজে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষ বাস করে। সেই সমাজ ধর্মগতভাবে মুসলিম প্রধান। ফলে এখানে মুসলমানদের ধর্মীয় আচার বা সংস্কৃতির বিশেষ প্রভাব থাকবে বা থাকে। দুনিয়ার সব জায়গাতেই আছে।
আপনারা যেভাবে ইসলাম বা মুসলমান ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেখান সেটা কাম্য না। গরু খাওয়া না খাওয়ার সাথে কথিত অসাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক খোঁজাটা মারাত্মক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা। শুধু সাম্প্রদায়িকতা না উগ্রতাও।
কোন একটা সুযোগ পেলে পুরো মুসলিম সমাজ বা ধর্ম ইসলামকে কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা ভালো কোন কাজ না। এই সমাজে খারাপ নেই কিভাবে বলি কিন্তু এখনো ভালোর সংখ্যা খারাপের চেয়ে বেশি বলেই বিশ্বাস করি। এখনো হিন্দু-মুসলিম তরুণ একসাথে সকাল দেখে, এক প্লেটে খাবার ভাগাভাগি করে, গলা ছেড়ে গান গায়, এক সাথে সুন্দর একটা সমাজের স্বপ্ন দেখে। চোখে শুধু অঘটন না দেখে এগুলোও দেখেন। আপনার মন প্রশান্ত হবে, চারপাশে আসবে শান্তি।
আরেকটা ব্যাপার, দিল্লীর সাথে বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম) সদ্ভাব বোধহয় ইতিহাসে এখনই চলছে। তাও দুই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে খুব একটা না। সুতরাং দিল্লীতে কি হচ্ছে তা দিয়ে বাংলাকে বিচার করার চেষ্টা বোকামী ও অজ্ঞতা। একটু ইতিহাস তলালে দেখবেন, বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান একসাথে দিল্লীর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আগুয়ান। কোনদিনই এবেলো ধর্ম বড় কোন ইস্যু হয়নি। এখানে শুধু শুধু ধর্ম টেনে আনার কোন মানে হয় না।
অনেককে দেখি ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়ো তুলে ঈদ উৎসব নিয়েও প্রশ্ন তুলে বসে থাকেন। ভাই/বোনেরা সহনশীল হোন। ঘৃণা কেবল ধ্বংশই ডেকে আনে। আসেন ভালোবাসার চেষ্টা করি। মানুষ মানুষকে ভালোবাসি। ভালোবাসার লেনাদেনা করি।
ভালোবাসা দিয়ে তজমহল হয়। সেই তাজমহল হয় ইতিহাস। একটা গরীব দেশে এতো বিভাজন মানুষকে আরও গরীব বানানোর হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু না… এবং এটা হয়তো ভিনদেশী করো মস্তিষ্কপ্রসূতও… আবারও ডিভাইড এন্ড রোল পলিসির বলি হইয়েন না…
ছবিতে লেখক। স্থান: ওদেসা, ইউক্রেন। ছবিটি তুলেছেন মিশরীয় লেখক, উন্নয়নকর্মী ও ট্রেইনার আহমেদ নাগুইব।
(চার পর্বে শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২১ রাত ১০:১১