‘আপনারা কোনো ফ্ল্যাটে না গিয়েই কীভাবে বা কিসের ওপর ভিত্তি করে বলতে পারবেন যে, ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটগুলো শিশু ও বৃদ্ধদের বাস উপযোগী না?’ সুনিবিড় আবাসন প্রকল্পের সাবেক ম্যানেজার এই জাতীয় জিজ্ঞাসার সূত্রপাত করেন। আসলে এই জিজ্ঞাসা লেখক মেহেদী উল্লাহ ‘ফ্ল্যাটে শিশু ও বৃদ্ধ নিদারুণ’ গল্পের মাধ্যমে তুলে আনেন। গল্পের প্রধান চরিত্র মুকিত সাহেব চাকরি ছেড়ে এক পক্ষীশালা দিয়েছেন। লেখক অবশ্য এটাকে পক্ষীশালা বলতে নারাজ, কারণ এখানে আরও অনেক প্রাণি আছে। তো, এই মুকিত সাহেব সবাইকে এই প্রশ্ন করেন। যা তার কাছে এক ধাঁধা!
এই ধাঁধায় কেউ বিভ্রান্ত হয়, কেউ হকচকিয়ে যায়। কিন্তু কেউ যেতে চায় না গভীরে। কেউ ভাবে না এই শহরের ফ্ল্যাটগুলো কেন শিশু ও বৃদ্ধদের উপযোগী না। মুকিতের এমন প্রশ্নের বেড়াজালে আটকে যাবে পাঠক। এমনই অদ্ভুত চরিত্রকে নির্মাণ করেছেন লেখক মেহেদী উল্লাহ। যেন মুকিতকেই তিনি দায়িত্ব সপেছেন অবহেলার এই শহরে বাস করা শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে ভাবার। মুকিতের সঙ্গে এক সময় পরিচিতি হয় প্রসন্ন এবং বুনোহাঁসের। তারা বিয়ে করবে, আর এজন্যই বাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখা হয় মুকিতের সঙ্গে। আড্ডা-গল্পে মুকিত হাজির করেন আরেক জিজ্ঞাসার। লেখক মুকিতকে দিয়ে বলাচ্ছেন,
... আচ্ছা বলুন তো আমরা কেন, নিজেদের উপকরনাদি দিয়েই শিশু আর বৃদ্ধের জীবনটা চালিয়ে দিতে চাই। তাদের জীবনটাকে কেন অস্বীকার করি বলতে পারেন? কেন আমরা অপেক্ষা করে থাকি, শিশু তারুণ্যে পৌঁছাবে? আর বৃদ্ধের মধ্যে তারুণ্য খুঁজি?...’।
অদ্ভুদ এই জিজ্ঞাসার ভেতর পাঠক হারাবে। খুঁজে ফিরবে শিশুদের মনের বেদনা কিংবা বৃদ্ধের হৃদয়ে উবে যাওয়া রঙ।
এমন সব অদ্ভুত চরিত্রের মাধ্যমে অমানবিক/মানবিক জিজ্ঞাসা হাজির করেন মেহেদী উল্লাহ তার ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’ গল্পগ্রন্থে। ২০১৬ সালের একুশে বইমেলায় মেহেদী উল্লাহ রচিত এই গল্পগ্রন্থটিতে রয়েছে ১০টি গল্প।
এই গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পের নাম ‘ব্রেক-আপের ব্যাক-আপ’। এই গল্পে লেখক প্রেমিক-প্রেমিকাদের কোনও বাড়িতে প্রেম ভাঙতে মানা করছেন। কেন করছেন? সেই প্রশ্নের উত্তর লেখকই দিয়েছেন।
এ গল্পে হয়তো লেখক স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ার বেদনার কথা বলছেন, হয়তো লেখক প্রেমকে স্মৃতি হিসেবে পাওয়ার একটি উপায়ও হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা বলছেন। আসলে কী বোঝাতে চান মেহেদী উল্লাহ? এমন প্রশ্নের সন্ধানের মধ্যেই হাজির হয় মায়ের এক চরিত্র। যেখানে আছে রুসুই ঘরে ফেরিওয়ালার সঙ্গে মায়ের এক গোপন প্রণয়ের ইঙ্গিত। এমন ইঙ্গিতের ভেতরই পাঠক আটকে যায়। পাঠকই লেখককে প্রশ্ন করবে, ফেরিওয়ালার সঙ্গে কি তবে মায়ের প্রেম ছিল?
এমনই আরেক জিজ্ঞাসার সম্মুখিন হতে হয় ‘যুদ্ধোত্তর মুক্তি’ গল্পে। এখানে প্রধান চরিত্র মোদাচ্ছের মাস্টার। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তার নামের আগে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বলায় তিনি আপত্তিও জানান। এই আপত্তি যেন লেখকের নিজের। মুক্তিযোদ্ধা তো মুক্তিযোদ্ধা, তার সঙ্গে ‘বিশিষ্ট’ বিশেষণের মাজেজা এই সমাজে অনেকেরই অজানা। তো, মোদাচ্ছের মাস্টার অবসরে গেলেন। তারপর তার মাথায় এক আজব চিন্তা আসলো। তিনি ডেকে পাঠালেন তার প্রিয় দুই ছাত্র রহিম আর করিমকে। তারা দুজনই এখন প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষকের ডাকে দুজনই হাজির হলেন। তাদের এক দায়িত্ব দিলেন। তাদের কাজ হলো গ্রাম ঘুরে ঘুরে ভালো কাজ আর খারাপ কাজ লিপিবদ্ধ করা। শুরু হয়ে গেল কাজ। লিপিবদ্ধের এক পর্যায়ে একটি ঘটনায় ভালো-খারাপের সিদ্ধান্তে আসতে পারে না তার প্রিয় ছাত্র। ঘটনাটার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের এক অমানবিক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন মেহেদী উল্লাহ। যেখানে এক ইমাম যুদ্ধের সময় ঈদের নামাযের মোনাজাতে পাকিস্তান রক্ষায় দোয়া করেন। এখানে দুটি ‘হতে পারে’ সম্ভাবনা হাজির হয়। লেখক যেন পাঠককেও এমন ঘটনায় ‘বিবেচনা’ করার আমন্ত্রণ জানান। কারণ ওই ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কোনও অভিযোগ নেই। নেই অন্য কোনও বিতর্ক। তবুও ওই একদিনের দোয়ায় কি তাকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে? এই ‘হতে পারে’র মধ্যেই লেখক হাজির করেন এক অন্যরকম জিজ্ঞাসার উত্তর। যেখানে তিনি মাস্টারকে দিয়েই বলান, ‘জগতের কিছু কাজও না ভালো, না মন্দ। অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এমন কাজের ভালো-মন্দের ফায়সালা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। তারা ভালো বললে কাজটি ভালো, তারা মন্দ বললে মন্দ।’
এভাবেই লেখক অদ্ভুতসব জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে এগিয়ে নেন একেকটি গল্প। এগিয়ে যায় ‘ভূতের বাড়ি নির্মাণ কৌশল’, ‘জি মৌটুসী, আমি আপনাকে শুনতে পাচ্ছি’, ‘সাবস্ক্রাইবার অব সালমন দ্য ব্রাউনফিশ’, ‘হিজরত’, ‘শুল্ক ঠোঁট তোমার’, ‘অফ দ্য রেকর্ড’, ‘ফারিয়ার মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’।
যেমন, যে গল্পের নামে বই হয়েছে ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’। এই বইয়ের নামের ভেতরই রহস্য আছে। সবার মনে প্রশ্ন জাগবে, ফারিয়া কেন মুরগির বাচ্চা গলা টিপে মারে? রহস্যের উত্তরটাও সহজেই গল্পে দিয়ে দেন। কারণ, ফারিয়ার মেজাজ খারাপ হলে সে সবার আগে মুরগির বাচ্চাই গলা টিপে মারে। কিন্তু কেন মুরগিই মারে?
‘তিরোধানের মুসাবিদা’ এবং ‘রিশতা’ গল্পগ্রন্থের পর এটি মেহেদী উল্লাহর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। এই গ্রন্থের অধিকাংশ গল্পে মেহেদী উল্লাহ শুরুতেই পাঠককে আটকে ফেলবে তার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে। তবে পাঠক মাঝে মাঝে খেই হারাবে কারণ অপ্রয়োজনী কিছু ঘটনার সূত্রপাত আসবে। যার সঙ্গে গল্পের মিল খুঁজতে যাওয়া বৃথা। এছাড়াও গল্প বলার ঢঙয়ে নাটকীয়তা তৈরি করে আবার সেটা ভেঙে দেওয়া এবং নতুন প্রশ্নের ভেতর পাঠককে আটকে দেওয়ার এক্সপেরিমেন্ট মন্দ নয়।
মেহেদী উল্লাহ রচিত ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’ প্রকাশ করেছে চৈতন্য। মূল্য ১৩৫, প্রচ্ছদ শিল্পী শিবু কুমার শীল।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৫০