বার হাজার মাইল দূরত্বে ব্রিটিশ ভারতের দুই বিপরীত সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে যে অস্বাভাবিক নজীরবিহীন একটি রাষ্ট্র ব্রিটিশ-ভারতের ঔপনিবেশিক শক্তি শেষ মুহূর্তে সৃষ্টি করে দিয়ে গিয়েছিল, তা জন্ম থেকেই স্বল্পায়ু ছিল। গোড়া থেকেই এটা ছিল রেসিপি ফর ডিজাস্টার।এটা ছিল কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা মানবসৃষ্ট বিপর্যয় যাতে ৭৫,০০০- ১০,০,০০০ নারীকে অপহৃত ও ধর্ষিত হতে হয়েছিলো, বিশ লক্ষ মানুষ দুই কোটি মানুষকে গৃহহারা হতে হয়েছিলো এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। এই বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদ, জমি- জান-মাল-সম্মান- মর্যাদা-নিরাপত্তার এই বলিদান কোন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে দেয়া হয় নাই। ভারতীয় উপদ্বীপে সৃষ্ট কৃত্রিম এক নজিরবিহীন গৃহযুদ্ধে এই বিপুল প্রাণের অপচয় ঘটলো।
দুনিয়ার নিপীড়িত ইহুদীদের জন্যে একটি রাষ্ট্রের মত কৃত্রিম একটি রাষ্ট্রের আদলে "নিপীড়িত মুসলমানদের জন্যে রাষ্ট্র"- ধারনাটা এই জন্যে খুব আশ্চর্যজনক যে, দুনিয়াতে মুসলমানরা প্রথম যুগের খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনও persecuted statelss ছিল না, সংখ্যালঘু ছিলও না। বরং ছিল সংখ্যায় জ্যামিতিক হারে ক্রমবর্ধিষ্ণু এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্রস্টা। কোন অঞ্চলে সংখ্যায় কম হওয়া নিয়ে তাদের অস্তিত্ব হারানোয় কোন ভয় ছিল না। বরং তাদের জীবনাচরণ ছিল সহজেই সংক্রামক এবং সমাজ ছিলও সহজেই বর্ধিষ্ণু এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। আমি এখনও ভেবে পাই না, কেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারীদের "নিপীড়িত মুসলমান" দের "সুরক্ষা"র জন্যে ইহুদীদের জন্যে ইসরায়েলের আদলে রাষ্ট্র কল্পনার চাইতে ভাল কিছু চিন্তা করা গেল না। মুসলমানদের জীবনে বৈশ্বিক উম্মাহর কালেকটিভ কন্সাসনেস আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্যে জাতিরাষ্ট্রের চাইতে অনেক বেশী অর্থবহ। পাকিস্তান নামক তথাকথিত মুসলমানের আবাসভূমিটি এই জাতিরাষ্ট্রের নামে সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন আরেক মুসলমান ভাই-ব্রাদারদের সমাজে গণহত্যা-গণ ধর্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত করে ফেললো। এর চেয়ে বড় অধঃপতন আর কি হতে পারে?
হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে মুসলমানরা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের বিচিত্র ভাষাভাষী, বিচিত্র জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির শত শত কোটি মানুষের শাসক ছিল, অটোম্যান, মুঘল সাম্রাজ্য সেই সময়ের জন্যে ছিলও সদ্য বিগত বাস্তবতা। এখনও আধুনিক বিশ্বের বিপুল অংশে মুসলমানরাই রাষ্ট্র পরিচালক। স্পেন, মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া অব্দি এক বিরাট পৃথিবী বিভিন্ন মুসলমান খিলাফত ও রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল। সেটা কোন হারিয়ে যাওয়া অতীতকালও নয়। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিপুল ভূভাগে তারা শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েম করে আছে। এবং এদের সংখ্যা বাড়া ছাড়া কমে যাওয়ার কোন লক্ষণ নাই। "নিপীড়িত ইহুদী"র ইতিহাস বা বাস্তবতার সাথে কি মুসলমানদের ইতিহাস ও অবস্থার কোন তুলনা চলতে পারে? বাংলার উইলিয়াম হান্টার জাতীয় ব্রিটিশ প্রশাসকেরা "পিছিয়ে পড়া মুসলমান" এর বয়ান সৃষ্টি করেন এবং সেই "ব্যাকওয়ার্ড মুসলমান" এর ধারনা আজও পশ্চিমা শিক্ষিত আধুনিক প্রগতিশীল বয়ানের মৌল আলাপ। এই রকম রাষ্ট্রকল্পনার সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটাই ছিল এটা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ সময় জাতি একটা শক্তিমত্তার কল্পনায় গড়ে না উঠে, দুর্বলতার কল্পনায় ভিত্তি করে গড়ে উঠল।
পার্টিশনের ২৩ বছরের মধ্যেই পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে নিঃসন্দেহে ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য নিশ্চিত হয়েছে, পাকিস্তান ভাঙ্গার ফলে ভারত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে। তবে, 'আঞ্চলিক আধিপত্য সৃষ্টির জন্যে ভারতের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়' - বহুদিন ধরে এই ধরনের আলাপ যারা করছেন, তারা ভুলে যাচ্ছেন (কিম্বা ভুলে যাওয়ার ভান করছেন) যে, ঢাকার বুকে পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট নামক নৃশংস গণহত্যা ঘটানোর পরে পাকিস্তানের আর এক টুকরা থাকার সুযোগ থাকে না।এটাকে সম্ভবত তারা ভারতের কৃতিত্ব বলবেন না।পাকিস্তানে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি না হওয়া, পাকিস্তান ভাঙা সামরিক জান্তা সরকারেরই কৃতিত্ব। তাদের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রনীতির কৃতিত্ব। এই ধরনের রাষ্ট্রনীতি কি মুসলমান আইডেন্টিটি দিয়ে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পেরেছিল? আমার তো মনে হয় না। এই সামরিক এক নায়কতন্ত্র যে কোন ধরনের ঐক্যের সম্ভাবনাকেই অঙ্কুরে বিনাশ করে দিয়েছে। পাকিস্তানের জনসাধারণের মূল অংশটুকু সেই সরকারকে নির্বাচিত করে নাই, সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা নির্বাচন করে নাই। পাকিস্তানের জনসাধারণ আজও সেই বে-ইনসাফ ভিত্তিক নীতির মাসুল গুনছে এবং আজ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। পাকিস্তানের আমজনতা সামরিক-আমলা-ভূস্বামী- রাজনীতিক কতিপয়তান্ত্রিক এলিট গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলে রাখার এই অন্যায্য খেলার ভিকটিম হয়েছে। এত বছর বাদে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ইতিহাসের এই এই সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো করবার শক্তি হয়েছে।
মানচিত্র ও ছবিঃ সংগৃহীত
২৬ শে মার্চ, ২০২৪
মিলওয়াকি, উইসকন্সিন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৪