আমরা যারা মমিন মুসলমান তারা স্বপ্নে সব সময় জান্নাত লালন করি। চির সুখের জান্নাতে যেতে কার না মন চায়।
জান্নাতে সুখ শান্তি আর আরাম আয়েশের কোন শেষ নাই। সেখানে অসাধারণ সব খাবারের সমাহার থাকবে যা দুনিয়ার কোন মানুষ কোন দিন কল্পনাও করতে পারবে না।
হজরত যাবির (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘অবশ্যই জান্নাতবাসীরা জান্নাতে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করবে। কিন্তু তাদের থুথু ফেলার, পেশাব-পায়খানা করার, কিংবা নাক ঝাড়ার প্রয়োজন হবে না।
সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, তাদের ভক্ষ্যবস্তুর (পেটে) কী দশা হবে?
রাসূল (সা) বললেন, ঢেঁকুর ও পরিছন্নতার মাধ্যমে বের হবে। কিন্তু মেশকের সুগন্ধ বের হবে। আর জান্নাতবাসীদের অন্তরে আল্লাহর তাসবিহ ও তাহমিদ এমনভাবে বেঁধে দেয়া হবে যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস (অর্থাৎ জান্নাতবাসীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের ন্যায় সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করতে থাকবে)।’ (সহীহ মুসলিম)
জান্নাতিদের খাবারগুলো ঢেঁকুর এবং মিশক্ ঘ্রাণযুক্ত ঘর্ম দ্বারা নিঃশেষ হয়ে যাবে। (বুখারি ও মুসলিম)
জান্নাতিরা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ডুবে থাকবে। কোনো হতাশা ও দুশ্চিন্তা থাকবে না। তাদের পোশাক পুরনো হবে না। (মুসলিম)
জান্নাতবাসীরা সব সময় জীবিত থাকবেন। তাঁরা বৃদ্ধ হবেন না এবং তাঁরা হবেন চিরযৌবনা। (মুসলিম)
আল্লাহ সুবহানাতায়ালা এরশাদ করেন, ‘জান্নাতে জান্নাতিদের জন্য ফলমূল ও কাঙ্ক্ষিত সব কিছু থাকবে।’ (সুরা:ইয়াসিন) । তিনি আরো এরশাদ করেন, ‘তারা জান্নাতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে—তথা তারা প্রচুর ফলমূল ও পানীয় বস্তু আনতে বলবে।’ (সুরা : সাআদ) আরো এরশাদ করেন, ‘জান্নাতে আছে দুধের নদী, যার স্বাদ অপরিবর্তনীয় ও পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নদী এবং পরিশোধিত মধুর নদী ও তথায় থাকবে বিভিন্ন ফলমূল ও তাদের প্রতিপালকের ক্ষমা।’ (সুরা : মুহাম্মদ)।
একবার এক ইহুদি পাদ্রী রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) ঠিক প্রশ্নই করেছিলেন জান্নাতে কি ধরনের খাবারের ব্যবস্থা থাকবে? জান্নাতিরা জান্নাতে প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম তাদেরকে কী খাবার পরিবেশন করা হবে?
উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ‘জান্নাতিদের মাছের কলিজার পাশের যে মাংস থাকে তা দিয়েই পরিবেশন করা হবে।’
এর পর ইহুদি আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘এর পর কী পরিবেশন করা হবে?’
রাসূলুল্লাহ সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এরপর জান্নাতিদের জন্য জান্নাতে পালিত গরুর গোশত পরিবেশন করা হবে।’
এরপর ইহুদী জিজ্ঞেস করল, ‘খাওয়ার পর পানীয় হিসেবে কী কী পরিবেশন করা হবে?’
রাসূলুল্লাহ এবার বললেন, ‘সালসাবীল নামক ঝর্ণার পানি পরিবেশন করা হবে জান্নাতিদের।’ (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল হায়েজ) ।
জান্নাতের সর্বপ্রথম আতিথ্য হবে তিমি মাছ ও বলদের কলিজার অতিরিক্ত অংশ দ্বারা। পৃথিবীর মাটি হবে রুটিরূপ খাদ্য। (বুখারী ৩৩২৯, মুসলিম ৩১৫নং)
বেহেস্তের খাবার পর্যাপ্ত পছন্দমত ফল-মূল, ইঙ্গিত পাখির মাংস। মহান আল্লাহ বলেছেন, তাদের পছন্দ মত ফলমূল। আর তাদের পছন্দমত পাখীর মাংস নিয়ে। (ওয়াক্বিআহঃ ২০-২১)
আমি তাদেরকে ঢের দেব ফল-মূল এবং মাংস, যা তারা পছন্দ করে। (তুরঃ ২২)।
বরং যে খাবার খেতে মনে বাসনা হবে, সেই খাবারই জান্নাতীরা জান্নাতে খেতে পাবে। মহান আল্লাহ বলেন, সেখানে রয়েছে এমন সমস্ত কিছু, যা মন চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয়। সেখানে তোমরা চিরকাল থাকবে। (যুখরুফঃ ৭১)
দুনিয়াতে কষ্ট বরণ করে যে আমল তারা করত, তারই অসীলায় পাবে ইচ্ছামত পান-ভোজনের ব্যবস্থা। মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা যা করতে তার প্রতিফল স্বরূপ তোমরা তৃপ্তির সাথে পানাহার করতে থাক। (তুরঃ ১৯)
সেখানে প্রত্যেক ফল দু’-প্রকার থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন,উভয় (বাগানে) রয়েছে প্রত্যেক ফল দুই প্রকার। (রাহমানঃ ৫২)
রকমারি ফলের বৃক্ষে ফল ঝুলে থাকবে। যা সম্পূর্ণরূপে জান্নাতীদের আয়ত্তাধীন করা হবে। জান্নাতীগণ বসে বা শয়ন করেও ফল তুলে খেতে পারবে।
মহান আল্লাহ বলেন, সেখানে তারা হেলান দিয়ে বসবে পুরু রেশমের আস্তরবিশিষ্ট বিছানায়, দুই বাগানের ফল হবে তাদের নিকটবর্তী। (রাহমানঃ ৫৪)
যার ফলরাশি ঝুলে থাকবে নাগালের মধ্যে। (হা-ক্বাহঃ ২৩)।
সন্নিহিত বৃক্ষছায়া তাদের উপর থাকবে এবং ওর ফলমূল সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন করা হবে। (দাহরঃ ১৪)
জান্নাতে আছে খেজুর, বেদানা ও আরো অজানা কত রকমের ফল।
মহান আল্লাহ বলেন, সেখানে রয়েছে ফলমূল খেজুর ও ডালিম। (রাহমানঃ ৬৮)
সেখানে থাকবে কুল (বরই), কাদি কাদি কলা। মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ, আর ডান হাত-ওয়ালারা, কত ভাগ্যবান ডান হাত-ওয়ালারা! (যাদেরকে ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে। তারা থাকবে এক বাগানে) সেখানে আছে কাটাহীন কুলগাছ। কাঁদি ভরা কলাগাছ। (ওয়াক্আিহঃ ২৭-২৯)
জান্নাতীরা থাকবে বাঞ্ছিত ফলমূলের প্রাচুর্যের মধ্যে।
(আল্লাহ বলবেন,) ‘তোমরা তোমাদের কর্মের পুরস্কার স্বরূপ তৃপ্তির সাথে পানাহার কর। এভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি।' (মুরসালাতঃ ৪২-৪৪)
জান্নাতে আছে পানির সমুদ্র ও নদী, শারাবের সমুদ্র ও নদী, মধুর সমুদ্র ও নদী, দুধের সমুদ্র ও নদী। তাছাড়া ঝরনাও রয়েছে সেখানে। সেখান হতে জান্নাতীরা ইচ্ছামত পান করতে পারবে। খাদেমদের মাধ্যমেও পান করানো হবে। এক ঝরনা থেকে কপূর-মিশ্রিত পানি পান করবে। (দাহরঃ ৫-৬) সালসাবীল ঝরনা থেকে আদা-মিশ্রিত পানি পান করবে। (ঐঃ ১৭-১৮) তাসনীম ঝরনা থেকেও পান করবে বেহেশ্তী পানি। (মুত্বাফফিফীন ২৭-২৮)
জান্নাতীরা জান্নাতে পবিত্র শারাব পান করবে। মহান আল্লাহ বলেন, তাদের দেহে হবে মিহি সবুজ এবং মোটা রেশমী কাপড়, তারা অলঙ্কৃত হবে রৌপ্য-নির্মিত কঙ্কনে, আর তাদের প্রতিপালক তাদেরকে পান করাবেন বিশুদ্ধ পানীয়। (দাহরঃ ২১)
বেহেশতের সে শারাব কিন্তু কোনভাবেই দুনিয়ার মদের মত নয়। দুনিয়ার মদে নেশা হয়, মাথা ঘোড়ে, পেটে ব্যথা হয়, বমি হয়, রোগ সৃষ্টি হয়। তাতে মানুষ জ্ঞানশূন্য হয়, ভুল বকে, মাতলামি করে। কিন্তু জান্নাতের শারাব এ সবকিছু থেকে পবিত্র।
মহান আল্লাহ বলেন, তাদেরকে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে প্রবাহিত শারাবের পানপাত্র, যা হবে শুভ্র উজ্জ্বল, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু। ওতে ক্ষতিকর কিছুই থাকবে না এবং এতে তারা নেশাগ্রস্তও হবে না। (স্বা-ফফাতঃ ৪৫-৪৭)
সুতরাং জান্নাতের শারাব হবে সাদা, সুস্বাদু। যা পান করে মন আমেজের সাথে পরিতৃপ্ত হবে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নদীমালা আছে। (মুহাম্মাদঃ ১৫)
সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, তাতে নেশা হবে না, মাথা-ব্যথাও হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে চির কিশোররা---পানপাত্র, কুঁজা ও প্রস্রবণ নিঃসৃত সুরাপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে। সেই সুরা পানে তাদের মাথাব্যথা হবে না, তারা জ্ঞান-হারাও হবে না। (ওয়াক্বিআহঃ ১৭-১৯)।
তা পান করে কেউ আবোল-তাবোল বকবে না, কোন অস্বাভাবিক আচরণও করবে না। মহান আল্লাহ বলেন, সেখানে তারা একে অপরের নিকট হতে গ্রহণ করবে (মদ ভরা) পান-পাত্র, যা হতে পান করলে কেউ অসার কথা বলবে না এবং পাপ কর্মে লিপ্ত হবে না। (তুরঃ ২৩)
সে এক অন্য শ্রেণীর বিশুদ্ধ মদিরা। যাতে থাকবে কস্তুরীর মিশ্রণ। যা থাকবে সীল করা, মোহর আঁটা। মহান আল্লাহ বলেন, তাদেরকে মোহর আঁটা বিশুদ্ধ মদিরা হতে পান করানো হবে। এর মোহর হচ্ছে কস্তুরীর। আর তা লাভের জন্যই প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক। (মুত্বাফফিফীনঃ ২৫-২৬)।
জান্নাতীরা ইচ্ছামত খাবে ও পান করবে; কিন্তু মলমূত্র হবে না। সব কিছু হজমে গন্ধহীন হাওয়া হয়ে ঢেকুরের সাথে অথবা কস্তুরীর মত সুগন্ধময় ঘাম হয়ে নির্গত হয়ে যাবে। (মুসলিম ২৮৩৫নং)
প্রশ্ন হতে পারে, জান্নাতীরা যদি চিরসুখী, চিরবিলাসী, জান্নাতে যদি ক্ষুধা নেই, পিপাসা নেই, প্রস্রাব নেই, পায়খানা নেই, তাহলে জান্নাতীরা পানাহার করবে কেন? মহান আল্লাহ তো বলেছেন, তোমার জন্য এটাই থাকল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং নগ্নও হবে না। সেখানে পিপাসার্ত হবে না এবং রোদ্র-ক্লিষ্টও হবে না। (ত্বাহাঃ ১১৮-১১৯)
আসলে পানাহার ক্ষুধা অনুভব করার পর নয়, ক্ষুধা নিবারণের জন্যও নয়। বরং তা অতিরিক্ত সুখ ও তৃপ্তি দান করার জন্য।
সোবাহান আল্লাহ! কতই না মুখরোচক সেই সব আহারাদি। জান্নাতী মমিন মুসলমানরই খুবই প্রীত হইবে।
অতএব (হে জ্বিন ও মানুষ!) তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



