আমার অনেক বাল্যকালে কানাই ছিলেন দোহারের বিশেষ করে জয়পাড়া, চর লটাখোলা, পূর্বচর, রামনাথপুর, রাধানগর, বিলাসপুর, হরিচন্ডী ও এর আশেপাশের সব এলাকার মানুষের কাছে অনেক জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। আবাল –বৃদ্ধ-বণিতা এমন কেউ ছিল না যে তাকে এক নামে চিনতো না। কেননা, তিনি সবাইকে নদী পার করতেন। নদীমাতৃক দোহার উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের জন্য জয়পাড়া সদরে তথা দেবীনগরের হাটে আসা-যাওয়াটা সেই আমলে খুবই কঠিন ছিল। এই অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল জয়পাড়া ও দেবীনগরের হাট। সেই সময়ে এখনকার মতো এতো বেশী রাস্তা-ঘাট ছিল না। ছিল না সেতুর কারবার। কোথাও বাঁশের সাকো ছিল। ফলে মানুষ খেয়া নৌকার উপর বেশী নির্ভরশীল ছিল।
বিশেষ করে ভরা বর্ষার মৌসুমে যখন নদী-খাল-বিল পানিতে কানায় কানায় ভরে যেত তখন নদীর এপার থেকে ওপার যেতে কানাইয়ের সেবা নিতে হতো বিরাট সংখ্যক মানুষকে। কানাইয়ের খেয়া পার হয়ে মানুষের প্রতিদিনের জীবন যেন পূর্ণতা পেত।
সেই আমলে দোহারে আনাচে কানাচে এখনকার মতো বাজারের ছড়াছড়ি ছিল না। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে হাট বসতো। অন্যান্য দিনে বসতো বাজার । ফলে সপ্তাহের হাটটি ছিল সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেশীর ভাগ মানুষই সাপ্তাহিক বাজারের বেশীর ভাগ মালামাল কিনতেন জয়পাড়া দেবীনগর হাট থেকে। কৃষকের ক্ষেতে উৎপাদিত পণ্যসমূহ বিক্রি হতো এই হাটে। এখান থেকে পাইকাররা এসে মালপত্র কিনে দূরের বড় বড় গঞ্জে নিয়ে যেত।
সেই সময় বড় বড় হাট ও বাজারের বার ও তারিখ পর্যন্ত মানুষের মুখস্ত থাকতো। যেমন- বিষ্যুদবার জয়পাড়া দেবীনগরের হাট, শুক্রবার মেঘুলার হাট, সোমবার – কোমরগঞ্জের হাট, বুধবার বান্দুরার হাট ইত্যাদি। এই সব হাটে আশেপাশের উপজেলার মানুষজন বিপুল সংখ্যায় আসতেন তাদের পণ্যদ্রব্য কেনা-বেচা করতে।
এই সময় কানাই এর খেয়ায় বিপুল চাপ পড়তো। খেয়ায় উঠার জন্য নদীর উভয়পারে অনেক মানুষ লাইন ধরে অপেক্ষা করতো। এক পর্যায়ে কানাই বাবু একটা বুদ্ধি করলেন। নৌকা চালানোর কঠিন কাজকে সহজ করার জন্য নৌকার দুই মাথায় দড়ি বাঁধলেন । এপর নৌকায় উঠার পর উৎসাহীরা টেনে নিয়ে নৌকা অপর পারে যেত।
কানাই বাবুর সব চেয়ে বড় সুবিধা ছিল তিনি হাজারে হাজারে মানুষ পার করতেন । কিন্তু কেউই তাকে নগদ সেলামী দিত না। তিনি বছরে একবার মাত্র দক্ষিণা নিতেন। তাও আবার টাকা নিতেন না। বেশীর ভাগই নগট টাকা দিত না। ব্যতিক্রম থাকতে পারে।
সেই আমলে যখন কৃষকের ঘরে নতুন ধান আসতো তখন কানাই বাবু তার নৌকা নিয়ে বাড়ি যেতেন দক্ষিণা নেবার জন্য। নৌকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেতেন। এক সময় পাকা সোনার ধানেতে ভরে উঠতো তার সোনার তরী।
কানাই এর সময় ও তার পরবর্তীতে অনেক খেয়া ও তাদের সেবা দেখেছি। টাকা না দিলে বকা ঝকা করতে দেখেছি অনেক মাঝিকে। অথচ কানাই গণহারে পার করতেন। কোন হিসাব রাখতেন না কে পার হলো আর কে পার হলো না।
আজ অনেক বছর পর কানাইয়ের খেয়া/গোদারার কথা খুব মনে পরছে। কানাইয়ের মতো উদার মানুষ এই আমলে থাকলেও খুব বেশী নেই্। এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪