স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে আমার ভালো লাগে। কারণ সেখানে যুক্তি খুঁজার জায়গা বেশি। কিন্তু লিখতে গেলে সাহস পাইনা। যাহোক সরাসরি মূল আলোচনায় আসি। আমি বহুগামিতা নিয়ে অনেকদিন ধরে ভাবছি। নিঃসন্দেহে বিষয়টা সামাজিকভাবে স্পর্শকাতর, কিন্তু নিষিদ্ধ নয় আর কি। আমার মনে হয় এই বিষয়টা নিয়ে যতোটা লেখা বা আলোচনা করা দরকার ছিল তার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। কারণ আমার নজরে তেমন গুরুত্বপূর্ণ লেখা আসেনি। আমি নিজেও এবিষয়ে একেবারে নবিশ বলতে পারেন। তাই সম্পূর্ণ সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখতে প্রবৃত্ত হলাম।
শিশুকালে আমাদের যেসব অকথিত সামাজিক শিক্ষা দেয়া হয় তার মধ্যে একটি হচ্ছে একজন পুরুষের জন্য একজন নারী। সেজন্য একাধিক বিয়ে করা ব্যক্তিকে আমরা ভালো চোখে দেখিনা। তবুও সেটা আমাদের মন সয়ে নিয়েছে কারণ সেটা বৈধ। উদাহরণও অপ্রতুল নয়। কিন্তু সেটা শুধু পুরুষ মানুষের বেলায় সত্য। একজন পুরুষ ২ জন স্ত্রী কে নিয়ে বাস করতে পারে, কিন্তু একজন মহিলা তা পারেনা। সবাই বলবে ধর্মীয় বিধিনিষেধ। কিন্তু এই ব্যাপারটা তো সকল ধর্মেই সাধারণ। তবে কোন কোন ধর্মে একজন মহিলাকে এক স্বামী ত্যাগ করে অন্য স্বামী গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু একই জিনিস আমরা পুরুষের ক্ষেত্রে যতো সহজভাবে নেই নারীর ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা ততো সহজ না। স্ত্রী মারা গেলে নতুন বিয়ে করা পুরুষকে সমাজে কোন সম্মানহানিকর অবস্থায় পড়তে হয়না। কিন্তু মহিলার ক্ষেত্রে? তার ক্ষেত্রে আমরা নানা কথা বলি। কিন্তু কেন? এটা কি আমাদের সমস্যা। আমার তা মনে হয় না। আমাদের ধর্মগ্রন্থ ও সামাজিক ব্যবস্থাগুলিতে পুরুষের বহুগামিতা বৈধ ও সহজ কিন্তু নারীর বহুগামিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবৈধ, কঠিন ও মানহানিকর করা হয়েছে। কেন? হাজার হাজার বছর আগের সমাজেও পুরুষের বহুগামিতা স্বাভাবিক ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর বহুগামিতাও দ্যাখা গেছে। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে নারীর বহুগামিতা ঘৃণিত ও বিসর্জিত হয়েছে। কিন্তু পুরুষের বহুগামিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এখন বহুগামি নারী সমাজ খুঁজে পাওয়া যায়না। বহুগামি নারী অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু তা অবশ্যই ঘৃণিত ও সমাজ বাস্তবতার পরিপন্থী। তাহলে কি বহুগামিতা শুধুমাত্র পুরুষের জন্য?
আধুনিক সমাজ সভ্যতা বলবে হ্যাঁ ঠিক তাই। বহুগামিতা শুধুমাত্র পুরুষের জন্য। যদিও জীববিজ্ঞানের দিক থেকে ভাবতে গেলে সেটা স্বাভাবিক মনে হয়না। কারণ পুরুষ ও নারীর সংখ্যা পৃথিবীতে প্রায় সমান। তাহলে কাহিনী কি? কাহিনী হচ্ছে পুরুষের মস্তিষ্কের আকার নারীর চেয়ে বড়, তাই সে বেশি বুদ্ধিমান, তার দৈহিক আকার বড়, শক্তি বেশি, সবমিলিয়ে সে নারীর উপর প্রভুত্ব করার সামর্থ্য রাখে। তাছাড়া সন্তান ধারণের ভার নারীর উপর, নারী দুর্বল, তার সন্তান উৎপাদনের সময় সীমা পুরুষের তুলনায় সীমিত। তাছাড়া যেহেতু বহুগামিতা বিষয়টি মোটের উপর ভালো দৃষ্টিতে দ্যাখা হয় না আর সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্ক পিতার চাইতে গভীর তাই মায়ের বহুগামিতা সন্তানের মনে গভীর দাগ কাটে। এসব কারণে বহুগামিতা পুরুষের জন্য অনেকটা একচ্ছত্র। বহুগামি নারীকে আমরা কি খারাপ দৃষ্টিতেই না দেখে থাকি।
হিন্দু শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রৌপদী এই দুইটা বহুগামি চরিত্র আছে। শ্রীকৃষ্ণ হিন্দুদের একজন মহান দেবতা বা অই জাতীয় চরিত্র। তার লীলাখেলা হিন্দুরা শ্রদ্ধার চোখে দ্যাখে। অথচ দ্রৌপদীকে বলা হয় নষ্টা, চরিত্রহীনা। কারণ সে নারী। কাজে কোন পার্থক্য নেই। রাজা দশরথের ছিল তিন স্ত্রী, তাও একই সাথে বর্তমান। অথচ তার পুত্রবধূ সীতাকে বহুগামিতার সন্দেহে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিলো। অনেকেই সীতার পক্ষে কথা বলেছে এই কারণে যে সে হয়তো বহুগামি ছিলোনা। কিন্তু বহুগামিতা অন্যায় নয় এই কারণে একজনও সীতার পক্ষ নেয়নি। ব্যাপারটা খেয়াল করুন।
তার মানে এটাই দাঁড়ালো নারীর বহুগামিতামাত্রই অন্যায়। অথচ পুরুষের ক্ষেত্রে আমরা সেটা আমলেই নেইনা। বিবর্তন আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে গেছে। ইসলাম ধর্মে পুরুষের বহুগামিতা আরও প্রকট। ইসলামের মহানবীর স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১১ মতান্তরে ১৩ মতান্তরে আরও অনেক বেশি। যদিও তিনি মুসলিম পুরুষের জন্য ৪ টি স্ত্রী বৈধ করেছেন। নারীর জন্য কিন্তু ১ জন পুরুষই রেখেছেন। সব থেকে মারাত্মক ব্যাপার হল বেহেশতের বর্ণনায় পুরুষের জন্য ৭২ হুরী বরাদ্দ, কিন্তু নারীর জন্য শুধুই স্বামী সেবার সুযোগ। তার মানে ইসলাম ধর্মে প্রভু আল্লাহ্ পুরুষের বহুগামিতা সহি করেছেন আর নারীর বহুগামিতা করেছেন নিষিদ্ধ।
আমি ধর্মীয় দিক থেকে আর কথা বাড়াবো না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর বহুগামিতার কিছু সুযোগ থাকে। ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্মে স্বামী মারা গেলে বা বিবাহ বিচ্ছেদ হলে বিয়ে করার সুযোগ থাকে নারীর। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় বিষয়টা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমি সমাজকে সভ্যতার সরাসরি সন্তান ভাবি, তারপরে ধর্মকে। তাই আমার কাছে পুরুষের বহুগামিতা খুবই স্বাভাবিক এবং নারীর বহুগামিতা অস্বাভাবিক মনে হয় যুক্তিসঙ্গত কারণেই। পুরুষের বহুগামিতাই সমাজকে পুরুষতান্ত্রিক করেছে। অথবা বিপরীত। আসলে পুরুষ প্রকৃতিগতভাবেই বহুগামি।
এবার কিছু আরও বাস্তব জিনিসে চোখ রাখি। সিনেমার জগতে আপনার প্রিয় চরিত্র কোনটা? আমার ফেভারিট জেমস বন্ড। বিশ্বব্যাপী জেমস বন্ডের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। এর কারণ সে বহুগামি। আমিসহ যারা তাকে পছন্দ করি তারা নিজের মাঝে জেমস বন্ডকে বসাই। আসলে সকল পুরুষই বহুগামি হতে চায়, তাতে সে গৌরববোধ করে, অপরাধবোধ করেনা। অনেক মেয়েও জেমস বন্ডকে ভালোবাসে। অনেকেই বন্ডগার্ল হবার স্বপ্ন দ্যাখে। আমি কোন মেয়ের কাছে বন্ডের বহুগামিতার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শুনিনি। লিজ টেইলরের নাম কে না জানে? ৯ জন স্বামী ছিল তার। আর সম্পর্ক গড়িয়েছিল আরও কতজনের সাথে হিসাব নেই। তার এই বহুগামিতা আলোচনার বিষয়বস্তু বটে। কিন্তু বন্ড চরিত্রের বহুগামিতা আর টেইলরের বহুগামিতার মধ্যে প্রকৃতিগত বিভেদ না থাকলেও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে আকাশ পাতাল ফারাক। বন্ডেরটা স্বাভাবিক, টেইলরেরটা ঘৃণিত। আজ পেপারে দেখলাম ভারতবর্ষের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউনটব্যাটেনের স্ত্রীর বহুগামিতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। এবং সেটা প্রকাশ করেছেন তাদেরই এক কন্যা। সমালোচনার জোয়ার বইছে তাতে। কিন্তু এপর্যন্ত কতো অসংখ্য ব্যক্তি পিতার বহুগামিতা নিয়ে মুখ খুলেছেন সেটা লোকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে।
অনেক লম্বা লেখা লিখলাম। এবার শেষ করি। পতিতালয় আমাদের সমাজে নারী বহুগামিতার একটা স্বাভাবিক নিদর্শন। তাহলে তো নারী বহুগামিতা চর্চিত হচ্ছেই। তাহলে কি আমার ব্যাখ্যা ভুল? খেয়াল করুন। পতিতারা সমাজ বিচ্ছিন্ন। তারা সমাজের কেউ নয়, তারা পণ্য মাত্র। কিন্তু তারা যাদের উপযোগ দেয় সেসব পুরুষ সকলেই সামাজিক জীব। পুরুষের বহুগামিতা সমাজ ও ধর্মের বেড়াজালে যখন সমাজের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে তখনই পতিতালয়ের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে পতিতালয় পুরুষ বহুগামিতাকে আরও বৈধ আরও সহজ করেছে। নারীদের জন্য পতিতালয় নেই, আর থাকবেও না। কারণ প্রকৃতিগতভাবে নারীরা বহুগামি নয়। তবে সব ক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম আছে।