বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ১৯তম জাতীয় কাউঞ্চিল হয়ে গেলো গত ২৯শে ডিসেম্বর। আওয়ামীলীগের কাউঞ্চিল নিয়ে আমার আগ্রহের কারণ দলটি দেশের প্রাচীনতম ও দেশের নেতৃত্বদানকারী দলগুলোর মধ্যে একমাত্র দল যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছিলো। আমি ইতিহাসপ্রিয় লোক। আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে কিছু বলি। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বাংলা প্রদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুখ্যমন্ত্রী হন। তখন পুরো ভারতবর্ষে শুধুমাত্র বাংলা ছাড়া অন্য কোন প্রদেশে মুসলিম লীগ একক সরকার গঠন করতে পারেনি। তাই বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর বিপুল জয় ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে এই জয় না আসলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই আসতো না। তাছাড়া ১৯৪৬ এর ১৬ই আগস্ট কলকাতায় যে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হয় সেখানে মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর অনুসারীরা (শেখ মুজিব তাদের একজন)।
এই দাঙ্গার ফলেই ভারত পাকিস্তান ভাগ নিশ্চিত হয়। তাই মুসলিম লীগে জিন্নাহর চেয়ে সোহরাওয়ার্দী একক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠতে থাকেন। হিন্দুপ্রধান কোলকাতাতেও মুসলিম সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একক নেতা। তিনি কোলকাতার ২ টি আসন থেকেই পাশ করতেন। আর তখন বাংলার রাজধানী ছিল কোলকাতা। তাই জিন্নাহ শিবিরে সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে ভয় ছিল। তবে জিন্নাহকে সোহরাওয়ার্দী নেতা মানতেন। কিন্তু জিন্নাহর অনুসারী পশ্চিমের অন্যান্য নেতারা ভাবলেন বৃদ্ধ জিন্নাহর মৃত্যুর পর সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের একক নেতা হয়ে উঠবেন। তাই তারা ভারত ভাগের সময় যেকোনো মুল্যে কোলকাতা বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে জিন্নাহর সায় ছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন কোলকাতা পাকিস্তানে থাকলে করাচীকে রাজধানী করা যাবেনা আর পূর্ব বাঙলাকে শোষণও করা যাবেনা। বাঙালিদের অকথিত নেতা সোহরাওয়ার্দী হয়ে উঠবেন সর্বেসর্বা। তাই যে বাঙালিদের ভোটে ও রক্তে পাকিস্তান আসলো তাদের ও তাদের নেতাকে বঞ্চিত করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হল। স্বাভাবিকভাবেই সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর অনুসারীরা ব্যথিত হয়েছিলেন। কিন্তু অবশিষ্ট পূর্ববাংলাতেও সোহরাওয়ার্দীর ব্যাপক সমর্থন থাকায় সোহরাওয়ার্দীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলল মুসলিম লীগে। জিন্নাহর তাতে সায় ছিল। ১৪ই আগস্ট,১৯৪৭ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্বাভাবিকভাবেই পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বহাল থাকার কথা সোহরাওয়ার্দীর। কিন্ত কুচক্রীরা বলে দলের মধ্যে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব যাচাই করতে হবে। এমতাবস্থায় পশ্চিমাদের ইন্ধনে এবং সোহরাওয়ার্দীর অনুপস্থিতিতে ৩ ভোটের ব্যবধানে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য খাজা নাজিমুদ্দিন মনোনয়ন পান। আসলে এগুলো সবই ছিল চক্রান্ত, টাকার খেলা। তখন সোহরাওয়ার্দী ভারতীয় নাগরিক, পাকিস্তানে তখনও আসেন নি। তাই কুচক্রীদের মধ্যে চলল ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা। মুসলিম লীগ থেকে সোহরাওয়ার্দীপন্থীদের পরিকল্পিত ভাবে বাদ দেয়া হল এবং বের করে দেয়া হল। শেখ মুজিবের মতো যারা কোলকাতার শীর্ষ ছাত্রনেতা ছিলেন এবং পূর্ব বঙ্গের নাগরিক ছিলেন তাঁরা এসময় ঢাকায় এসে আশ্রয় নেন এসব চক্রান্ত মোকাবেলার জন্য। আসামে সোহরাওয়ার্দীর ব্যাপক প্রভাব ছিল আর আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন মৌলানা ভাসানি। তাই আসামকেও পাকিস্তান থেকে বাদ দেয়া হয়। কপর্দকশূন্য অবস্থায় টাঙ্গাইলে চলে আসেন ভাসানি সাহেব। নাজিমুদ্দিনের অধীনে নতুন মুসলিম লীগের কমিটিতে এদের কাউকেই রাখা হলনা। ফলে সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা সংগঠিত হতে থাকে। কোলকাতা থেকে একে একে মুসলিম নেতারা ফিরে আসেন ঢাকায়। সোহরাওয়ার্দী চলে যান করাচী। ভারত সরকার তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ক্রোক করে তাঁকে দেশ থেকে বহিস্কার করে। এমন দুর্দিনে পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামীরা অসহায় হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার সকল স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে থাকে। এদিকে শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল'তে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে ছাত্রদের নেতা হয়ে উঠেন অল্পদিনেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করার পিছনে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রধান। ১৯৪৮ সালে আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগ (বর্তমান ছাত্রলীগ) গঠন ছিল এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কোন রাজনৈতিক সংগঠন ছিলোনা। আসলে ছাত্রলীগ গঠন ছিল আওয়ামীলীগ গঠনের জন্য জনসমর্থন আদায়ের একটি পূর্বশর্ত। কারণ সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা বুঝতে পেরেছিলেন মুসলিম লীগের সাথে আর রাজনীতি করা যায়না। ওটা দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিলো। ছাত্রলীগ গঠণের সময় কাকে সভাপতি করা হবে তা নিয়ে মতভেদ হয়েছিলো। সোহরাওয়ার্দীর ১ নম্বর কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব সভাপতি হবে এটাই সবাই ভেবেছিলেন। কিন্তু আবদুল মতিন (ভাষাসৈনিক, এখনো জীবিত) বললেন, মুজিব কোলকাতায় পড়ালেখা করেছে, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি। মুজিবের চেয়ে আমাদের অধিকার বেশি। তিনি সভাপতি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে সভাপতি না করে সবাই শেখ মুজিবকেই সমর্থন দেয়। মতিন আর ছাত্রলীগে আসেন নি পরে। ছাত্রলিগের এই ঐতিহাসিক কমিটিতে তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এছাড়া মুনির চৌধুরীর বোন লিলি চৌধুরী এই কমিটিতে ছিলেন। এরপর টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীপন্থী তরুণ স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুল হক শক্তিশালী প্রবীণ মুসলিম লীগ প্রার্থীকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করেন। এরপর থেকেই মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ হয়ে পড়ে আর নতুন একটি দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন আওয়ামীলীগ গঠিত হয়। এসময় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবির পক্ষে কথা বলার কারণে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও জেলহাজতে প্রেরণ করা হয় (সম্প্রতি এই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হয়েছে)।
সবকিছুই সোহরাওয়ার্দীর পরোক্ষ নির্দেশে হচ্ছিলো। প্রথমে আঞ্চলিক/প্রাদেশিক দল হিসেবে পূর্ব বাংলা আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে এই দলটি আত্মপ্রকাশ করে। দলের আঞ্চলিক সভাপতি হন মৌলানা ভাসানি। আর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাংলার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সংগঠনের জাতীয় কমিটির নেতা হবেন। পরে তাই হয়। সাধারণ সম্পাদক হন দলের একমাত্র সংসদ সদস্য শামসুল হক। সহ সভাপতিদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ। জয়েন্ট সেক্রেটারি হন জেলে বন্দী শেখ মুজিব। খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ প্রচার সম্পাদকের পদ পান প্রথম কমিটিতে। পরে এই দলই পাকিস্তান আওয়ামীলীগ নাম ধারণ করে। এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী সকল সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। আজ আর লিখবনা। কাল ১৯৫৪র নির্বাচন নিয়ে লিখবো।