আবু সোহায়েল : বিরোধীদলীয় নেতা এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ১৯৯১ সালে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ৫০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫ কোটি টাকা দিয়েছিল- এই সাজানো খবরের ওপর ভর করে সরকারি মহল বেগম জিয়াকে জনপ্রিয়তার আসন থেকে টেনে নামাবার জন্য যে বিরাট লম্ফ দিয়েছিল তা এখন বুমেরাং হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের এ ব্যর্থ লম্ফ প্রদান তাদেরকে মাটির ওপরে আছড়ে ফেলেছে। কান্ডজ্ঞানহীন এমন লম্ফ এভাবে বুমেরাংই হয়ে থাকে। প্রকাশ পেয়েছে, ভারতীয় সাংবাদিক দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে এই খবর সাজিয়েছেন এবং একাধিক মাধ্যমে প্রকাশও করেছেন। আরও জানা গেছে, ভারতে বাংলাদেশ বিরোধী একটা শক্ত লবি কাজ করছে বিভিন্ন মিডিয়ায়, দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী তারই একটা অংশ। এই লবিটি বহুদিন আগে থেকেই বাংলাদেশে বিভেদ-বিতন্ডা সৃষ্টির লক্ষ্যে অব্যাহতভাবে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের সরকারি মহল আবারও তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে।
প্রকাশিত সূত্রসমূহ থেকে জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে পাকিস্তানী গোয়েন্দাসংস্থা আইএসআই'র একজন সাবেক প্রধান তাদের বিশেষ কার্যক্রমের ওপর একটা এফিডেভিট করেছিলেন। তাতে তিনি পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের কাকে কত টাকা দেয়া হয়েছিল তা প্রকাশ করেন। এই খবরকেই ভারতীয় সাংবাদিক দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী বাংলাদেশে অন্তর্ঘাত সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করেন। দুবাইয়ে ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত পত্রিকা খালিজ টাইমস-এর ৩ মার্চের অন লাইন সংস্করণে তিনি লিখেন, Another Rs. 50 Million was allegedly paid to Bangladesh's Khaleda Zia to help her in Polls against Hasina Wajid's Awami League generally perceived by Pakistan's security establishment as pro.India.
অর্থাৎ পাকিস্তানের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনাকে ঠেকাতে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদাকে পাঁচ কোটি রুপি দেয় আইএসআই। এই সাজানো খবরটি খালিজ টাইমস-এর অন লাইন ভার্সনে প্রকাশিত হওয়ার পরদিন ৪ মার্চ প্রথম আলো তার অন লাইন ভার্সনে খালিজ টাইমস-এর বরাত দিয়ে প্রচার করে। মজার ব্যাপার, খালিজ টাইমস এবং প্রথম আলো দুই নিউজের উৎস দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী। উল্লেখ্য, দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী প্রথম আলোর নয়াদিল্লীস্থ সংবাদদাতা। লক্ষণীয় মিস্টার দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী খালিজ টাইম-এর তার নিজের নিউজের বরাত দিয়েই প্রথম আলোর নিউজটি তৈরি করেছে। মিস্টার দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর কৃতিত্বের এখানেই শেষ নয়। ১৫ মার্চ এই মি. দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী ডেইলী মেইল-এর ভারতীয় অন লাইন সংস্করণে লিখেন, "Recently a UAE-based daily had alleged that ISI paid Rs socrore to BNP Chairperson and former PM Khaleda Zia ahead of the 1991 elections in which the BNP won and formed the government. অর্থাৎ সম্প্রতি আরব আমিরাতের একটি দৈনিক অভিযোগ করেছে আইএসআই বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে আইএসআই ৫০ কোটি টাকা দিয়েছিল এবং বেগম জিয়া ঐ নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেন। এখানে লক্ষণীয়, দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী খালিজ টাইমস-এ বলেছিলেন, ৫০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫ কোটি টাকার কথা এবং ৪ মার্চ প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্টে একথাই বলেছিলেন। কিন্তু একই দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী ডেইলি মেইল-এর খবরে লিখলেন ৫০ কোটি টাকার কথা। মাত্র ১১ দিনের ব্যবধানে ৫ কোটি ৫০ কোটিতে উন্নীত হলো। সম্ভবত খালিজ টাইম ও প্রথম আলোতে ৫ কোটি লেখার পর দীপাঞ্জনদের বোধোদয় হয় যে, ৫ কোটি টাকা একজন পার্থীর জন্য অনেক সময় যেখানে যথেষ্ট হয় না সেখানে একটা দল কিভাবে ৫ কোটি টাকা গ্রহণ করে- এই চিন্তা থেকেই ডেইলি মেইল-এ ৫ কোটিকে ৫০ কোটি করা হয়। ডেইলি মেইল-এর একদিন পর ১৬ মার্চ দীপাঞ্জন রায় ভারতীয় সাপ্তাহিক ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনে ডেইলি মেইল-এর নিউজটি পরিবেশন করে। এখানেও ৫০ কোটি টাকা বলা হয়। ডেইলি মেইল-এর সংবাদটি বাংলাদেশের সরকারি সংবাদসংস্থা বাসস হুবহু প্রচার করে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ কাগজেই বাসস-এর বরাদ দিয়ে এই খবরটি প্রকাশিত হয়।
এই হলো আইএসআই-এর কাছ থেকে বেগম জিয়ার টাকা নেয়ার সাজানো খবরের ইতিবৃত্ত। বাংলাদেশের সরকারি মহল কোনো প্রকার বাছ-বিচার না করে এ খবর গলধকরণ করে। তারা এটাকে বেগম জিয়াকে কুপোকাত করায় দুর্লভ এক সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। ৪ মার্চ প্রথম আলোতে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তাদের কথা শুরু হয়। বাসস পরিবেশিত খবর বাংলাদেশের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হবার পর বেগম জিয়ার প্রতি তাদের আক্রমণ আরো ধারালো হয়ে ওঠে। অনেকেই এ নিয়ে কথা বলেন। মন্ত্রীরাও বলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার বললেন। গত পরশু আইন প্রতিমন্ত্রী রাজশাহীতে একটি আদালত ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে বলেন, '৭১ সালে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর।' ঐ তারিখেই প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে আইএসআই'র কাছ থেকে টাকা নেয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, ‘এটা বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কলামিস্টের লিখিত প্রবন্ধ বা রিপোর্ট নয়। এটি পাকিস্তান হাইকোর্টে আইএসআই'র সাবেক প্রধানের দেয়া জবানবন্দী। সুতরাং বেগম জিয়া কিভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করবেন।' এর আগে ১৪ তারিখের মহাসমাবেশে এই প্রসঙ্গ তুলে বেগম জিয়াকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেন।
এর দ্বারাই বুঝা যায় দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীদের সাজানো খবরকে আমাদের সরকারি মহল এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত কতটা বিশ্বাস করেছেন। খবরটিকে আস্থায় না নিলে প্রধানমন্ত্রী অন্তত এ ধরনের কথা বলতে পারতেন না। এখানেই দীপাঞ্জন বাবুদের সাফল্য এবং আমাদের ব্যর্থতা। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, সরকারি মহলের জন্য এ ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয়। চিলে কান নিয়েছে শুনেই কানে হাত নিয়ে চিলের পিছনে ছুটা অন্তত সরকারি মহলের মানায় না। এতবড় একটা সেনসেটিভ খবর পাওয়ার পর অন্তত মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী কথা বলার আগে সরকারি সূত্রে এই নিউজটি যাচাইয়ের প্রয়োজন ছিলো। বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত পরশু এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, আইএসআই'র সাবেক প্রধান সুপ্রিমকোর্টে যে এফিডেভিট করেছিলেন তার কপি তারা যোগাড় করেছেন এবং এই এফিডেভিটে খালেদা জিয়া বা বিএনপিকে টাকা দেয়ার কোনো কথা নেই। সরকারও চেষ্টা করলে এই এফিডেভিট যোগাড় করতে পারতেন। এই না করাটা একটা মারাত্মক বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতিরই সুযোগ গ্রহণ করছে দীপাঞ্জন বাবুরা। জানা গেছে, দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী গোষ্ঠী হিরন্ময় কারলেকারদের গ্রুপেরই একজন সদস্য। মিস্টার দীপাঞ্জন রায় মিস্টার হিরন্ময় কারলেকারের একজন সোর্স। হিরন্ময় কারলেকারের বাংলাদেশ বিরোধী গ্রন্থ Bangladesh : Next Afganistan-এ দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীদের ঋণ স্বীকার করা হয়েছে। কারলেকারের এই বইটিতে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির কুৎসা রটনা করা হয়েছে এবং এই সাথে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র দেখাবার জন্য বাংলাদেশে আইন-শৃক্মখলা বাহিনী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইন-শৃক্মখলা বলতে যে কিছু নেই এবং বাংলাদেশ থেকে মানুষের স্রোত অব্যাহতভাবে ভারতে প্রবেশ করছে- এমন অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
এই মতলবীদের সাজানো একটা নিউজ আমাদের বিভ্রান্ত করতে পেরেছে, বোকা বানাতে পেরেছে, এটা ভেবে দেখার মতো একটা বিষয় বলে মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। তাদের সাজানো নিউজটি কিছু সময়ের জন্যে বিরোধী দলকে বিব্রত করেতে পেরেছিল, তেমনি সরকারি দল ও মহলকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে সরকারি মহল একটা সাজানো নিউজের ওপর ভর করে যতটা উঁচুতে লাফ দিয়েছিলেন তার আগেই ৩ ও ৪ মার্চের নিউজের সাথে ১৫ ও ১৬ মার্চের নিউজের যে বিরাট অসঙ্গতি, অন্তত এটা তাদের নজরে পড়া উচিত ছিলো। ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে'- এই মানসিকতা থেকে আমরা মুক্ত থাকলে বিষয়টা নজরে পড়তো বলে অভিজ্ঞমহলের বিশ্বাস।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




