আজ আমার বউয়ের বিয়ে। ওর দ্বিতীয় বিয়ে এটি। প্রথম বিয়ে করেছিল আমাকে, দ্বিতীয় বিয়ে করছে ওর প্রেমিক কিশোরকে। কিশোর ছেলেটা সহজ সরল। আমার বউ নারীবাদী জাদরেল মেয়ে। আমাকে যা বলে আমি তা মেনে নেই। কথা বাড়াই না, তর্ক করি না, কোন কথায় অভিযোগ সাজাই না। আমাকে সেদিন বলল, "আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিশোরকে বিয়ে করব।"
আমি চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম সিলভিয়ার কথা শুনে। কিছু বলিনি। ও বলে যায়, "এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী?"
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলি, "আমার এ ব্যাপারে কোন মতামত নেই।"
সিলভিয়া চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের কোণায় রেখে বলে, "তুমি আমার হাসবেন্ড, তোমার মতামত অবশ্যই থাকা উচিৎ।"
আমি চা শেষ করে কাপটা চশমটার পাশে রেখে বলি, "তুমি যা ভাল মনে করবে, তাই করবে। আমার কোনো আপত্তি নেই।"
"আপত্তি নেই, তা মুখে বললে হবে না। আমি উকিল ডাকব, তুমি জবানবন্দী লিখে দিবে যে তোমার এ বিয়ের ব্যাপারে আপত্তি নেই।"
"এসবে উকিল ডাকার কী দরকার?"
"দরকার আছে। সব ব্যাপারে সব কিছু স্বচ্ছ থাকা ভালো।"
শেষমেশ উকিল ডাকা হয় নি। ডাকা হয়েছিল কিশোরকে। সিলভিয়া কিশোরকে দেখিয়ে বলে, "তুমি ওকে বলো, তোমার এ বিয়েতে কোনো আপত্তি আছে কি না।"
আমি মাথা নেড়ে হাসি মুখে বলি, "কোনো আপত্তি নেই।"
আমি থাকি ঘর জামাই। ঘর জামাইয়ের আপত্তি অনাপত্তি খুব একটা গুরুত্ব সহকারে দেখার কথাও না। কিশোর ছেলেটাকেও সিলভিয়া ঘর জামাই হিসাবে ঘরে তুলে আনছে। আমি আরেকটা বিয়ে করলে সে হত সিলভিয়ার সতীন, এখন কিশোর আমার কী হবে, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। একবার ভেবেছিলাম কিশোরকে ডাকব দুলাভাই বলে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঝামেলা হলো, সিলভিয়া তাহলে আমার বোন হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কে। আমি তা চাই না। মেয়েটা তো আমাকে ডিভোর্স দেয় নি। আমাকে খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে। কিশোরকে এনেও খাওয়াবে পরাবে। শুধু শুধু মেয়েটাকে বোন বানিয়ে সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি করার কোন মানে হয় না। তার চেয়ে ওকে আমি ডাকতে পারি, ছোট ভাই। আমি যেহেতু সিলভিয়ার সিনিয়র ঘর জামাই। সে হিসাবে আমার একটা ভাবসাব থাকা উচিৎ। আর কিশোর ছেলেটাও যেমন সহজ সরল বলে মনে হলো, আমার ধারণা দু চারটা ধমকি ধামকি দিলে সুরসুর করে আমাকে সালাম দিয়ে চলবে।
আমি আর আমার শ্যালিকা সিন্থিয়া দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিলভিয়া আর কিশোরের বিয়ে দেখছি। দুজনে মুখে একটা ভারী ভাব ফুটিয়ে রেখেছি। সিন্থিয়া আমার পাশে এসে বলল, "দুলাভাই, তোমার কি মন খারাপ?"
আমি ভারী ভাব তাড়িয়ে হাসি ফুটিয়ে বললাম, "কী যে বলো? আমার বউয়ের বিয়ে হচ্ছে, কত আনন্দের একটা দিন আমার।"
"ফাজলামি না, আমি সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি।"
"আমি ঘর জামাই মানুষ, আমার খারাপ লাগার কী আছে?"
"তুমি নিজেকে এমন ছোট করো কেন সবসময়? আমি জানি তুমি কী!"
আমি কিছু বলি না। সিন্থিয়া কাঁপা কাঁপা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই।
সিলভিয়ার বাবার অফিসে আমি চাকরি করতাম। পাশ করে বের হয়ে বেকার ঘুরে বেড়াবার দিনগুলোতে চাকরিটা আমার বড় প্রয়োজন ছিল। আমার একমাত্র ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছিলাম আমি এই চাকরি করে। বাবা মা মারা গিয়েছেন অনেক আগে, সে হিসাবে ছোট বোনের বিয়ের পর আমি একদমই একা হয়ে গিয়েছিলাম। শাহাজাহান সাহেব মানে সিলভিয়ার বাবা, একদিন আমাকে ডেকে বলেন, তিনি আর মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন। শুধু ভাল ছেলে হলেই চলবে। টাকা পয়সা থাকতে হবে না।
আমি বলি, "স্যার, খুঁজলে পাবেন।"
আমি তখনও বুঝতে পারিনি, তিনি তার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে পেয়েছেন। আমাকে হাত ধরে বলেন, "রিফাত, তোমার আপত্তি না থাকলে আমার বড় মেয়ের বিয়ে আমি তোমার সাথে দিতে চাই। আমি সিলভিয়ার সাথে কথা বলেছি, ও আমার মুখের উপরে না বলবে না।"
আমি অবাক হই, অবাক হয়ে জানাই, আমার সিলভিয়াকে বিয়ে করার মত সামর্থ্য হয়নি।
শাহজাহান সাহেব আমার সামর্থ্যের ব্যবস্থা করে দেন। বিয়েতে আমার এক পয়সা খরচ হয় না। তার মেয়ে আমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেয়। আমি হই ঘর জামাই। মাঝে মাঝে শ্বশুরের ব্যবসা দেখি, সিন্থিয়াকে পড়াই, আর বউয়ের হুকুম পালন করি। এভাবেই চলে। চলে যায়।
বিয়ের মাস পাঁচেক পরেই একসাথে দুটি ঘটনা ঘটে, এক আমার শ্বশুর সাহেব মারা যান, দুই আমি জানতে পারি সিলভিয়ার কিশোর নামের একটা ছেলের সাথে প্রেম। আমাকে একসাথে দুটি দায়িত্ব থেকে অল্প দিনের মধ্যেই অব্যাহতি দেয়া হয়। এক আমার শ্বশুরের ব্যবসার দায়িত্ব পুরোটাই সিলভিয়া নিয়ে নেয়, দুই সিন্থিয়ার হোম টিউটর হিসাবে কিশোরকে রাখা হয়। আমি সম্পূর্ণ বেকার হয়ে ঘর জামাইগিরি করি। আমার ভিতর ক্ষোভ জমে, আমি তা দমিয়ে রাখি। আমার ভিতর রাগ জমে, আমি তা উড়িয়ে দেই। সিলভিয়াকে কিছুই বুঝতে দেই না।
কিশোরের সাথে সিলভিয়ার বিয়ের পর, আমার রাতে থাকার জায়গা হলো, ড্রয়িং রুমে। আমি কিছু মনে করি না। সিলভিয়া কিশোরের সাথে দরজা লাগিয়ে একসাথে থাকে, আমি খারাপ লাগাই না। সিলভিয়া মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে আমাকে চুমো খেয়ে যায়। আমি তাতেই খুশি।
আমি জানতাম না, আমার অবচেতন মনে একটা ঘৃণার জায়গা হয়ত জমছিল সিলভিয়ার জন্য। আমার প্রতি অবহেলা গুলো কোথাও না কোথাও আটকে থাকত বুকের ভিতর, মস্তিষ্কের ভিতর। এক সময় তা জমে জমে পাহাড় হলো। সে পাহাড়ে আমি চাপা পড়ে হুট করে পালাবার পথ খুঁজতে লাগলাম। সিলভিয়ার কথার জবাব দেয়া শুরু করলাম, সিলভিয়া গায়ে হাত তুললে আমি তুললাম। নিজেকে হঠাৎ করে পুরুষ মানুষ বলে মনে হতে লাগল। কিশোর আমাকে সাহস দিলো। কিশোরও সিলভিয়ার সামনে বিড়াল হয়ে থাকে, কিন্তু আমাকে বলে বলে বাঘ হতে শেখালো। এই বাঘের বিরুদ্ধে সিলভিয়া নারী নির্যাতনের মৌখিক অভিযোগ জানিয়ে দিলো কোথাও। আমি হিংস্র হলাম, বাঘের মত হুংকার ছুড়ে একদিন সিলভিয়ার উপর ঝাপিয়ে পড়লাম। যতক্ষণ পর্যন্ত না সিলভিয়ার দেহ অসাড় হয়ে যায়, আমি আঘাতের পর আঘাত করে গেলাম। সিলভিয়া একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল। সিলভিয়ার প্রাণহীন দেহ দেখে নিজেকে পুরুষ বলে মনে হয়, নারীর কাছে হেরে যাওয়া পুরুষ না, সত্যিকারের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পুরুষ।
আমি সিলভিয়ার প্রাণহীন দেহ থেকে চোখ ফেরালাম দরজার দিকে। ওখানে সিন্থিয়া আর কিশোর দাঁড়িয়ে। আমি তাকাতেই দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি আর সিলভিয়া যে রুমটায় আছি, সে রুমটার দরজা। আমি কী করব ভেবে পাই না। সিন্থিয়াকে ডাকি, কিশোরকে ডাকি। ওরা সাড়া দেয় না। দরজায় কান রাখি আমি। স্পষ্ট শুনতে পাই, হাসির শব্দ। সিন্থিয়া আর কিশোরের।
পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে, পুলিশ আসবে। আমার বউকে খুন করার অপরাধে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। সিন্থিয়া আর কিশোরের মাঝে টিউশনির ফাঁকে যে প্রণয় সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের সবার অগোচরে, তা পূর্ণতা পাবে। আমি এখন জানি কিশোর কেন আমাকে বার বার বাঘের মত পুরুষ হতে বলত, কেন সিন্থিয়া ওর বোনকে নারীরা দুর্বল নয় বলে নাড়িয়ে দিত।
নারীবাদী সিলভিয়া মরে গেল, বদলে গিয়ে টিপিক্যাল পুরুষত্ব দেখাতে যাওয়া আমি জেলে যাব। মরে যাব। স্বার্থান্বেষী কিশোর কিংবা ডিপ্লোম্যাটিক সিন্থিয়া টিকে যাবে। জিতে যাবে।
রিয়াদুল রিয়াদ
২৩-০২-২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



