আরও প্রায় বছর ছয় আগে, আমার ৩য় উপন্যাস "মধ্য বৃত্ত" প্রকাশ পেয়েছিল। ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ধরণের উপন্যাসটি আমার নিজস্ব পছন্দের একটা লেখা। এই উপন্যাসটি আমাদের হাসান মাহাবুব (হামা) ভাইকে পড়তে দিয়েছিলাম।
তিনি সে উপন্যাস পড়ে, আমাকে উদ্দেশ্যে করে একটা খোলা চিঠি লিখেছিলেন।
সে চিঠিতে তিনি বইয়ের কাহিনী, আমার লেখার ভুল ত্রুটি কিংবা প্রয়োজনীয় বিষয় গুলো নিয়ে সোজা সাপ্টা আলোচনা করেছিলেন।
সমালোচনা ব্যতিরেকে একজন লেখকের সেরা আউটপুট বোধ করি বের করাটা ভীষণ কষ্টসাধ্য। যা নিজের খোলা চোখে আটকায় না, তা একজন বিজ্ঞ পাঠকের চোখে ঠিকই ধরা পড়ে।
হাসান ভাইয়ের চিঠি পেয়ে সে সময় যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম। তার বিভিন্ন বই পড়ে লেখা চিঠিগুলো বরাবরই আমার প্রিয়।
হাসান ভাইয়ের লেখা খোলা চিঠিটা:
প্রিয় রিয়াদ
এই যে বই নিয়ে চিঠি লেখছি, লিখতে ভালো লাগছে, এই পরিকল্পনায় কিন্তু তুমি একদমই ছিলে না। তোমার সাথে আমার সেভাবে কখনই কথা হয় নি ব্লগে বা ফেসবুকে। তুমি কী লিখছো, কী ভালোবাসো, কী তোমার ভাবনার জায়গা, তার কিছুই জানা ছিলো না। তাই এবারের বইমেলায় তোমার উপন্যাস ‘মধ্য বৃত্ত’ নিয়ে প্রায়ই পোস্ট দেখলেও সেভাবে আগ্রহ জাগে নি পড়ার। বইমেলার কোন এক সন্ধ্যায় হঠাৎ করে আমাকে মেসেঞ্জারে নক করলে। আশেপাশে ছিলে বলে দেখাও হয়ে গেলো, আমরা সময় কাটালাম কিছুক্ষণ। জানতে পারলাম যে তুমি উদ্ভাসে কোচিং করিয়েছিলে, সোহাগ ভাইকেও চেনো, ব্লগে লিখতে, আগে লিখতে রোমান্টিক ধারায়, এখন লেখার ধারা বদলে সাইকোলজিকাল থ্রিলারের দিকে মন দিয়েছো। বইটিও উপহার দিলে। খুব অল্প সময়েই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম।

যে ব্যাপারটি সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো তোমার সম্পর্কে, তা হলো তোমার নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হয়ে লেখার ধারা বদলানোর চেষ্টা। এই আত্মউপব্ধিটা খুব দরকার। তুমি তোমার নতুন ধারার লেখা সম্পর্কে আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলে। আমি থ্রিলার মুভি খুব পছন্দ করলেও বই সেভাবে পড়া হয় না। তাই অনেক হাতড়িয়েও তোমাকে ভালো কোন পরামর্শ দিতে পারি নি। বেশ বিব্রতকর ব্যাপার ছিলো সেটা। যাই হোক, এখন যেহেতু তোমার বইটা পড়া হলো কিছু বলার চেষ্টা করাই যায়!
প্রথমেই একটা ব্যাপার বলি, তুমি উপন্যাসটিকে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার বলেছো। আমার কাছে কিন্তু এটাকে পুরোদস্তূর ডিটেকটিভ থ্রিলার মনে হয়েছে। সাইকোলজিকাল থ্রিলার লেখা যদি তোমার মূল উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে সংলাপের চেয়ে বর্ণনা বেশি প্রয়োজন। বিশেষ করে চরিত্রগুলোর এক মানসিক অবস্থা থেকে আরেক মানসিক অবস্থায় উপনীত হবার ক্রান্তিক্ষণ হতে হবে মসৃণ। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারে ঘটনা থাকে কম ভাবনা থাকে বেশি। তোমার এই উপন্যাসে যে পরিমাণ জিজ্ঞাসাবাদ আছে, তাতে এটিকে নিশ্চিতভাবেই ডিটেকটিভ থ্রিলার বলা যায়।
এই চিঠি যারা পড়ছে, তাদের উদ্দেশ্যে উপন্যাসের কাহিনীটা একটু বলে নেই। প্রফেসর সাজিদ এলাহীর একজন ছাত্র নাহিন মারা গেল হঠাৎ হার্ট এ্যাটাক করে। মারা যাবার আগে সে পরীক্ষায় ফেল করার জন্যে প্রফেসর সাহেবকে দোষারোপ করে গেছে। এর ফলে তার বন্ধুদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হলো। তারা প্রফেসর সাহেবের বাসায় এসে তাকে সরাসরি এই মৃত্যুর জন্যে দায়ী করতে লাগলো। তার আগে আবার এক ঘটনা ঘটে গেছে। নাহিনের লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নেবার সময় উধাও হয়ে গেলো। তাকে আবার বিভিন্ন জায়গায় দেখা যেতে লাগলো। ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব নিলো প্রাইভেট ডিটেকটিভ অদিত এবং তার সহকারী কায়েস। এর সাথে আবার জুড়ে গেলো প্রফেসরের পরিচিত চিকিৎসক রাদিব। তারা তদন্ত শুরু করার কিছু পরেই প্রফেসর সাহেব তার ঘরে খুন হলেন।
নাহিনের লাশ উধাও আর প্রফেসরের মৃত্যু রহস্য উদঘাটন, এ নিয়েই কাহিনী এগুতে লাগলো।
তোমার সংলাপ নির্মাণ বেশ প্রাঞ্জল তবে বর্ণনার ক্ষেত্রে যে এখনও অনেক কাজ করার আছে তার চিহ্ন মেলে বইয়ের ৩৫ পৃষ্ঠায়। নতুন অধ্যায়ে প্রফেসর সাজিদ এলাহির মৃত্যুর খবর পাঠক জানছে এভাবে- “এক সমস্যা নিয়ে তদন্তের মাঝেই বড় সড় আর এক সমস্যা এসে হাজির হয়েছে”।
তুমি বইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বাঁকের সামনে পাঠককে দাঁড় করাচ্ছো। সেক্ষেত্রে প্রফেসরের খুন হয়ে যাওয়াটাকে “আরেকটি সমস্যা” এভাবে ক্যাজুয়ালি উপস্থাপন করে সাসপেন্স তৈরিতে একদমই পরিপক্কতার পরিচয় দিতে পারো নি। তোমার মূল নজর হলো কাহিনীকে এগিয়ে নেয়া, পরিণতির দিকে ছুটে যাওয়া, ঘটনাস্থলের বর্ণনা, এভিডেন্স, এ্যালিবাই ইত্যাদিকে পাকাপোক্ত করা। কিন্তু চরিত্রগুলোর মনের ভেতরে সেভাবে প্রবেশ করো নি। আমরা জানতে পারি নি তারা কী ভাবছে। তবে ভালো দিক হলো, সংলাপের মাধ্যমেও তুমি চরিত্রগুলিকে চরিত্র দিতে পেরেছো। স্বল্প পরিসরের বইয়ে অনেক চরিত্র থাকলেও গুলিয়ে যায় না। আমরা জানি যে আরিফ রগচটা স্বভাবের, দীপ্তর নার্ভ সাংঘাতিক কুল, মিশু নার্ভাস, রাদিব কৌশলী, অদিত অহংকারী। তাদের সংলাপগুলো ঠিক তাদের মতই হয়েছে।
পুরো বইয়ে তুমি অনেকগুলো সূত্র দিয়ে রেখেছো। যেগুলো নিয়ে পাঠক নিজেও মাথা ঘামাতে পারে। সমাপ্তিতে সেগুলো চমৎকার ভাবে গেঁথেছো। পাঠক বেশ অবাক হতে পারে আপাতদৃষ্টিতে চোখ এড়িয়ে যাওয়া বিষয়গুলি নিয়ে জটিল ধাঁধা মেলানো দেখে!
তবে এসবকিছুই বইটির বিশেষত্ব না। বলা যায় বইয়ের ভালো দিক। ভালো, তবে বিশেষ না। বিশেষ হচ্ছে বইয়ের দ্বিতীয় টুইস্ট। যেটার জন্যে পাঠক একেবারেই প্রস্তুত থাকবে না। তুমি ডিটেকটিভ উপন্যাসের একটা সাধারণ ফরমেটে এগিয়ে নিয়েছো উপন্যাসকে। ঘটনা, তদন্ত, জেরা, এবং অবশেষে রহস্য উন্মোচন। রহস্য উন্মোচনের প্রথম পর্যায়, যেখানে বইটি শেষ হলে তা একদমই ভুলে যাওয়ার মত হতো, সেটুকু পড়ে যদি কোনো পাঠক রেখে দেয় এই ভেবে যে যা জানার তা তো জেনেই ফেললাম, তাহলে সে যে কী ভুল করবে! তবে সে যেন সেই ভুল না করে তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত অবশ্য তুমি আগে থেকেই দিয়েছো। আমি নিজেও খুব আশাহত হতাম যদি ওখানেই বইটা শেষ হতো। রাদিব চরিত্রটির নির্মাণ এক কথায় অসাধারণ হয়েছে। তার বুদ্ধিমত্তা, প্রচ্ছন্ন শ্লেষ সব মিলিয়ে অনেকদিন মনে রাখার মত একটি চরিত্র। একে পরে অন্য কোন লেখায় আবার আনবে না কি?
রহস্য উপন্যাসের আরেকটি সাধারণ আঙ্গিক হলো, খুনী ধরা পড়বে এবং আইনের লোক তাকে ধরে নিয়ে যাবে। তুমি বেশ সাহসের সাথে এই গঁৎ ভেঙেছো। ফলে পাঠকের মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তি কাজ করতে পারে। আমি চাই ভবিষ্যতে তুমি এমন আরো অনেক অস্বস্তি উপহার দেবে। আমাদের নিয়ে যাবে মানব মনের আরো গহীনে। তখন তোমার লেখায় সত্যিকারের অন্ধকার নেমে আসবে, আর আমরা ডুবে যাবো, দীশা হারাবো।
শুভকামনা সহ
হাসান ভাই
০৬-০৫-২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ৯:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



