somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডিটেকটিভ, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার: মধ্য বৃত্ত (পর্ব ৮)

১৪ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পর্ব ১ পর্ব ২ পর্ব ৩ পর্ব ৪ পর্ব ৫ পর্ব ৬ পর্ব ৭


১২
রাদিব আবার এসেছে দীপ্তর হলে। দীপ্ত জিম শেষে ফিরেছে। রুমেই ছিল, রাদিবকে পুনরায় দেখে বিস্ময় প্রকাশ করার কথা ছিল, দীপ্ত তা করেনি। স্বাভাবিকভাবে জানতে চাইল, "এবারও কি আপনি একা?"
রাদিব হেসে জবাব দিলো, "হ্যাঁ।"
"আবার কী কাজে?", শুয়ে থাকা থেকে উঠে বসতে বসতে জানতে চায় দীপ্ত।
"আপনার বন্ধু আরিফ আর মিশু কোথায়? একটা কাজ করতে হবে।"
"কী কাজ?"
"ওনাদের ডাকুন একটু কষ্ট করে।"

দীপ্ত চলে গেল বিছানা থেকে নেমে। রাদিব বসে রইল দীপ্তর রুমে। ফিরে আসলো কিছু সময় পর আরিফ আর মিশুকে নিয়ে দীপ্ত। মিশু আর আরিফ কিছুটা বিরক্ত। দীপ্তর মতন শান্ত ভাব এদের মধ্যে নেই। এই উটকো ঝামেলা ওদের আর ভালো লাগছে না। বিরক্তি ওদের চোখে মুখে একটা ক্লান্তির ভাব এনে দিয়েছে। আরিফ রগচটা ছেলে, একটু উঁচু গলায় বলল, "আবার কী ভাই? কী শুরু করছেন আপনারা? খুনি হলে ধরে নিয়ে যান, এই ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। বালের খালি একটু পর পর জিজ্ঞাসাবাদ।"

রাদিব আরিফের এই অসহিষ্ণুতা আসাটাকে স্বাভাবিক ভেবে, শান্ত গলায় বলল, "খুনি কে সেটা কাল জানা যাবে। এখন আপাতত কষ্ট করে, আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে, প্লিজ। আমি আপনাদের কাছে প্রফেসর স্যারের খুনের ব্যাপারে আসিনি। এসেছি আপনাদের বন্ধু নাহিনের ব্যাপারে। আপনাদের মধ্যে কেউ খুনি কিনা, সেটা তো আমি বলতে পারব না, সেটা পুলিশের কাজ। আপাতত আপনাদের বন্ধুর ব্যাপারে আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে, এই যা।"
দীপ্ত আরিফকে ধরে বলল, "আরিফ, এত সহজে মেজাজ হারালে হয়? উনি কী বলেন দেখ শুনে।”
আরিফ শান্ত হলো। রাদিব বেরিয়ে আসলো হল থেকে, সাথে নিয়ে দীপ্ত, আরিফ আর মিশুকে। গন্তব্য দিদার মানে নাহিনের বড় ভাইয়ের কাছে । দিদারও বাসায় ছিল, সাথে আসতে খুব একটা আপত্তি করল না। এই চার জনকে নিয়ে কী করতে চাচ্ছে রাদিব, তাই মাথায় ঢুকছে না। ভীষণ অনুরোধ করে ওদের সাথে করে নিয়ে আসলো রাদিব। এই লোকের মতলব কী কে জানে!
দীপ্তর দিকে তাকিয়ে রাদিব জিজ্ঞাসা করল, "নাহিনকে আপনারা কোন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন সেখানে?"
দীপ্ত মাথা নেড়ে সায় দিলো।

ভার্সিটির পাশেই সরকারি হাসপাতাল। রুগিতে গিজগিজ করছে, বেড বা কেবিন না পেয়ে, অনেকেই হাসপাতালের বারান্দায় পাটি, চট, পেপার বিছিয়ে অসুস্থ রুগিদেরকে শুইয়ে রেখেছে। এখানকার ডাক্তারদের বিশাল ব্যস্ততা। শুয়ে থাকা মানুষদের নিয়ে এদের মাথা ব্যথা নেই এত। দম ফেলবার ফুসরত এরা পাচ্ছে না। রাদিব জানতে চায় দীপ্তর কাছে, "আপনার কি মনে আছে ঠিক কোন ডাক্তার, আপনারা যখন নাহিনের লাশ এখানে নিয়ে আসেন, তখন চেক করেছিলেন?"
দীপ্ত বলে, "একটু খুঁজতে হবে, খুঁজলে পেয়ে যেতে পারি।"
দীপ্ত, আরিফ আর মিশু মিলে এদিক ওদিক অনেক জায়গায় উঁকিঝুঁকি দিয়ে খুঁজে বেড়াল। পেল না। হয়ত চেহারা ভুলে গিয়েছে, নয়ত ডাক্তার এখানে নেই। দিদার অনেক সময় ধরে কিছু একটা ভাবছে। ভাবনার সমাপ্তি করে, নরম সুরে রাদিবকে জানাল, "ডাক্তার সাহেব, আমার মনে হয় ঐ ডাক্তারের নাম মনে আছে।"
রাদিব চুপ করে কিছুক্ষণ দেখল দিদারের দিকে।
"আপনি ডাক্তারকে নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন?"
"জি না। তবে দ্বিতীয় বার আমি যখন চেক করাই এক নার্সকে দিয়ে নাহিন মারা গিয়েছে কিনা, তখন নার্স একটু বিরক্ত হয়ে আমাকে বলেছিল, হেদায়েত স্যার না একটু আগে চেক করে গেল, আবার আমাকে বলছেন কেন?"

কথা শেষ করার আগেই রাদিব ছুট লাগাল। কয়েক জন নার্সকে জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার হেদায়েত কোথায় আছেন? কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারল না। একটু পরে দিদারই আবার এক নার্সকে নিয়ে রাদিবের সামনে হাজির করল। নার্সকে দেখিয়ে রাদিবকে বলল, "এই যে, এই নার্স চেক করেছিল আমার ভাইকে।"
নার্স বেশ ভয় পাচ্ছে। দিদার যখন এদিকটায় আসতে বলল নার্সকে, সে রাজি হলো না। শেষমেশ দিদার বুদ্ধি এটে বলেছে, "পুলিশের লোক এসেছে, আপনাকে ডাকে।"
তখন সুরসুর করে চলে আসলো । রাদিবকে পুলিশের লোক ভেবে, ভয় পাচ্ছে নার্সটা। রাদিব জানতে চাইল, "আপনি নাহিনের লাশ চেক করেছিলেন?"
নার্স ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, "কত রুগি আসে প্রতিদিন, প্রতিদিন কতজন মারা যায়। কবে কার লাশ চেক করছি, তা তো মনে থাকে না।"
"আচ্ছা, ধরেন আমি মারা গিয়েছি। আমাকে কীভাবে চেক করবেন আমি মারা গিয়েছি কিনা, দেখি তো?"
রাদিব চোখ বন্ধ করে রইল। নার্স বাধ্যগত আদেশ মানার মতন, রাদিবের পালস পরীক্ষা করল, শ্বাস প্রশ্বাস আর হার্ট বিট চেক করল। রাদিব চোখ মেলে তাকিয়ে, "ধন্যবাদ," বলল, "ডাক্তার হেদায়েত সাহেব কোথায় আছেন, সেটা কি আপনি আমাদের বলতে পারবেন?"
"স্যার তো এখন তার চেম্বারে।"
"তার চেম্বারটা কোনদিকে?"
"না মানে, উনি এখন ওনার পার্সোনাল চেম্বারে, ধানমন্ডিতে। উনি হয়ত আজকে রাতে একবার আসবেন এখানে,” কথা আমতা আমতা সুরে বলল নার্স। যেন খুব গোপন কোনো তথ্য নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাদিবকে সে দিচ্ছে।
"আচ্ছা, আপনি কষ্ট করে আমাকে ওনার ঠিকানাটা দিয়ে চলে যান।"
নার্স মনে করার চেষ্টা করল ঠিকানা। মনে পড়ছে না। এরপর বলল, "আপনি একটু দাঁড়ান, আমি ওনার একটা কার্ড নিয়ে আসি।"
নার্স চলে গেল কার্ড নিয়ে আসতে। এর মাঝেই ফিরে আসলো দীপ্ত, আরিফ আর মিশু। দীপ্ত বলে, "খুঁজে তো পেলাম না ওনাকে।"
"আমরা খুঁজে পেয়েছি। একটু পর ওনার ওখানেই যাচ্ছি। উনি ধানমন্ডিতে আছেন, ওনার পার্সোনাল চেম্বারে।"
মিশু পাশ থেকে বলল, "আমি আর কোথাও যেতে পারব না। আমার পা ব্যথা করছে।"
সাথে তাল মিলাল আরিফ, "আমিও আর এই ঝামেলায় থাকতে পারব না। উনি কী করতে চাচ্ছেন, তাই তো বুঝতে পারছি না। হুদাই টাইম নষ্ট।"
রাদিব মিষ্টি একটা হাসি হেসে বলল, "আপনাদের বেশি কষ্ট হলে চলে যান তাহলে। আপনাদের শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে তো লাভ নেই।"
দীপ্ত, আরিফ আর মিশুকে ধরে একটু দূরে নিয়ে গেল। কী যেন বলল। তিনজন ফিরে আসার পর, মিশু নাক উঁচু করে বলল, "আচ্ছা চলেন।"
রাদিব আলতো করে হাসল।

নার্স হাতে করে একটা কার্ড নিয়ে এসেছে ডাক্তার হেদায়েতের। পুরো নাম ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার। ধানমন্ডিতে তার চেম্বারের ঠিকানা সেখানে লেখা। রাদিব নার্সকে একটা ধন্যবাদ দিলো। নার্স তবু দাঁড়িয়ে। যেন এখান থেকে সরে যাওয়াটা তার উচিত হবে না। রাদিবে নার্সের কাছে গিয়ে বলল, "আপনাকে উনি বোধহয় বলেছেন, আমি পুলিশের লোক। আপনার চেহারা দেখে মনে হলো আর কী! আমি আসলে পুলিশের লোক না। এত খাটো মানুষের পুলিশে চাকরি হয় না। আমিও ডাক্তার একজন। যাই হোক আপনার সাহায্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।"
নার্স অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে দিদারের দিকে তাকাল। দিদার সে দৃষ্টি গ্রাহ্য না করার ভান করল। কিছু একটা অস্পষ্ট ভাষায় দিদারকে গালি দিয়ে চলে গেল নার্স। দিদার সে অপমানও গায়ে লাগাল না।

ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ারের চেম্বারে প্রচণ্ড ভিড়। বোঝাই যাচ্ছে এখানে ব্যবসা বেশ ভালো তার। এই সিরিয়াল শেষ করে কথা বলতে গেলে, অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। এত সময় রাদিবের হাতে নেই। একবার ঢুকতে চাইল রাদিব ভিতরে। ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ারের সহযোগী কোনোভাবেই তাকে ঢুকতে দিবে না। একবার ভাবল বলে দেয় সে পুলিশের লোক। কিন্তু এতগুলো রুগিকে অপেক্ষা করিয়ে দেখা করতে যেতেও কেমন বিবেকে বাঁধল। তাই অপেক্ষাই করল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। একবার সহযোগী এসে জিজ্ঞেস করল, "আপনাদের রুগি কে?"
আরিফ বিরক্ত মুখে জবাব দেয়, "আমরা সবাই রুগি। সবার মাথায় গন্ডগোল আছে।"
এ কথা শুনে সহযোগী কিছু না বলে চলে গেল। বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক, দেড় ঘণ্টার উপরে অপেক্ষা করে ওরা। ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ারের রুগি দেখাই শেষ হয় না। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ফ্রি হলেন ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার। রাদিব সহযোগীকে বলল, "গিয়ে বলুন, ডাক্তার রাদিব ওনার সাথে দেখা করতে এসেছে।"
কিছুক্ষণ পর সহযোগী এসে রাদিবকে ডাক দিলো। বাকিদের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে, রাদিব ভিতরে গেল। বলে গেল পাঁচ মিনিটের ভেতর ও ফিরে আসছে। হাই তুলে আরিফ বলল, "ডাক্তার সাহেব, এবার আমাদের মাফ করেন। প্লিজ কাজটা শেষ করেন।"
রাদিব ভিতরে এসে সালাম দিলো। ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার রাদিবকে বসতে বললেন। রাদিব বসতেই, চশমটার উপর দিয়ে রাদিবের দিকে তাকিয়ে, ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার বললেন, "জি বলুন।"
রাদিব ধীর গলায় বলল, "আসলে আপনি আমাকে চিনবেন না। আমিও ডাক্তার একজন, আপনার মত অত বড় ডাক্তার না হলেও, খুবই ছোটো ডাক্তার।"
"আপনার নাম?"
"রাদিব।"
"রাদিব, রাদিব, ঠিক আছে, এই নামে আমি কাউকে চিনি না। যাই হোক এবার বলুন আমার কাছে কেন?"
রাদিব ভনিতা বা ভূমিকা বাদ দিয়ে সরাসরি কথায় চলে যায়, "আপনার হাসপাতালে বেশ কয়েকদিন আগে, কয়েকটা ছেলে মিলে একটা ওদের এক বন্ধুর লাশ নিয়ে এসেছিল। হার্ট এটাকে মারা যাওয়া। আপনার কি মনে আছে?"
ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, চোখ বন্ধ করে।
"কত রুগিই তো আসে, সবার কথা তো ওভাবে মনে থাকে না। দাঁড়ান দাঁড়ান, হ্যাঁ মনে পড়েছে। মে বি, দুইজন বন্ধু এসেছিল ছেলেটার সাথে। আমাকে দেখে বলেছিল, স্যার আমাদের বন্ধু বোধহয় হার্ট এটাক করে মারা গিয়েছে। একটু দেখুন তো।"
"আপনি পরে চেক করলেন?"
"হ্যাঁ, আমি চেক করে দেখলাম সত্যিই ছেলেটা মারা গিয়েছে।"
"আপনার নিশ্চয় মনে আছে, আপনি কী কী পরীক্ষা করে বলেছিলেন ছেলেটা মারা গেছে?"
"অবশ্যই। আমি পালস চেক করলাম, রেস্পিরেশন দেখলাম, চোখ মেলে আলো ফেলে পিউপিল চেক করলাম, স্টেথোস্কোপ দিয়ে হার্ট-বিট চলছে কিনা তাও দেখলাম।"
"ছেলেটা মারা গিয়েছিল?"
"ইয়েস, হি ওয়াজ ডেড।"
"আপনি ইসিজি করেছিলেন?"
ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার কিছুটা সংকোচের সাথে বললেন, "না। আমি কোন ডেথ সার্টিফিকেট দেইনি। জাস্ট ভার্বালি ডেথ ঘোষণা করেছি। তাছাড়া সরকারি হাসপাতাল বুঝতেই পারেন, ওভাবে সুযোগ বা সময়ও হয় না, তাও আমি বলেছিলাম যদি চায় আরও চেক করতে পারে এডমিট করে।"
"আপনি অনেক বড় ডাক্তার, আপনার ল্যাজারাস সিনড্রোমের কথা জানা থাকার কথা অবশ্যই।"
ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার ভ্রু কুঁচকে রাদিবের দিকে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকেই বললেন, "কিন্তু সেটা তো রেয়ার কেস।"
"এই রেয়ার কেস বা ক্ষীণ সম্ভাবনাটাই ঐ ছেলেটার সাথে ঘটেছে এবং সে ইতোমধ্যে অনেক গুলো মানুষকে ভয়ও দেখিয়েছে।"
ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন রাদিবের দিকে, মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো, "ওহ মাই গড। কী বলছেন?"
রাদিব উঠে দাঁড়াল। চমকে যাওয়া ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল, "আসি আমি, ধন্যবাদ আপনাকে। আমার এই তথ্যটাই জানার ছিল। "
রাদিব বেরিয়ে আসলো। ডাক্তার হেদায়েত আনোয়ার তখনও একটা ঘোরের মধ্যে রইলেন। সে ঘোর যেন কাটছে না। রাদিব বেরিয়ে এসে দেখল, আরিফ, মিশু, দিদার দাঁড়িয়ে আছে, দীপ্ত নেই। রাদিব এসে বলল, "পাঁচ মিনিটের বেশি লাগেনি। আমাদের কাজ শেষ। নাহিন সাহেবের রহস্যের সমাধান হয়ে গিয়েছে। এবার ফেরা যাক, যে কোন জায়গায়, দিদার সাহেবের বাসায় কিংবা আপনাদের হলে। কিন্তু দীপ্ত সাহেব কোথায়?"
আরিফ ইশারা করে রাদিবকে বুঝাল, দীপ্ত সিগারেট খেতে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই দীপ্ত একটা চুইং গাম চাবাতে চাবাতে ফিরে আসলো। এসে জিজ্ঞেস করল, "কাজ শেষ?"
রাদিব মিষ্টি হেসে জবাব দিল, "হ্যাঁ।"
রাদিবের শুকনো হাসি, এখন মিষ্টি হয়েছে। একটা রহস্যের সমাধান হয়ে গিয়েছে।


দিদারের বাসাতেই এসেছে সবাই। দিদার সাহবের রুমে বসেছে। দিদার, আরিফ, মিশু, দীপ্ত, দিদারের মা। রাদিব কী বলতে চায়, তাই শুনতে চায় সবাই। রাদিব বলা শুরু করে, সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনে।
"নাহিন সাহেব নেশা করতেন। যাই হোক, সিগারেট, গাঁজা ছাড়িয়ে তা হিরোইন, কোকেনে পৌছায়। আমি এই ব্যাপারে পরে আসি, আগে আর একটা বিষয়ে বলি। আমি সহজ করে বলার চেষ্টা করছি। মানুষ মারা গেলে তার জীবিত হওয়া সম্ভব না। আমার এক বন্ধু প্রায়ই বলত, মইরা গেলে কিন্তু আর বাঁচবি না। আমি উত্তরে বলতাম, মরে গেলেও মানুষ বেঁচে উঠে। নাহিন সাহেব যেমন উঠেছেন। মরে গিয়েও বেঁচে উঠেছেন। আরিফ সাহেব, মিশু সাহেব, প্রফেসর সাজিদ এলাহী স্যার এবং শেষমেশ আমাকে দেখা দিয়েছে।"
"আপনাকেও দেখা দিয়েছে?", মাঝখান থেকে বলে উঠে মিশু।
"জি, আমাকেও দেখা দিয়েছেন। শুধু যে নাহিন সাহেবই মৃত থেকে জীবিত হয়ে এমন দিব্বি ঘুরে বেরাচ্ছেন, ব্যাপার কিন্তু তেমন না। এই ঘটনা এর আগেও অনেকের সাথে হয়েছে। আমাদের দেশেও, বাইরেও। এখন একজনের নাম মনে পড়ছে, ইংরেজ মহিলা একজন, নাম ডাফনি ব্যাংকস। তাকে ডাক্তাররা মৃত ঘোষণার প্রায় এক দিন দশ ঘণ্টা পর জীবিত হয়ে উঠেছিলেন।"
রাদিব দিদারের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনি কিছু না মনে করলে একটা সিগারেট ধরাই? খাব না, পুড়তে দেখব। এতে মাথা ঠাণ্ডা থাকে।"
দিদারের মা আপত্তি করলেন না। রাদিব দীপ্তর কাছ থেকে চেয়ে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। সে সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, "এই বিষয় গুলোকে মেডিকেলের ভাষায় বলে ল্যাজারাস সিনড্রোম। মানে মৃত মানুষের জীবিত হওয়া আর কী। সাধারণ ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস আর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে একজন মানুষকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এ অবস্থা থেকে পিছন দিকে ফিরে আসা, মানে কোন রকম চিকিৎসা ছাড়াই, একা একা শ্বাস প্রশ্বাস আর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া চালু হওয়াকে ল্যাজারাস সিনড্রোম বলে। ডাক্তাররা সাধারণত পালস চেক করে, স্টেথোস্কোপ বুকে লাগিয়ে হার্ট বিট, শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কিনা তা দেখে, চোখে আলো ফেলে চোখের মণি নড়ছে কিনা দেখে। সব গুলো নেগেটিভ হলে একজন মানুষকে মৃত বলে দেয়। কিন্তু এরপরও কিছু মানুষ এই অবস্থা থেকে ফিরে আসে এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করে। এসবের বাইরেও একদম নিশ্চিত মৃত্যু জানার জন্য ইসিজি করা হয়। ইসিজিতে মৃত মানে, মানুষটা মৃত। কিছু কিছু খুব অল্প ক্ষেত্রে ঐ অবস্থা থেকেও মানুষ জীবিত হয়ে ফিরে আসে। এদের ক্ষেত্রে যে ঘটনাটা ঘটে তা হলো, এদের কোনো কারণে কিছু সময়ের জন্য হৃদপিণ্ড আর ফুসফুসের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায় এবং একা একাই তা আবার চালু হয়ে যায়। আমাদের নাহিন সাহেব ল্যাজারাস সিনড্রোমের একটা উদাহরণ, তিনি মৃত অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন এবং তিনি জীবিত আছেন।"
রাদিবের সামনে বসা প্রতিটা মানুষের চোখে মুখে চরম বিস্ময়। দীপ্তকেও এই প্রথম চমকে যেতে দেখল রাদিব। দীপ্তর চোখটা ছল ছল করছে, নাক আর মুখ চেপে ধরে দীপ্ত কান্না সামলাতে চাইল, থামাতে চাইল, পারল না। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। খুব শক্ত, আবেগ দমিয়ে রাখা মানুষ গুলোর চোখে জলও খুব সুন্দর একটা দৃশ্য। দীপ্তকে জড়িয়ে ধরে আরিফ আর মিশুও কেঁদে দিলো। দিদার রাদিবের সামনে এগিয়ে গিয়ে ধরে আসা গলায় বলল, "নাহিন কোথায়? আমার ছোট ভাইটা কোথায়?"
দিদারের মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। রাদিব বলে, "নাহিন সাহেব যতটা সম্ভব ওনার রাফি নামের বন্ধুটার সাথে আছেন। ওনার নেশার সঙ্গীর সাথে। আমার এক পুলিশ বন্ধু আছে, ও খোঁজ চালাচ্ছে নাহিন সাহেবকে ধরার জন্য। আর আপনারা অকারণে প্রফেসর সাজিদ এলাহীকে দোষারোপ করেছিলেন। নাহিন সাহেব পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে কখনই হার্ট এটাক করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটা পড়াশুনা না করা ছেলে, একটা বিষয়ে ফেলকে ওভাবে কখনই আমলে নেয় না। তার জন্য অতটা কষ্টও পায় না যে হার্ট এটাক করে মরে যাবে। নাহিন সাহেব সেদিন অতিরিক্ত নেশা করে ফেলেছিলেন, দিদার সাহেব বাসার বাইরে তাই। হিরোইন বা কোকেন যাই হোক অতিরিক মাত্রায় নেবার কারণে, তার সাময়িক ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস আর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আপনারা তাকে মৃত ভাবলেন, লাশ পিক-আপে করে নিয়ে যাবার সময় তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। খাটিয়ায় শোয়ানো আর সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা দেখে তিনি বুঝতে পারেন, তাকে মৃত ভেবে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পিক-আপ থেকে পালিয়ে যান। আর এসে আশ্রয় নেন, তার রাফি নামক বন্ধুটার কাছে যতটা সম্ভব। রাতের বেলা বের হন, অলি গলি ঘুরে বেড়ান নেশার ঘোরে। এর মাঝে একবার দেখা হয় মিশু সাহেবের সাথে, একবার আরিফ সাহেবের সাথে। সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ছিল। আর প্রফেসর সাজিদ এলাহীকে তিনি ইচ্ছা করেই ভয় দেখিয়েছিলেন। বাকিটা আপনারা নাহিন সাহেবকে পেলেই জানতে পারবেন।"

সবাই বড় কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে আছে রাদিবের দিকে। যেন অনেক বড় কোনো উপকার করেছে রাদিব। রাদিব স্মিত একটা হাসি দিলো শুধু সবার দিকে তাকিয়ে। দীপ্ত চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল, "একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ডাক্তার সাহেব?"
"জি করুন।"
"আপনার সাথে নাহিনের কোথায় দেখা হয়েছে? আর আপনি বুঝলেন কী করে ও জীবিত?"
রাদিব হাসিটা ধরে রেখে বলে যায়, "আসলে পুরো ব্যাপারটা বলতে পারেন অনুমানের উপর।"
"কীভাবে?"
দীপ্তর প্রশ্নের উত্তরে, সেদিন রাতে তেজকুনিপাড়ার ঐ গলির মধ্যে ছিনতাইকারীদের হাতে মার খাওয়ার ঘটনাটা বলে রাদিব। দীপ্ত আবার প্রশ্ন করে, "একজন না হয় রাফি বুঝলেন, অন্যজন নাহিন কী করে বুঝলেন? ওখানে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। বুঝতে পারার কথা না।"
"এ জন্য ধন্যবাদ দিতে পারেন, দিদার সাহেবকে। উনি আমাকে সাহায্য করছেন, ওনার ভাইকে খুঁজে বের করার জন্য।"
দিদার অবাক হয়ে বলল, "আমি? কীভাবে?"
"আপনিই। আমার অন্ধকারে নাহিন সাহেবকে চিনতে পারার কথা না। তবে অন্ধকারে চোখে না দেখা গেলেও, কথা শোনা যায়। যখন আপনি দেখতে না পারবেন, তখন আপনার শ্রবণ ইন্দ্রিয়, ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় অনেক বেশিই কাজ করবে। আমার বেলাতেও তাই হলো। আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, আমি আপনার কণ্ঠ শুনছি। আমি একবার ভেবেও নিলাম আপনি, মানে দিদার সাহেবই ওখানে ছিলেন। তবে পরক্ষণে নাহিন সাহেবের মুখে শোরের বাচ্চা, গালি শুনে মনে হলো, এই গালিটা পরিচিত। এই গালিই নাহিন সাহেব আপনাকে দিয়েছিলেন পিক-আপে বসে। আর আপনারা দুই ভাই, আপনাদের কণ্ঠ এক হতেই পারে। আমার অনুমান হলো এখানে নাহিন সাহেব আছেন এবং তার এক বন্ধু তার সাথে যার নাম রাফি। আপনি সেখানে ছিলেন না, এটা বুঝতে পাড়ার আর একটা কারণ আপনার শরীরে দেয়া ফগের বডি স্প্রের ঘ্রাণ আমি সেখানে পাইনি। আপনি সেখানে থাকলে, আমি এই ঘ্রাণটা আমি পেতাম। ঘ্রাণটা খুব দারুণ, আমার অনেক পছন্দের। সে যাই হোক, অনুমান সঠিক হলো শেষমেশ, সেখানে নাহিন সাহেবই ছিলেন।"

রাদিব উঠে দাঁড়াল। আর বেশি সময় এখানে নষ্ট করবে না। একটা মৃত্যু শুধু একটা মানুষের মৃত্যু না। একটা পরিবারের, কাছের মানুষ গুলোর ভালো থাকার, হাসি খুশি থাকারও মৃত্যু। সে মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে একসময় ল্যাজারাস সিনড্রোমের মত, ভালো থাকা, হাসি খুশি থাকা ফিরে আসে একসময়। তবে সে প্রাণ আর থাকে না। একটা মৃতপ্রায় পরিবারে হঠাৎ করেই একটা প্রাণ ফিরে এসেছে। বেঁচে থাকাটা অনেক বড় একটা ব্যাপার, এই ব্যাপারটাকে আমরা সবাই অনুভব করতে পারি না। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটাও কারও সন্তান, কারও ভাই, কারও বন্ধু। সে বুঝতে না পারুক, তার আশপাশের মানুষ গুলো বুঝতে না পারুক, তার হারিয়ে যাওয়া একটা শূন্যতা সৃষ্টি করবেই। সে শূন্যতা কখনও পূরণ হয় না, কারও শূন্যতা কাউকে দিয়ে কখনই পূরণ করার নয়।

রাদিব চলে আসার সময় বলে আসল, "একটা সমস্যা সমাধান হয়ে গেল। বাকি রইল, প্রফেসর সাজিদ এলাহীর খুনের ব্যাপারটা। কাল জানতে পারবেন খুনটা করেছে কে। অদিত সাহেব খুনিকে খুঁজে পেয়েছেন। আমার শুধু আগ্রহ খুনিকে চেনা।"
কথাটা বলে রাদিব ঘুরে দাঁড়াল। কারও চোখের দিকে তাকাল না। মুখের আগে চোখ মানুষের সত্যি কথা বলে। কালকের অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কাল অনেক বড় একটা রহস্য ভেঙে যাবে। হয়ত সবার ভাবনার বাহিরে কিছু হবে।

(২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার তৃতীয় উপন্যাস মধ্য বৃত্ত।)
শেষ পর্ব

রিয়াদুল রিয়াদ

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৩২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিপ্লবের নিঃশব্দ মূল্য: অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাংলাদেশি ছাত্র আন্দোলন

লিখেছেন মুনতাসির, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫

এ লেখাটি বেশ বড়ো। এখানে ছোট করে দেয়া হল। পুরো লেখাটি যদি কেও পড়তে চান, তবে নীচের লিঙ্ক থেকে পড়তে পারবেন।


সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা চলছে। জাতিসংঘের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিরহ

লিখেছেন গোধুলী বেলা, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৪৪

একটি কবিতা লিখা হবে বাদে কিছুক্ষণ
মেঘমালারা বারি পাত করিছে ক্ষণে ক্ষণ।
গগনভেদি কামান গোলা পরিছে মুহুর্মুহু
দুরুদুরু ভয়েতে কাপিছে বুক বাদ যায়নি কেহ।

জানালার পাশে  প্রেমিকার ছলছল চোখ
বৃষ্টিরো সাথে সে কেঁদে  ভাসাইছে বুক।
হাজারো... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিছু কিছু মানুষ বলার শুরু করেছে, "আমরা আগেই ভালো ছিলাম"।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:০২



একাধিক কারণে মানুষ ইহা বলার শুরু করেছেন: (১) সাধারণ মানুষ কোমলমতিদের ক্রমেই চিনতে পারছেন, ইহা ভীতি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছে; কোমলমতিরা সরকারের গুরুত্বপুর্ণ অনেক পদে আছে ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি - একাল সেকাল

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮



টানা বৃষ্টির মধ্যে মরিচের দাম বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা কেজি । অন্যদিকে ফার্মের মুরগির এক পিছ ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা।শুধু মরিচ নয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কমলা যদি পরাজিত হয়, "দ্রব্যমুল্য"ই হবে ১ নম্বর কারণ

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭



দ্রব্যমুল্য হচ্ছে অর্থনৈতিক সুচকগুলোর ১ টি বড় প্যারামিটার; ইহা দেশের অর্থনীতি ও চলমান ফাইন্যান্সের সাথে সামন্জস্য রেখে চলে; টাস্কফোর্স, মাস্কফোর্স ইহার মুল সমাধান নয়; ইহার মুল সমাধন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×