পৃথিবীতে নবী বা রাসুল ছাড়া কেউ নিস্পাপ না। আমাদের মহানবীর (সা) সাহাবীদের সামান্য কয়েকজন বড় গুনাহ অনেক সময় করে ফেলেছেন কিন্তু তারা তৎক্ষণাৎ তওবা করেছেন বা শাস্তি মেনে নিয়েছেন। এই ধরণের সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাহাবীরা বড় গুনাহমুক্ত ছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে যারা রসুলের (সা) সাথে বেশী ছিলেন এবং নেতৃস্থানীয় ছিলেন তাদের মধ্যে কবিরা গুনাহ সঙ্ঘটনের কথা পাওয়া যায় না। আর যে কোন মুসলমানের ছোট গুনাহগুলি আল্লাহতায়ালা ৫ ওয়াক্ত নামাজের দ্বারা মাফ করে দেন। সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া বলা যায় যে সাহাবীরা বড় গুনাহ মুক্ত ছিলেন। অনেকক্ষেত্রে তাদের দ্বারা অনিচ্ছাকৃত ইজতেহাদি ভুল হয়ে গেছে। ইজতেহাদ মানে কোন বিষয়ের উপর ব্যক্তির নিজস্ব জ্ঞান নির্ভর Judgment। ইজতেহাদি ভুল কোন অপরাধ না, এটা নিছক একটা ভুল যার জন্য কোন শাস্তি নাই।
সাহাবীদের মর্যাদার ব্যাপারে আমাদের রসুল্ (সা) বলেছেন;
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা আমার সাহাবীগণকে উদ্দেশ্য করে অপমানজনক কথা বলবে না। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন, যদি তোমাদের মধ্যে কেউ উহুদ পাহাড় বরাবর স্বর্ণ ব্যয় করে তাহলেও তাঁদের কারোর এক মুদ অথবা অর্ধ মুদ্দের সমান হবে না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৫৪০, সহিহ বুখারি হাদিস নং ৩৪৭০)
সাহাবীদের নামে যারা অপবাদ দেয়, খারাপ ধারণা পোষণ করে এবং অসম্মানজনক কথা বলে তারা কঠিন অপরাধে অপরাধী। এই ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করলে তাদেরকে আলেমরা কাফিরও বলেছেন। এই লিঙ্কটাতে এই ব্যাপারে বিস্তারিত আছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাফির না বলা হলেও তাদেরকে কঠিন অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হয়।
কোরআনে সাহাবীদের মর্যাদা উল্লেখ করে আয়াতঃ
সূরা আত–তাওবা, আয়াত ১০০ঃ
"মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখোনে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহা কামিয়াবী।"
আল্লাহ যাদের উপর প্রসন্ন বলে ঘোষণা করেছেন এবং যাদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করেছেন তাদের ব্যাপারে মানুষ কিভাবে খারাপ কথা বলতে পারে!
সূরা আল–ফাতহ, আয়াত ২৯ঃ
"মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সাজদায় অবনত দেখবে। তাদের মুখে সাজদাহর চিহ্ন থাকবে, তাওরাতে তার বর্ণনা এইরূপই এবং ইঞ্জীলেও। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা হতে নিগর্ত হয় কিশলয়, অতঃপর ওটা শক্ত পুষ্ট হয় এবং পরে কান্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা কৃষকের জন্য আনন্দদায়ক। এভাবে আল্লাহ মু’মিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তরজ্বালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও পুরস্কারের। "
সাহাবীদের প্রশংসা করে আল্লাহতায়ালা বলেছেন যে রসুলের (সা) সহচররা রুকু এবং সেজদায় অবনত থাকেন। তাওরাত এবং ইঞ্জিলেও তাদের উল্লেখ আছে। এই আয়াত থেকেও আল্লাহতায়ালা সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়েছেন। আল্লাহ যাদেরকে মর্যাদার আসন দিয়েছেন তাদের সমালোচনা করা, অপবাদ দেয়া কখনই সমর্থনযোগ্য না।
সুরা হাশর আয়াত ১০ঃ
"(এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা অগ্রবর্তীদের পরে (ইসলামের ছায়াতলে) এসেছে। তারা বলে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আর আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা কর যারা ঈমানের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রবর্তী হয়েছে, আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোন হিংসা বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি বড়ই করুণাময়, অতি দয়ালু।"
উপরের আয়াতে অগ্রবর্তী বলতে রসুলের (সা) সাহাবীদের কথা বলা হয়েছে। সাহাবীদের পরবর্তী জমানার মুসলমানরা সাহাবীদের জন্য এবং নিজেদের জন্য দোয়া করে এবং ঈমানদারদের ব্যাপারে তাদের মনে যেন কোন হিংসা, বিদ্বেষ না সৃষ্টি হয় তার জন্যও দোয়া করে। তাই আমাদের উচিত সাহাবীদের জন্য ভালো ধারণা রাখা এবং দোয়া করা।
সূরাআল–হাশর, ৮–৯ঃ
"এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এই নগরীতে (মদীনা) বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না, আর তারা তাদেরকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও।"
উপরের আয়াতে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে যাওয়া সাহাবীদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন যে তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। আর মদিনার আনসার সাহাবীদের মনের উদারতার প্রশংসা করেছেন। আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত এত বড় প্রশংসা মুলক বাক্যের পরে কিভাবে মানুষ সাহাবীদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করতে পারে।
হাদিসে সাহাবীদের মর্যাদার বর্ণনাঃ
রসুল (সা) সাহাবীদের ছোট করা, ব্যঙ্গ করা অথবা তাদেরকে নিয়ে অপমান জনক কথা বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। রসুল (সা) বলেছেন;
“Whoever insults my companions, the curse of Allaah, the angels and all of mankind will be upon him.” (al-Silsilah al-Saheehah, 2340)
উপরের হাদিসটা এই বিংশ শতাব্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবাণী তার বই ‘আল সিলসিলা আল সাহিহাতে সহিহ বলে উল্লেখ করেছেন।
মদিনার স্থানীয় আনসার সাহাবীদের সম্পর্কে আল্লাহর রসুল (সা) বলেছেন যে তাদেরকে কেবলমাত্র মুমিনই ভালোবাসে এবং কেবলমাত্র মুনাফিকই বিদ্বেষ রাখে। নীচের হাদিসে এই ব্যাপারে বলা হয়েছে;
বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার (মদিনার স্থানীয় সাহাবী) সম্পর্কে বলেছেন, তাদেরকে কেবলমাত্র মুমিনই ভালোবাসে এবং তাদের প্রতি কেবলমাত্র মুনাফিকই বিদ্বেষ রাখে। যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালবাসবে, আল্লাহও তাকে ভালবাসবেন। আর যে ব্যক্তি তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখবে, আল্লাহও তার প্রতি বিদ্বেষ রাখবেন।’ (বুখারি ৩৭৮৩, মুসলিম ৭৫, তিরমিযি ৩৯০০, ইবন মাজাহ ১৬৩, আহমদ ১৮০৩০, ১৮১০৪)
খোলাফায়ে রাশেদিন হজরত আবু বকর (রা), হজরত ওমর (রা), হজরত ওসমান (রা) এবং হজরত আলীর (রা) নাম ‘আশারায়ে মুবাশ্বারা’র তালিকাতে উল্লেখ আছে। ‘আশারায়ে মুবাশ্বারা’ হোল সেই ১০ জন সৌভাগ্যবান সাহাবী যাদের বেহেশতে যাওয়ার ঘোষণা আল্লাহতায়ালা তার রসুলের (সা) মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। এই ব্যাপারে সহি হাদিস আছে। তাই খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়কে যারা সমালোচনা করে তাদের বোঝা উচিত যে আল্লাহর কাছ থেকে বেহেশতের সংবাদ পাওয়া সাহাবীরা এই ৩০ বছর মুসলিম উম্মাহর শাসনের দায়িত্বে ছিলেন। শিয়ারা ওনাদের নিয়ে যে সব বাজে কথা বলে তা কখনই গ্রহণযোগ্য না।
সাহাবীদের জমানা হোল শ্রেষ্ঠ জমানা এবং পরবর্তী জমানাতে মুসলমানদের মধ্যে মিথ্যাচারের প্রসার ঘটবে। মুসলমানদেরকে পরস্পর কাদা ছোড়াছুঁড়ি না করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাস করতে হবে। নীচের হাদিসে এই ব্যাপারে দিক নির্দেশনা আছে;
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘জাবিয়া’ (সিরিয়ার অন্তর্গত) নামক জায়গায় উমর (রাঃ) আমাদের সামনে খুতবাহ দেয়ার উদ্দেশ্যে দাড়িয়ে বলেনঃ হে উপস্থিত জনতা! যেভাবে আমাদের মাঝে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাড়াতেন, সেভাবে তোমাদের মাঝে আমিও দাড়িয়েছি। তারপর তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি (অর্থাৎ তাদের যমানা শ্রেষ্ঠ যমানা), তারপর তাদের পরবর্তীদের যমানা, তারপর তাদের পরবর্তীদের যমানা, তারপর মিথ্যাচারের বিস্তার ঘটবে। এমনকি কাউকে শপথ করতে না বলা হলেও সে শপথ করবে, আর সাক্ষ্য প্রদান করতে না বলা হলেও সাক্ষ্য প্রদান করবে।
সাবধান! কোন পুরুষ কোন মহিলার সাথে নির্জনে মিলিত হলে সেখানে অবশ্যই তৃতীয়জন হিসাবে শাইতান অবস্থান করে (এবং পাপাচারে প্ররোচনা দেয়)। তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা হতে সাবধান থেকো। কেননা, শাইতান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দুজন হতে অনেক দূরে অবস্থান করে। যে লোক জান্নাতের মধ্যে সবচাইতে উত্তম জায়গার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে (মুসলিম সমাজে)। যার সৎ আমল তাকে আনন্দিত করে এবং বদ্ আমল কষ্ট দেয় সেই হলো প্রকৃত ঈমানদার। ( তিরমিজি সহি হাদিস নং ২১৬৫)
সব শেষে বলা যায় যে রসুলের (সা) সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা কোরআনে বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখে করেছেন।
সহি হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে আমাদের মহানবী (সা) কিভাবে সাহাবীদের প্রশংসা করেছেন। আমাদের মত পাপীরা কিভাবে সাহাবীদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়ার, ব্যাঙ্গ করার, খারাপ ধারণা রাখার সাহস পাই। আল্লাহতায়ালা তাদের উপর যখন রাজি হয়ে গেছেন তখন আমরা তাদের সমালোচনা করার কে।
সুত্রঃ কোরআন এবং সহি হাদিস
islamqa.info
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



