প্রযুক্তির কারণে অনেক কিছু বদলে গেছে আমাদের জীবনে । ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। এই পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের জীবনযাত্রায় অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক আবার অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগ দেখার পর অতীতের অনেক হারিয়ে যাওয়া জিনিসের কথা মনে পড়ে গেল। এই হারানো জিনিসগুলি নিয়েই এই পোস্ট (১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত)।
১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে সম্ভবত বাগেরহাট রুটে দেখেছি এক ধরণের বাস চলত যেটার সামনের দিক অনেকটা ট্রাকের মত । এটার ইগ্নিশন (ইঞ্জিন স্টার্ট) করা হত চাবি ছাড়া। একটা লোহার হাতলের মত জিনিস ইঞ্জিনের ভিতরে ঢুকিয়ে কয়েকবার জোরে ঘুরানো হত। এক পর্যায়ে ইঞ্জিন স্টার্ট হয়ে যেত। ইউটিউবে দেখলাম ৮০-৯০ বছর আগে ছোট প্লেনেরও এভাবে সামনের প্রপেলার ঘুরিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করা হত।
আমার মায়ের এক বান্ধবী আসতেন প্রাচীন কালের কালো রঙের মরিস মাইনর গাড়ি চড়ে। এই গাড়ি এখন জাদুঘরে রাখা যেতে পারে। প্রাচীন স্টাইলের বেঢপ ঐ গাড়ি দেখে আমরা তখনই হাসতাম। এই গাড়ির চালক ছিলেন ভীষণ ঘুম কাতুরে। আমাদের বাসায় আসার পর উনি গাড়ির সিটে বসে ঘুমাতেন। আমি আর আমার ছোট ভাই গাড়ি ধাক্কা দেয়া শুরু করতাম। গাড়ি কিছু দূর যাওয়ার পর ওনার ঘুম ভেঙে যেত। আর আমরা দৌড়ে পালাতাম। ঐ যুগে বাংলাদেশের সব গাড়িই ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশন ছিল যেগুলিকে প্রয়োজনে ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট করা যেত। ক্লাচ চেপে গাড়িকে দ্বিতীয় গিয়ারে রেখে কিছু দূর ধাক্কা দেয়ার পর ক্লাচ ছেড়ে দিলে গাড়ি নিজে থেকে স্টার্ট হয়ে যেত।
এখনকার অটো ট্রান্সমিশন গাড়িতে এটা সম্ভব না। কোন কারণে অটো ট্রান্সমিশন গাড়ি পথের মাঝে বন্ধ হয়ে গেলে স্টিয়ারিং আর ব্রেকের অবস্থা হয় গরুর গাড়ির মত। সহজে স্টিয়ারিং ঘোরানো যায় না আর ব্রেক ধরতে চায় না।
আমার মায়ের বান্ধবীর ঐ পুরনো মরিস মাইনর গাড়ি নিয়ে একবার তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ঢাল বেয়ে দোতলার বহির্গমন লাউঞ্জে উঠতে গিয়ে ভয় পেয়েছিলাম। ঢাল বেয়ে ওঠার সময় মাঝ পথে গাড়ি থেমে গেল। আর উপরে উঠতে চায় না, পারলে নীচের দিকে নেমে যায়। আমার আর আমার ভাইদের তো ইচ্ছা হয়েছিল নেমে গিয়ে ধাক্কা দেই। কিন্তু আল্লাহতায়ালার অসীম করুণায় গাড়িটা শেষ পর্যন্ত আগে পিছে করতে করতে কোন রকমে শামুকের গতিতে উপরে উঠতে সক্ষম হয়।
টিএনটি ফোন সব বাসায় ছিল না। ফোনের দোকান ছিল অনেক। ঢাকা থেকে চিটাগাং ফোন করতে হলে দোকানে গিয়ে বলতে হত। লাইন পেতে অনেক সময় ঘণ্টাখানেক সময় লাগতো। ততক্ষণ দোকানে অপেক্ষা করতে হত। আন্তর্জাতিক কলের ক্ষেত্রেও আগে বুক করতে হত। বাসায় ফোন থাকলেও একই হ্যাপা। কানেকশন পাওয়ার পর এক্সচেঞ্জ থেকে পরে যোগাযোগ করা হত কথা বলার জন্য। তখন ক্রস কানেকশন বলে একটা জিনিস ছিল। অর্থাৎ দুইজনে কথা বলছে মাঝখানে হঠাৎ তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব। দুই জনের কথা সে শুনতে পাচ্ছে। রাখতে বললেও রাখছে না। আবার আপনি ডায়াল করেছেন একজনের কাছে কিন্তু কানেকশন হয়েছে আরেকজনের সাথে। মহা বিড়ম্বনা। তবে ক্রশ কানেকশন বা রঙ কানেকশন থেকে অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম হয়ে যেত ঐ সময়। অনেক ছেলে দোয়া করতো যেন ক্রস কানেকশন হয়।
আমার এক বন্ধু একবার ফোন করেছে তার কোন এক আত্মীয়কে কিন্তু ফোন ধরেছে একজন বিবাহিতা যুবতী মেয়ে। মহিলা ভেবেছে যে তাকে বিরক্ত করার জন্য ফোন করেছে আমার বন্ধু। তাই বিরক্ত হয়ে সে বলে যে 'মেয়ে ধরেছে না মেয়ের নানী ধরেছে এটা তো বুঝতে হবে'। আমার বন্ধুও কম যায় না। সে রেখে দিয়ে আবার কল করে এবং ঐ মহিলাই আবার ধরে। মহিলা জিজ্ঞেস করে কাকে চাচ্ছেন। আমার বন্ধু বলে যে নানীকে চাচ্ছি। মহিলা মজা পেয়ে যায়। এভাবে এক কথায় দুই কথায় এদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক হয়ে যায়।
পরবর্তীতে তারা প্রায়ই গল্প করে সময় কাটাত। তবে এই ফোনে কথা বলা পর্যন্তই এই আলাপ ছিল। কোন সীমালঙ্ঘন ছিল না।
অনেক বড় অফিসে টেলেক্স বলে একটা জিনিস ছিল। টেলেক্স ছিল আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রুত মাধ্যম। সম্ভবত টেলিফোনের সাহায্যে টেলেক্স মেশিন চালানো হত। আমার ভালো ধারণা নাই। বিজনেস কার্ডে কোম্পানির টেলেক্স নাম্বার থাকতো।
১৯৮৫ সালেও দেখেছি তখন অনেকেই শর্টহ্যান্ড শিখত চাকরী পাবার জন্য। আমার ছোট ফুফু শর্টহ্যান্ড শিখেছিলেন চাকরী পাওয়ার জন্য। আমার বাবা টাইপিং এবং শর্টহ্যান্ড জানতেন। ডিকটেশন লেখার জন্য শর্টহ্যান্ড ব্যবহার করা হত।
কম্পিউটার যখন প্রথম আসে তখন এগুলিতে মাউজ ছিল না। কারণ উইন্ডোজ তখনও আসেনি। ফ্লপি ডিস্কে একটা ফাইল কপি বা পেস্ট করতে হলেও কোড ব্যবহার করতে হত। এই ধরণের কাজের জন্য বিভিন্ন ধরণের কোড সবাইকে শিখতে হত এবং মনে রাখতে হত । তখনকার অপারেটিং সিস্টেমের নাম ছিল ডস (ডিস্কেট অপারেটিং সিস্টেম)। এখনকার মত ক্লিক করলেই কপি বা পেস্ট হয়ে যেত না। আমিও ডসের কিছু কমান্ড শিখেছিলাম।
আমার একজন খালাত ভাই ছিলেন। উনি সারাদিন রেডিওর শর্ট ওয়েভের সাহায্যে বিভিন্ন দেশের খবর, খেলা, গান ইত্যাদি শুনতেন। যার কারণে ঐ যুগেও উনি বিদেশের অনেক খবর জানতেন। আমার ধারণা ইন্টারনেট পেলে উনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো ব্লগার হতে পারতেন। আমিও ওনার দেখাদেখি মাঝে মাঝে রেডিওর নব ঘুরিয়ে শর্ট ওয়েভে বিভিন্ন দেশের রেডিও স্টেশন ধরতাম। তবে অনেক ক্ষেত্রে শব্দ ভালো মত শোনা যেত না। অনেক সময় রেডিওর কোন গান ভালো লাগলে অন্য ছোট ক্যাসেট প্লেয়ার রেডিওর স্পিকারের সামনে ধরে রেকর্ড করতাম। তবে অনেক নয়েজ আসত। এখন এই ধরনের বিদেশী গান পাওয়া কোন ব্যাপারই না। চাইলেই শোনা যায় আর ডাউন লোড করা যায়।
ঐ সময় মোবাইল ছিল না। ১৯৯২ সালে আমার এক বন্ধু তার প্রেমিকার সাথে কথা বলার জন্য এক জোড়া ওয়াকি টকি কিনেছিল। তখন স্টেডিয়ামে ওয়াকি টকি পাওয়া যেত, যেগুলির আওতা ছিল ৩/৪ কিলোমিটার। আমার বন্ধুর বাসা খিলগাঁও ছিল আর তার বান্ধবীর বাসা ছিল রামপুরা।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে টিভির এন্টেনার সাথে হাড়ি পাতিল ঝুলালে ভারতের দূর দর্শন টিভি দেখা যেত। তখন আমাদের দেশের মানুষ অনেকে হিন্দি শিখে ফেলে ভিসিআর আর এই দূরদর্শন দেখে। ভিসিআর আমাদের সামনে আসল আবার আমাদের সামনেই চলে গেল।
১৯৮২ সালে বাসায় যখন ফ্রিজ কেনা যখন হল তখন একটা উৎসব উৎসব ভাব মনে হল। স্টেডিয়ামের দোকানদার আমাদের পেপসি খাওয়াল। দোকানদার পেপসি খাওয়ায় এই ব্যাপারটা আমাদের ধারণাতেই ছিল না। আমার বড় বোন ফ্রিজ ব্যবহার সংক্রান্ত কিছু কড়া নির্দেশনা দিল যেন আমরা ফ্রিজ না খুলি। যদি একান্ত কোন কারণে খুলতে হয় সেই ক্ষেত্রে ফ্রিজ কিভাবে খুলতে হয়, কিভাবে বন্ধ করতে হয় সেগুলি সে দেখিয়ে দিল। এগুলি সে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে শিখেছিল। এগুলিই আমাদের উপর কড়াভাবে প্রয়োগ করতে লাগলো। আরও কিছু আচার আচরণ আমার বোনের বদৌলতে শিখতে হয়েছিল। আগে আমার ভাত খাওয়ার পর প্লেটে হাত ধুতাম। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর আমার বোনের কাছে এগুলি খ্যাত খ্যাত লাগতো। তাই আমাদেরকেও শেখানো হল যে খাওয়ার পর প্লেটে হাত না ধুয়ে রান্না ঘরের কলে ধুতে হবে। আমার বোনের শাশুড়ির ছিল উচ্চ রক্তচাপ। তাই তিনি কাঁচা লবণ খেতেন না। আমার বোন সেটাও ভালো রপ্ত করেছিল। আমাদেরকে শেখানো হল যে কাঁচা লবণ খাওয়াও খ্যাত। সেটাও আমরা বাদ দিতে বাধ্য হলাম এবং কিছুটা সভ্য হলাম।
মার্কেটে খুব কম দোকানে এসি ছিল। অনেকটা বিরল বলা যেতে পারে। কোন দোকানে এসি থাকলে লেখা থাকতো ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’। এসিওয়ালা দোকানে ঢুকলে মনে হত এখানেই থাকি। বের হওয়ার দরকার নাই। তখন রঙিন বাংলা সিনেমা খুব কম হত। সিনেমার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো ‘আংশিক রঙিন ছবি’ অথবা ‘সম্পূর্ণ রঙিন ছবি’। আংশিক রঙিন ছবির ক্ষেত্রে সাধারণত গানগুলি রঙিন হতো।
১৯৮১ সালে ভিউ মাস্টার বলে একটা ছোট বাইসকোপ জাতীয় জিনিস আমার আব্বা বিদেশ থেকে নিয়ে আসেন। এটা দেখতে অনেকটা ছোট দূরবীনের মত। ক্ষুদ্রাকৃতির ফটো ফিল্ম একটা গোলাকৃতির চাকতির মধ্যে চক্রাকারে লাগানো থাকে। এই চাকতি ভিউ মাস্টারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখতে হয়। ভিউ মাস্টারে একটা হাতল আছে যেটা চাপ দিলে পরের দৃশ্য দেখা যায়। বাইস্কোপের মত বিভিন্ন ধরণের দৃশ্য থাকে এই ছোট চাকতির মধ্যে। একটা চাকতিতে বিদেশের একটা সি বীচের দৃশ্য ছিল। আমার বড় ভাই আর তার বন্ধুরা হাসছিল এটা দেখে। তারা সম্ভবত উল্টা পাল্টা কিছু দেখেছিল। কিন্তু আমি দেখেও বুঝতে পারছিলাম না যে তারা কোন জিনিসটা দেখে হাসছে। পরে না বুঝেও আমি বললাম যে আমিও বুঝেছি তারা কেন হাসছে। আমিও দেখেছি (আসলে কি দেখেছি জানি না)।
সুত্রঃ কোন সুত্র নাই
ছবিঃ পুরানো সেই দিনের কথা ব্লগ স্পট ডট কম
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২২ সকাল ৮:৪৭