বাচ্চার মাকে সনাক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু বাচ্চার বাবাকে অনেক সময় সনাক্ত করার প্রয়োজন পড়ে। কারণ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিয়ে ছাড়াই সন্তানের পিতা মাতা হওয়ার পরিমান অনেক বেড়ে গেছে। ২০১৪ সালের একটা হিসাবে চিলির ৭০% বাচ্চার জন্ম হয়েছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে। মেক্সিকোর ৬৫%, ফ্রান্সের ৫৮%, নরওয়ের ৫৫%, যুক্তরাজ্যের ৪৮%, যুক্তরাষ্ট্রের ৪০%। বলা যায় যে ইউরোপ, অ্যামেরিকায় গড়ে ৪০% বাচ্চার জন্ম হয়েছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে। এই হিসাব ২০১৪ সালের। এখন এই হার আরও বেশী নিঃসন্দেহে। ধারণা করা যায় যে অর্ধেক শিশুর জন্ম হয়েছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে। আমাদের এই অঞ্চলে এই হার খুব বেশী হবে না। জাপানে ২%, ইসরাইলে ৫%, তুরস্কে ৩%, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১.৫%। ভারতীয় উপমহাদেশ সহ এশিয়ার বাকি অংশে এই হার আরও কম হবে। তবে দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে এই অঞ্চলেও।
বিয়ে ছাড়া সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে পিতার পরিচয় জানা যায় না অথবা কয়েকজন পুরুষের মধ্যে কে পিতা সেটা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় (যদিও বিয়ের ক্ষেত্রেও অনেক সময় সন্দেহ সৃষ্টি হয়)। বীর্য ঢেলে দেয়ার পরে অনেক সুবিধাবাদী পুরুষ ভেগে যেতে চায় আবার অনেক পুরুষ পিতৃত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চায় কিন্তু প্রমাণের অভাবে পারে না। তবে বিবাহিত দম্পতিদের ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে যদি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ঘটে থাকে। পিতার পরিচয় না জানার কারণে কিংবা পরিচয় নিয়ে সংশয়ের কারণে কিছু সামাজিক, আবেগজনিত এবং আর্থিক সমস্যা হয়। যেমন সন্তান মানসিক কষ্টে ভোগে, সমাজ বাঁকা চোখে দেখে, সন্তানের খরচ মাকে একা চালাতে হয়, স্বামী, স্ত্রী বা দাম্পত্য পার্টনারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, দাম্পত্য কলহ এবং নির্যাতনের কারণে পরিবারে অশান্তি নেমে আসে।
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন ডিএনএ পরীক্ষার দ্বারা বাবাকে সনাক্ত করা যায়। অ্যামেরিকান একটা টিভি শো আছে যেটার নাম ‘প্যাটার্নিটি কোর্ট’।
এটা অনেকটা রেয়ালিটি শোয়ের মত। এই শোতে সন্তানের পিতৃ পরিচয় নির্ণয়ের জন্য সম্ভাব্য পিতা এবং প্রকৃত মাতাদের বক্তব্য শোনা হয়। পুরো কার্যক্রম আদালতের মত করে উপস্থাপন করা হয়। এই শোতে বিচারক হিসাবে থাকেন লরেন লেক নামের একজন অ্যামেরিকার প্রখ্যাত মহিলা আইনজীবী এবং আইন বিশ্লেষক। আদালতের মত উভয় পক্ষকে জেরা করা হয়, সাক্ষী হাজির করা হয়। সব শেষে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটা কেসের মিটমাট করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাদী বা বিবাদির আবেদনক্রমে লাই ডিটেকটর (মিথ্যা সনাক্তকারী যন্ত্র) ব্যবহার করা হয়। এই শো আসলে এক ধরণের আরবিট্রেশন (মদ্ধস্ততার মাধ্যমে মীমাংসা) প্রক্রিয়া। উভয় পক্ষ এখানে আসার আগেই এই শোয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় যে তারা এই সালিশি মেনে নেবেন। সাধারণত পরবর্তীতে প্রকৃত আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না এবং এই শোতেই মীমাংসা হয়ে যায়। ঘটনাগুলি সাজানো নয় বরং মানুষের জীবনের প্রকৃত ঘটনা।
উদাহরণ হিসাবে এই শোতে দেখানো একটা ঘটনা বলি। প্রেমিক প্রেমিকা অনেক দিন ধরে প্রেম ( লিভ ইন) করছে। তাদের পরবর্তীতে বিয়ের পরিকল্পনা আছে। কিন্তু প্রেম চলাকালীন সময়ে মেয়ের সাথে ছেলের সামান্য বিষয় নিয়ে মান অভিমান হয়। ফলে রাগ করে একে অন্যের সাথে কয়েক দিন কথা বলা থেকে বিরত থাকে বা কথা বললেও শুধু ঝগড়া ঝাটি করে। এই অবস্থায় মেয়েটি একদিন রাতে রাগ করে একা একটা মদের বারে যায়। মদ খাওয়ার পর তার আর কোন হুশ নেই। পরের দিন ভোরে সে স্বল্প বসনে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক পুরুষের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে। এই ঘটনা সে তার প্রেমিকের কাছে গোপন রাখে। পরে ওদের মিল হয়ে যায় এবং একসাথে শোয়ার কারণে ওরা সন্তানের পিতা মাতা হয়। সন্তান জন্ম গ্রহণের ২ মাস পরে মেয়েটার মধ্যে অনুশোচনা হয় ঐ রাত নিয়ে। সে অকপটে ছেলের কাছে স্বীকার করে যে এই বাচ্চা তোমার নাও হতে পারে কারণ আমি রাগ করে একটা বারে গিয়ে একটা আকাজ করে ফেলেছি। তখন থেকে ছেলের মনে সন্দেহ ঢুকে যায়। অবশেষে তারা (সন্তানকে অন্য জায়গা থেকে টিভি পর্দার মাধ্যমে দেখানো হয় আদালতে) এই শোতে উপস্থিত হয় নিজেদের এই সমস্যার সমাধানের জন্য। অনেক জেরার পরে এবং শেষে ডিএনএ টেস্ট এবং লাই ডিটেকটর ব্যবহার করে জানা যায় যে প্রেমিক পুরুষটাই সন্তানের পিতা। অবশেষে প্রেমিক পুরুষ আদালতে সবার সামনে হাটু গেড়ে বসে মেয়েটির কাছে বিয়ের প্রস্তাব করে। উভয়ে কান্নাকাটি করে একে অন্যকে ক্ষমা করে দিয়ে সুন্দর জীবন যাপনের অঙ্গিকার করে।
পরিবার ব্যবস্থা সভ্য সমাজের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে বর্তমানের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পরিবার ব্যবস্থা হুমকির মুখে। উন্নত বিশ্বে প্রায় অর্ধেক লোক বিয়ে ব্যতীত যৌন জীবন যাপন করে এবং কখনই বিয়ে করে না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিয়ের ৪৫% বিচ্ছেদে সমাপ্তি হয়। সুইডেনে এই হার ৫৫% চেয়েও বেশী। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশী। গড়ে উন্নত বিশ্বে একটা নারী বা পুরুষের জীবনে ৭ থেকে ৮ জন পার্টনার পরিবর্তন হয়। অনেক দেশে সমকামি বিয়ে আইনত সিদ্ধ এবং এই হার বাড়ছে দিনে দিনে। আমাদের এই অঞ্চলেও বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশংকাজনক হারে বাড়ছে। ছেলেরা ৩৫ বছরেও বিয়ে করছে না। অনেক মেয়ের বয়স ৩৫ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে করছে না বা হচ্ছে না। এই বিবাহ বিমুখতা আর বিবাহ বিচ্ছেদ সমাজের জন্য, শিশুদের জন্য সর্বোপরি মানব সভ্যতার জন্য একটা বিরাট হুমকি স্বরূপ। মানব সমাজের কল্যাণের জন্য বিবাহ প্রথাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। পশ্চিমের ভালোটা নিতে হবে খারাপটা বর্জন করতে হবে।
সুত্র - archive-yaleglobal.yale.edu/content/out-wedlock-births-rise-worldwide
ছবিঃ legalnaija.com
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:৩৮