
(১) সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানোর সময় পড়ে যাওয়া ঠেকাতে আমরা কী করি?
যে ব্লগাররা সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালাতে পারেন না, তাদের এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার সম্ভবনা কম। উত্তর হল আমরা যখন বাম দিকে পড়তে যাই তখন সাইকেলের হাতলও আমরা বামে ঘুরাই। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। সাধারণ আক্কেল বলবে যে বামে পড়তে গেলে হাতল ডানে ঘুরানো উচিত। কিন্তু আসলে বাম পাশে পড়া ঠেকাতে হলে হাতল ডানে না ঘুড়িয়ে বামেই ঘোড়াতে হবে।
কেন সাইকেল বাম পাশে পড়ার উপক্রম হলে হাতল বামেই ঘুরাতে হবে? প্রথমে মানতে হবে যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে অন্য সব জিনিসের মতই সাইকেলও মাটিতে পড়ে যেতে চায়। সাইকেলের চালক বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করে সাইকেলকে পড়া থেকে বিরত রাখে। কেন বামে ঘুরাতে হবে, কী সেই বৈজ্ঞানিক কৌশল? কৌশলটা হল নিউটনের গতি জড়তার সফল প্রয়োগ।
মানব সভ্যতায় সাইকেলের উদ্ভাবন হয় প্রায় ২০০ (১৮১৭ সালে) বছর আগে। একটা দুই চাকার চলন্ত সাইকেল কেন ডানে বা বামে পড়ে যায় না, এটা নিয়ে যুগে যুগে অনেক গবেষণা হয়েছে। কয়েক দশক আগে মনে করা হত যে গাইরস্কপিক এফেক্টের কারণে এবং কাস্টার এফেক্টের কারণে সাইকেল পড়ে যায় না। গাইরস্কপিক এফেক্ট বলতে বুঝায় যে একটা দ্রুত ঘূর্ণায়মান বস্তু পারিপার্শ্বিক মহাকর্ষ বা অন্যান্য বল দ্বারা খুব সামান্য প্রভাবিত হয়। যেমন একটা ঘূর্ণায়মান লাটিম পড়ে যায় না যতক্ষণ ঘুরতে থাকে। আর কাস্টার এফেক্টের উদাহরণ হল বিমানবন্দরের ট্রলি। ট্রলি ডানে ঘুরালে সবগুলি চাকা নিজে থেকেই ডানে ঘুরে যায়। কিন্তু সর্বাধুনিক গবেষণা অনুযায়ী বলা হচ্ছে যে গাইরস্কপিক এফেক্ট এবং কাস্টার এফেক্ট সাইকেলের ভারসাম্য রাখতে সামান্য সাহায্য করলেও দেখা গেছে যে এই এফেক্ট দুটি ছাড়াও একটা সাইকেলকে ভারসাম্য রাখার অন্য বড় একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে।
নিউটনের ১ম সূত্র থেকে এটার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। নিউটনের ১ম সূত্র হল বাইরে থেকে কোনো বল প্রযুক্ত না হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল সমবেগে (অর্থাৎ, সমদ্রুতিতে সরলরেখায়) গতিশীল থাকবে। এটাকে বলে বস্তুর জড়তা। একটা গাড়ি যখন ডানে ঘোরে বা বাক নেয় তখন যাত্রীরা বাম দিকে হেলে পড়ে। এটার কারণ হল, গতি জড়তার কারণে গাড়ি ডানে ঘুরলে যাত্রীরা বামে হেলে যায়। অর্থাৎ গাড়ি দিক পরিবর্তন করলেও যাত্রীরা বস্তুর জড়তার কারণে আগের দিকেই চলতে চায়। ফলে তারা বামে হেলে পড়ে। সাইকেলের চালক এই সূত্র ব্যবহার করে সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। সাইকেল যখন সোজা অবস্থায় চলমান থাকে তখন কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু যখন রাস্তার কারণে বা অন্য কোন কারণে সাইকেল ডান পাশে হেলে পড়তে থাকে তখন সাইকেল চালক হাতল ডানে ঘুরায়, ফলে সাইকেল এবং তার চালক বামের দিকে হেলে যায় এবং সাইকেল পুনরায় ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় চলে আসে। উপরে দেয়া গাড়ির উদাহরণের সাথে মিলানোর চেষ্টা করলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে।
এই কারণেই গাইরস্কপিক এফেক্ট এবং কাস্টার এফেক্ট সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষায় সামান্য ভুমিকা রাখলেও মুলত সাইকেল চালক গতি জড়তার সুবিধা নিয়ে যে দিকে সাইকেল পড়তে যাচ্ছে সেই দিকেই হাতল ঘুড়িয়ে পতনের বিপরীত দিকে চাপ তৈরি করে সাইকেলকে পুনরায় ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসছে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে চালকবিহীন সাইকেলকেও গাইরস্কপিক এফেক্ট এবং কাস্টার এফেক্ট ছাড়াই নিউটনের জড়তার সূত্র কাজে লাগিয়ে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে। আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে আগের ধারণা ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষার মূল কারণ হল চালক কর্তৃক বস্তুর জড়তার প্রবণতার সফল ব্যবহার।
আমরা উপরে জানলাম যে সাইকেল ডানে পড়তে নিলে হাতল ডানে ঘুরাতে হবে। কৈশোর কালে আপনার বান্ধবী যখন বাম পাশ থেকে সাইকেলের সামনে বসেছিল তখন খেয়াল করেছেন যে হাতল বারবার বামে ঘুরাতে হয়েছে। কারণ আপনার বান্ধবী বামে বসার কারণে সাইকেল বাম পাশে বারবার পড়তে চেয়েছে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ত খেয়াল করেছেন যে বান্ধবীকে পিছনের ক্যারিয়ারে না বসিয়ে সামনে বসালে সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষা করতে সুবিধা হয়। এটার কারণ আমার কাছে পরিষ্কার না। সম্ভবত সামনে বসালে দুই জনের মিল মহব্বতের কারণে সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হয়। আশা করি অচিরেই এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রকাশ পাবে।
আরেকটা মজার ব্যাপার হল বানর পর্যন্ত নিউটনের সুত্র মেনে সাইকেল চালাতে পারে। বানরদের মধ্যেও যে এতো বুদ্ধিমান বানর আছে এটা আমার জানা ছিল না।

(২) এই তথ্যটা জানলে সাঁতার শেখা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবেঃ

আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন সুইমিংপুলে একজন সাদা চামড়ার লোককে দেখলাম যে, সে পানির উপরে সোজা চিত হয়ে ভেসে চলেছে। পায়ের পাতা সামান্য নাড়াচ্ছে ফলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম তখন। পরে বড় হওয়ার পরে জানতে পারলাম যে আসলে মানুষের দেহ এমনিতেই পানিতে ভাসে। আপনি চাইলেও তলিয়ে যেতে পারবেন না। শুধুমাত্র আমাদের মাথাটা পানিতে ভাসে না। আর্কিমিডিসের সূত্র অনুযায়ী পানিতে ডুবালে একটা বস্তু যে পরিমান পানি সরিয়ে দেয় সেই পানির ওজন যদি ঐ বস্তুর ওজনের চেয়ে বেশী হয় তাহলে বস্তুটা ভাসবে। আর যদি পানির ওজন বস্তুর ওজনের কম হয় তাহলে বস্তুটা ডুবে যাবে। এই কারণেই লোহার তৈরি বিশাল জাহাজ সহজেই পানিতে ভাসে।
আর্কিমিডিস সাহেব ল্যাংটা হয়ে চৌবাচ্চায় গোসল করতে নামার মুহূর্তে উপরে উল্লেখ করা এই যুগান্তকারী সুত্র আবিষ্কার করেন। উনি দেখেন যে পানিতে নামার সাথে সাথে কিছু পানি চৌবাচ্চার বেষ্টনী উপচিয়ে বাইরে পড়ে গেল। আর তখনই উনি খুশিতে ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ (আমি পেয়েছি) বলে উলঙ্গ অবস্থাতেই দৌড়ে সবার কাছে গিয়ে তার নতুন আবিষ্কারের কথা জানান।
যেহেতু আমাদের মাথা ব্যতীত বাকি দেহ এমনিতেই পানিতে ভাসে তাই সাঁতার বলতে আমরা সেই কৌশলকে বুঝি যার দ্বারা মাথাকে পানির উপরে রাখার চেষ্টা করা হয়। আমাদের ফুসফুস বাতাসে পূর্ণ থাকার কারণেও মানব দেহ পানিতে ডুবতে চায় না। আর্কিমিডিসের সুত্রের কারণেই মোটাসোটা এবং চর্বিওয়ালা লোকদের জন্য স্লিম লোকের চেয়ে সাঁতার কাটা সহজ। দেহে যত বেশী চর্বি থাকবে তত সহজে পানিতে ভেসে থাকতে পারবেন। তাই কেউ সাঁতার শিখতে চাইলে গায়ে এখনই চর্বি লাগানোর চেষ্টা করবেন। কারণ পেশী এবং হাড্ডির চেয়ে চর্বির ঘনত্ব কম। মাথার মধ্যে যাদের ঘিলুর বদলে চর্বি থাকে তাদের সাঁতার শেখার কোন দরকারই পড়বে না। কারণ সেই ক্ষেত্রে মাথাও এমনিতেই পানিতে ভাসবে। এই ব্লগে অনেকের মাথার মধ্যে ঘিলুর চেয়ে চর্বি বেশী আছে বলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়। আসলে পানিতে পড়লে ভয়ের কারণে বেশীর ভাগ মানুষ পানিতে ডুবে মরে। ভয়ে পেট ভরে পানি খেয়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়।
আরেকটা ব্যাপার হল পানির ঘনত্ব বেশী হলে সাঁতার কাটতে সুবিধা হয়। এই কারণেই সমুদ্রের (বুড়িগঙ্গা নদীর পানির ঘনত্ব সমুদ্রের মত হতে পারে) লবনাক্ত পানিতে নদী, পুকুর বা খালের চেয়ে সাঁতার কাটা সহজ। আরেকটা বিষয় হল সাধারণত মৃত দেহ পানিতে উপুড় হয়ে ভাসে। কারণ দেহের হাত, পা ভারি থাকে ফলে দেহ সাধারণত উপুড় হয়ে যায়। পেট মোটা বা ভারি নিতম্বের মানুষ বা অন্তঃসত্ত্বা নারীর ক্ষেত্রে তাদের মৃতদেহ পানিতে চিত অবস্থায় থাকে অনেক ক্ষেত্রে। কারণ তখন পেটটা বয়ার মত কাজ করে। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা স্বাভাবিক সাঁতারের বদলে ব্যাকস্ট্রোক সাতারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কারণটা আশা করি আপনারা বুঝতে পারবেন।
আমার সাঁতার নিয়ে উপরের কথাগুলি বিশ্বাস না হলে সুইমিংপুল বা নদী বা পুকুরের তলদেশে হেটে কেউ দেখাতে পারেন। পারলে বুঝবো আমার বোঝায় ভুল আছে।
https://www.wtamu.edu/~cbaird/sq/2013/04/18/what-keeps-a-bicycle-balanced/
https://www.physicsforums.com/threads/caster-angle-in-bikes-cars-why-do-we-need.717913/
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১২:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


