somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে শত্রুতার শেষ নেই: আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল (মেগা পোষ্ট)

২৭ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




কার্লোস তেভেজ তখন সদ্যই করিন্থিয়াস থেকে ইংল্যান্ডে এসে ওয়েস্টহ্যামে উঠেছেন। চড়া মেজাজের জন্য খ্যাত এই আর্জেন্টাইন একদিন অনুশীলনে দেরী করে আসায় কোচ একটা শাস্তি দিলেন—আজ ব্রাজিলের জার্সি পরে অনুশীলন করতে হবে! তেভেজ কোচের নাকের সামনে আঙুল নেড়ে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে এক্ষুণি ওয়েস্টহ্যাম ছেড়ে দেব, প্রয়োজনে সারা বছরের বেতন জরিমানা দেব; তাও ব্রাজিলের জার্সি পরবো না।’ হ্যাঁ, এটাই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের ফুটবল সম্পর্ক।

লাতিন আমেরিকার পাশাপাশি দুটি দেশ, ফুটবলের দুই পরাশক্তি, সংস্কৃতিতে কম-বেশি মিল আছে; কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ফুটবল, তখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত দুই শত্রুপক্ষের নাম—ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা! বিশ্বকাপের সময় আমাদের এই বাংলাদেশের অলি-গলি দেখলেও লাতিন এই দুই পরাশক্তির দাপুটে শত্রুতাটা দিব্যি টের পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বিশ্বকাপ বুঝি এই দুটি দেশের কোনো টুর্নামেন্ট; বাকিরা থেকেও নেই। এটা শুধু বাংলাদেশের চিত্র, এমন ভাবলে ভুল হবে। পুরীর সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে আফ্রিকার না চেনা কোনো গ্রাম; সবখানে আজ উপকথার মতো ছড়িয়ে গেছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের এই রেষারিষি। সরাসরি বিশ্বকাপ খেলে এমন দেশগুলো বাদে, বাকি প্রতিটা দেশই মূলত এই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় মজে থাকে ফুটবলের প্রসঙ্গে। কিন্তু কেন? কেন, কবে, কিভাবে এই মিত্র দুটি দেশ শত্রুতে পরিণত হল?

এই ব্যাপারটা জানতে আমাদের একটু ফিরে যেতে হবে বিংশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। তখন এই দুটি দেশ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে তো বটেই, ফুটবলেও দারুণ বন্ধু দেশ ছিল।

১৯০৯ সালে পরবর্তীকালের আর্জেন্টাইন রাষ্ট্রপতি রকি সায়েনস পিনা ব্রাজিল সফরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সব কিছুতেই আমরা একত্রিত আছি। কোনো শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।’ পরের অন্তত চারটি দশক ধরে এই কথাটা ফুটবলেও সত্যি ছিল। তখন আসলে লাতিন আমেরিকায় লড়াইটা ছিল আর্জেন্টিনা বনাম উরুগুয়ে; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বেরই লড়াই ছিল সেটা। অলিম্পিক থেকে বিশ্বকাপ ফাইনাল; সব জায়গাতেই এই দু’ দলের লড়াই। এদের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা ছিল, যুদ্ধ ছিল। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বরং হাতে হাত মিলিয়ে প্যারাগুইয়ান যুদ্ধে লড়েছে, ব্যবসা করেছে এবং ফুটবলে পরস্পরের খেলোয়াড় আদান-প্রদান করে সমৃদ্ধ হয়েছে। ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা আর্জেন্টাইন লিগে ছিলেন নিয়মিত। কালক্রমে ব্রাজিল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং আর্জেন্টাইন বন্ধুদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বিপুলসংখ্যায় আর্জেন্টাইন ফুটবলার সান্তোস থেকে শুরু করে ভাস্কো, ফ্লামেঙ্গোতে খেলেছেন। আর্জেন্টিনার গোলরক্ষকদের জন্য ব্রাজিলে সেটা তো স্বর্ণযুগ ছিল।

হ্যাঁ, এই সময়েও দু’ দলের খেলায় গণ্ডগোল হয়েছে, পরস্পরের সমর্থকরা হাতাহাতি করেছেন; কিন্তু সেগুলো বন্ধুদের মধ্যেও হয়। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ১৯১৩ সাল থেকে কোপা-রোকা নামে একটি টুর্নামেন্ট খেলতো; যাকে বলা যায়, সম্প্রীতির এক দারুণ উদাহরণ। এখানে খেলাটা পরিণত হত যেন দুটি দেশের মিলন মেলায়। দুই দেশের ভাই-বন্ধুরা উত্সবে মেতে উঠতো তখন। কিন্তু হঠাত্ করেই চল্লিশের শেষ ও পঞ্চাশের শুরু থেকে পরিস্থিতিটা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করলো। একদিকে আর্জেন্টিনা বিশ্ব শাসন করা ফুটবল দল নিয়েও বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে অংশই নিচ্ছে না, অন্যদিকে ব্রাজিল তার সুন্দরতম ফুটবলের পসরা দিয়ে বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট এবং বিশ্বের মানুষের মন জিতে নিচ্ছে।

ব্রাজিলিয়ান বিশ্লেষক নিউটন সিজার ডি অলিভিয়েরা তার বইয়ে লিখেছেন, এই সময় থেকেই আসলে আস্তে আস্তে শত্রুতার মেঘ জমতে থাকে। একদিকে ব্রাজিলিয়ানরা মনে করতে থাকে, তারা তাদের প্রতিবেশী পুরোনো বন্ধুদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দলে পরিণত হয়েছে। আর আর্জেন্টাইনরা মানসিক অবদমনের মধ্যে পড়ে যে, সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা স্বীকৃতি পাচ্ছে না। আর বিস্ফোরণটা ঘটে ব্রাজিল তিন বিশ্বকাপ জিতে ফেলার পর আর্জেন্টিনা প্রথম একটি বিশ্বকাপ জিতলে। আর এর বহিঃপ্রকাশই ঘটে ১৯৭৮ বিশ্বকাপের বিখ্যাত ‘ব্যাটল অব রোসারিও’ ম্যাচে।

ডি অলিভিয়েরা লিখেছেন, ‘এটাকেই আসলে আমরা ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারি। এরপর আর্জেন্টিনা যখন দুটো বিশ্বকাপ জিতলো এবং বিশ্বজুড়ে একটা সম্মান তৈরি করতে পারলো, তারা জমে থাকা ক্ষোভটা প্রকাশ করলো। এই সময় থেকেই আসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা বিস্ফোরিত হল এবং ভয়ঙ্কর চেহারায় আবির্ভূত হল।’ এর মধ্যে আবার ইউরো গঠন হয়ে যাওয়ায় আরো একটা ঘটনা ঘটল। ইউরোপের ক্লাবগুলোর বিদেশি খেলোয়াড় কোটায় আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা থেকে খেলোয়াড় বেশি নেয়ার সুযোগ তৈরি হল। ফলে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়ের ব্রাজিলের ওপর নির্ভরশীলতা কমে গেল। ফলে বন্ধুত্বের এই সুতোটাও ছিন্ন হতে বসলো।

এরপর আসলে দিনকে দিন এই সম্পর্কটা তেঁতোই হয়েছে। আর্জেন্টিনা নতুন করে আর বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। ব্রাজিল আরো দুটি বিশ্বকাপ জিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব আরো ওপরে তুলে নিয়ে গেছে। ফলে ভারসাম্য বলতে যা বোঝায়, সেটা আর ঠিক টিকে নেই। আক্ষরিক অর্থে ব্রাজিল এখন ইতালি বা জার্মানির কথা ভাবতে পারে; আর্জেন্টিনার কথা নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এখন আর এই ট্রফির সংখ্যাতেও আটকে নেই। এটা এক বড় মনস্তাত্তিক লড়াইয়েও পরিণত হয়েছে। যার বহিঃপ্রকাশ আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচগুলোর শেষে হাতাহাতি, গ্যালারিতে উত্তেজনা, কথার লড়াই দিয়েও আপনি বুঝতে পারবেন।

হ্যাঁ, দুনিয়া অনেক পেশাদার হয়ে গেছে। হুয়ান পাবলো সোরিন, কার্লোস তেভেজ থেকে শুরু করে অনেকেই আবার ব্রাজিলে ফুটবল খেলছেন। মেসি-নেইমাররা এক ক্লাবে বন্ধুও হচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। জাতীয় দলের খেলার প্রশ্ন এলেই সেই তিঁতকুটে অনুভূতি এসে দাঁড়াচ্ছে সামনে। সে অনুভূতি নিয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা বলেছেন, ‘আমি ব্রাজিলিয়ানদের হারাতে পছন্দ করি। যে কোনো ব্রাজিলিয়ানও আর্জেন্টিনাকে হারাতে সবচেয়ে পছন্দ করে। আমি বলি, পৃথিবীর সুন্দরতম অনুভূতি হল, ব্রাজিলকে হারানো।’

চলতি বিশ্বকাপটা যখন সেই ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হবে এবং ঘটনাচক্রে বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দুই দলও এই দুটি; তখন এই শত্রুতা গন্ধ যে বাতাসে আরো একবার ছড়াবে, তাতে আর সন্দেহ কী! সে জন্যই কি না, লুই ফেলিপ স্কলারি বলছেন—আমি চাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল। তাহলেই তো কম্ম কাবার! যুদ্ধটা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আর কী! তথ্যসূত্র
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×