গলির মাথাটায় দাড়িয়ে আছে বাকের। চুলগুলো সুন্দর করে সিঁথি কাটা। ছোটবোন বের হওয়ার সময় সিঁথি কেটে দিয়েছে। তার কেন জানি মনে হয় পৃথিবীর সব মায়া যেন সৃষ্টিকর্তা তার বোনের চোখ দুটির মধ্যে ভরে দিয়েছেন।আজকে দুপুরে বোনের রেজাল্ট বের হবে আর তাই কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে বাসায় ফিরতে হবে।এক ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে আছে কিন্তু সুবিধে মতো শিকার পাচ্ছে না।পকেটে হাত দিয়ে জিনিষটা আছে কি না আবার দেখে নিল বাকের।কাজটা শেষ করতে পারলে আর কোন সমস্যাই থাকবে না।ছোটবোনটার চোখের অপারেশনটা করিয়ে নিতে পারবে।ডাক্তার বলেছে আর দেরি করা যাবে না।
কাজটা শেষ করেই অবন্তি কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে ঠিক করলো বাকের। তাছাড়া বাবাকে কিছু কাপরচোপড় কিনে দেয়া দরকার। আর মাকে একটা ভাল চশমা কিনে দিতে হবে, ভাল হয় ডাক্তার দেখিয়ে নিলে।তার এক খালা ভুলভাল চশমা ব্যাবহার করে চোখের বারোটা বাজিয়েছে। বাঙালি মহিলাদের এই এক দোষ কিছু হলেই নিজেরা ডাক্তারি করবে। এতো সহজ হলে কি আর কেউ পাচ বছর লাগিয়ে ডাক্তারি পড়তো। এখন তো আবার সেশনজট সহ ছয় সাত বছর লেগে যায়।তার ওপর বিদেশ থেকে ডিগ্রী না নিয়ে এলে ভাল ডাক্তার হওয়া যায় না।
যাইহোক একটা রিকশা এদিক দিয়েই আসছে।রিকশার মধ্যে মাঝবয়েসী দুটি ছেলেমেয়ে বসে আছে। ছেলেটি মেয়েটির হাত অকারনে ধরে আছে। এমনিতেই সূর্যের মধ্যে দাড়িয়ে আছে এর উপর এই দৃশ্য দেখে মেজাজটা সপ্তমে উঠলো বাকের এর। জানে এদের কাছে খুচরো পয়সা ছাড়া কিছুই পাবে না। এদের দৈনিক রুটিন জানা আছে বাকের এর। দুটাকার বাদাম আর পাচ টাকার ঝালমুড়ি দিয়ে এরা সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে পারে।এই ধরনের ছোকরাছোকরি পকেটে পাঁচ টাকা থাকলেও ডেটিংএ বের হয়ে যায়।সরকারও এদের জন্য বড় বড় পার্ক করে দিয়েছে ডেটিং এর জন্য। দেশটার জন্য বড়ই মায়া হয় বাকেরের।কোথায় যাচ্ছে এই দেশটা।
ইচ্ছে করছে রিকশাটা থামিয়ে দুজনকে দুটি বিরাশি সিক্কার চড় বসাতে।মেয়েটাকে সামান্য আস্তে মারা যেতে পারে তবে ছেলের জন্য কঠিন শাস্তি।কিন্তু ইচ্ছে করলেও ইচ্ছেকে দমন করতে হলো বাকের এর। এইসব মশা মাছি মেরে লাভ হবে না, তার বড়সড় কিছু দরকার। পকেটে হাত দিয়ে আবারও দেখে নিল বাকের জিনিসটা জায়গা মতই আছে। তার ছাত্রীর কাছ থেকে জিনিসটা চুরি করেছে বলে প্রথম খারাপ লেগেছিল। কিন্তু পরে নিজেকে বুঝিয়েছে কাজ শেষ হয়ে গেলে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে খেলনার পিস্তলটা। খেলনা হলেও দেখে বোঝার উপায় নেই।তার ছাত্রীর বাবা সুইডেন থেকে মেয়ের জন্য এই খেলনা নিয়ে এসেছেন। আজকালকার বাবা মা দেরও যে কি হচ্ছে। মেয়ের জন্য ভয়ঙ্কর দেখতে পিস্তল নিয়ে এসেছেন বাবা। আগেকার দিনে মেয়েদের পুতুল দিলেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত আর এখন তাদের জন্য বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করতে হয়। নাহ দেশের ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে আবারও সন্দিহান হয়ে পরে বাকের। মাঝেমধ্যেই দেশকে নিয়ে ভাবে বাকের।
রাস্তার অন্যপাশে তাকায় বাকের, এক অন্ধ ভিখারি দেখতে পায়। অবন্তির কথা মনে পরে যায় বাকের এর। কদিন আগেও বোনটা তার আর দশজনের মতো দেখতে পেত।মাধ্যমিক পরিক্ষার শেষ দিন বাসায় ফিরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পরে যায় অবন্তি। সেই থেকেই দুই চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পারে না অবন্তি। বোনের দিকে তাকিয়ে বুকটা মুচড়ে উঠে বাকের এর। বাবা অনেক চেষ্টা করেছে অফিস থেকে জরুরী ভিত্তিতে কিছু টাকা তোলার কাজ হয় নি। উপরন্ত বড়সাহেব চাকরি থেকে ছাটাই করার হুমকি দিয়েছেন। অপারেশনের টাকা যোগাড় করতে তাই এই কাজটা করা ছাড়া গতি নেই বাকের এর। নিজে বেকার ঘুরছে আর তার বাবার পিয়নের চাকরীর উপর কোনরকম টিকে আছে সংসারটা। মা সারারাত সিজদায় পরে কাদতে থাকেন। বোনটা প্রথমে কয়েকদিন অনেক কান্নাকাটি করেছিল, এখন সেও অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। বোধহয় ধরেই নিয়েছে বাকিতা জীবন অন্ধ হয়েই থাকতে হবে।
নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া কিছুই যেন করার নেই তার। এসব কথা ভাবতে ভাবতে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে বাকের এর। দূরে একটা রিকশা আসছে একটা লোক ব্রিফকেস নিয়ে বসে আছে। দেখামাত্রই স্থির করে ফেলল বাকের যা করার এখনি করে ফেলতে হবে।রিকশাটা এগিয়ে আসছে। বাকের এগিয়ে যেতে শুরু করলো। তার মনে হচ্ছে যেন হ্রদপিন্ডটা যেন বের হয়ে আসবে খাচা ছেড়ে। আর একটু সামনে এগিয়ে রিকশাটার পথ আগলে দাঁড়ালো বাকের। হাত দিয়ে রিকশার হেন্ডেল ধরল বাকের। রিকশাচালকের দিকে তাকিয়ে পিস্তলটা বের করে আনল বাকের। রিকশাচালককে দেখে তেমন চিন্তিত মনে হলো না। সে জানে সে ভিক্টিম না। বাকের এর ক্ষণিকের জন্য মনে হল রিকশাচলক ব্যাপারটা উপভোগ করছে। সে চালকের আসন থেকে নেমে পাশেই দাড়িয়ে রইলো যেন খুব মজার কিছু একটা এখনি শুরু হবে। ব্রিফকেস হাতে লোকটার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাতে গালি দিল বাকের।
“শালা শুওরের বাচ্চা, যা আছে দিবি নাকি মাথায় বুলেট হান্দাইয়া দিমু?”
লোকটা ভয়ে কুঁকড়ে গেছে তবে মস্তিষ্ক এখনো কাজ করছে বলে মনে হল। আস্তে করে মাথা নাড়ল। বাকের ব্রিফকেসের দিকে হাত বাড়াল। লোকটা কোন বাধা দিলনা। পিস্তলটা তাক করে রেখেই পিছু হঠতে শুরু করল বাকের। তাকিয়ে আছে রিকশার দিকে। আর খানিকটা পিছনেই অন্য আরেকটা গলি। গলিটা আন্দাজ করে উল্টো হয়ে হাটতে লাগল বাকের। তার মনে হচ্ছে আজকের পর থেকে জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
গলির মাথায় চলে এল বাকের। তখনই আওয়াজটা শুনতে পেল সে। ঘুরে দাড়াতেই গলি থেকে বেরিয়ে আসা ট্রাকটাকে দেখতে পেলো বাকের। সরে যাওয়ার সময়টুকু পেল না বাকের। ট্রাকের ধাক্কায় তার দেহটা মুহূর্তের মধ্যে শূন্যে উঠে গেল। তীব্র ব্যাথার মধ্যেও বাবা মা আর বোনের চেহারাগুলো ভেসে উঠল বাকেরের সামনে। প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে মাথায়। বেচে থাকার তীব্র ইচ্ছে করছে বাকের এর। ইচ্ছে করছে তার মাকে একটিবার দেখতে। ইচ্ছে করছে বোনটাকে শেষবার এর মতো জড়িয়ে ধরতে। জীবনের অনেকগুলো অপূর্ণ ইচ্ছের মতো তার মৃত্যুর আগের এই ইচ্ছেটাও পূরণ হয় না। নিথর দেহ পরে থাকে রাস্তার উপরে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৭:০০