শাহবাগ এর আন্দোলন শুরু হয় ৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তে। এর পরবর্তী সব ঘটনা আমরা সবাই কম বেশি জানি। আজকে আমি এখন পর্যন্ত শাহবাগ এর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি কথা বলব। আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই। আমি নাস্তিক নই। আমি মৌলবাদী দের কেউ নই। আমি আওয়ামী সমর্থক নই, আমি বিএনপি ও করি না। আমি হেফাজত নই, নই আমি জামাত বা শিবির এর কেউ। আমি গর্ব করে বলি আমি মুসলমান, আমি বাঙালী। আমি এক মুক্তিযুদ্ধার গর্বীত সন্তান।আমি যতদূর পারি এক সাধারণ নিরপেক্ষ তরুন এর দৃষ্টিকোন থেকে চেষ্টা করেছি পুরো লিখাটা লিখবার। এরপরও যদি আমার লিখা কারো কারো গাত্রদাহন এর কারন হয়ে দাড়ায় তবে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
একটা আইনি মামলায় যে রকম বাদি বিবাদী থাকে তেমনি প্রত্যেক ঘটনার ক্ষেত্রে ও একই। শাহবাগ এর ক্ষেত্রে যদি আমরা দুই পক্ষ কে আলাদা করি তবে দেখতে পাবো শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয়েছিলো মুলত ব্লগার আর অনলাইন এক্টিভিস্টদের দিয়ে। এদের প্রথম দাবি ছিল কাদের মুল্লার ফাসির দাবি। এখন আমরা যদি দেখি এদের প্রাথমিক প্রতিপক্ষ কারা ছিল। সন্দেহাতীতভাবে জামাত ও তার ছাত্র সংগঠন শিবির।
ব্লগারদের কর্মসূচীতে জনগন সাড়া দিল। শাহবাগ সোচ্চার হয়ে উঠল প্রতিবাদি মানুষের কণ্ঠে।সাধারণ মানুষের অসাধারণ এই গনজাগরন দেখে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোও আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। এখানে বলে রাখা উচিত যে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্ঘে জড়িত অনেকই আন্দোলনের প্রথম থেকেই রাস্তায় ছিলেন তবে তা ছিল দলীয় পরিচয়ের বাইরে। পরবর্তীতে আন্দোলন বড় আকার ধারন করলে ছাত্রলীগের সক্রিয় অংশগ্রহন চোখে পরে।আমার দৃষ্টিতে বিএনপি তখন তাদের প্রথম ভুলটি করে। তাদের উচিত ছিল আন্দোলনে সমর্থন দেয়া।বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হলো যে তারা বিষয়টি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এবং তারা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে যে আন্দোলন কে প্রভাবিত করার চেষ্টা হতে পারে। আজ এক বছর পরে কোন সন্দেহ নেই তাদের আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে দেশের মানুষের সাথে এক কাতারে এসে যদি বিএনপি প্রথমেই আন্দোলনে যোগ দিত তবে কি এমনটি হতো? ধরে নিলাম তখনও সরকারি দলের ক্যাডাররা আন্দোলন ছিনতাই করে নিত কিন্তু দেশের মানুষের সমর্থন তখন বিএনপির সাথে থাকত। কেউ তাদের কে প্রশ্ন করতে পারত না যে কেন আপনারা একটিবারের জন্যেও আন্দোলনে যোগ দেন নি।যখন দল মত নিরবিশেষে সবাই এসে যোগ দিল আন্দোলনে তখন ছিলনা শুধু বিএনপি জামাত।
তো এই পর্যায়ে আবার বাদি বিবাদির দিকে তাকানো যাক।শাহবাগ এর পক্ষে ছিল বাংলার আপামর জনতা, সরকারি দল সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রায় সব দল ও সংগঠন। সূত্রঃ প্রথম আলো ৫ই ফেব্রুয়ারী অনলাইন সংস্করণ
নয় ফেব্রুয়ারীতে বিএনপির রাজধানিতে বিক্ষুভ সমাবেশ করার কথা থাকলেও তারা করেনি। বিএনপি এই গনজাগরন দেখে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলেও শাহবাগের আন্দোলনে যোগদান করলনা।তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও শাহবাগের আঙ্গিনা মারায় নি। সূত্রঃ ১০ই ফেব্রুয়ারী ২০১৩
বিএনপি তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় শাহবাগের উপর ১১ই ফেব্রুয়ারী। তারা তাদের প্রতিক্রিয়ায় আশঙ্কা প্রকাশ করে যে শাহবাগের আন্দোলন কে সরকার দলিয়করনের চেষ্টা চালাচ্ছে। সূত্রঃ১২ই ফেব্রুয়ারী ২০১৩
তো যাইহোক আপনাদের বেশি বিরক্ত করবনা। ফাস্ট ফরওয়ার্ড করছি কাহিনি। যখন জামাত শিবির দেখল যে আন্দোলন বেশ মাথাচারা দিয়ে উঠেছে তখন তারা চিন্তায় পরে গেল কি করা যায়। এর মধ্যে জেনে গেল যে এই ব্লগারদের মধ্যে বেশ বড় একটা অংশ নাস্তিক আর শুধু নাস্তিক নয় বরং ইসলাম বিরোধী। তাদের চাল পেয়ে গেল জামাত শিবির। খুন করা হল রাজিব কে। ফুসে উঠল শাহবাগ আর পুরো বাংলাদেশ (তারা তখনো জানে না রাজিবের কাণ্ডকারখানা। আমি মনে করিনা যদি রাজিবের কথা সবাই জানত তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাসায় গিয়ে তাকে শহীদের মর্যাদা দিতেন বা পরের দিন তার নামাজের জানাজায় এত মানুষের ভিড় হত। তাই বলে ভেবে বসবেন না আমি রাজিবের হত্যাকাণ্ড কে সমর্থন করছি।)
আস্তে আস্তে বের হয়ে এলো রাজিবের ইসলামবিরোধী ব্লগ আর ভাবনার কথা। ততক্ষনে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে বসেছেন। আর আগুনে তেল ঢালার মতো আমার দেশ পত্রিকা রাজিবের ব্লগের লিখা হুবহু ছাপিয়ে দিল।জামাতের চাল কাজে লেগে গেল। আগে তারা একাই ছিল আসামি পক্ষে আর এখন তাদের দলে যোগ দিলো হেফাজত ইসলামি। হেফাজতে ইসলামি কখনই রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। তাদের প্রতিবাদ আর কথাবার্তা ছিল শুধুমাত্র নাস্তিক ইসলামবিরোধী ব্লগারদের বিরদ্ধে। সরকার গেল ফেঁসে। একদিকে হেফাজত জামাত শিবির আর একদিকে শাহবাগ। শাহবাগ এর ব্লগেররাও যুগ দিলো ভুলের মিছিলে। যখন সরকার তিনজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে তখন তাদের কে অন্ধ সমর্থন না দিয়ে বলা উছিত ছিল যে প্রমানিত হলে তাদের শাস্তির ব্যপারে গনজাগণ মঞ্চের কিছু বলার নেই। কিন্তু তারা তা না করে প্রতিবাদ জানাল যা শুধু দেশের মধ্যে বিভাজন বাড়াতেই সাহায্য করলো। এর মধ্যে জামাত শিবির এর লোকজনরা সাইদিকে চাঁদে দেখানোর ব্যাবস্থা করে ফেললো। তো যাই হোক বাংলাদেশ এর মানুষজন আস্তে আস্তে পুরোপুরি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেল। তবে দুঃখের বিষয় ভাগটা হল জামাত শিবির এর ইচ্ছে মতো আস্তিক আর নাস্তিক এর ভাগ। যেমনটি তারা চেয়েছিল। তাদের পাতা ফাদে পা দিল আওয়ামিলিগ, শাহবাগ এবং হেফাজত। সবচেয়ে দুঃখ ছিল হেফাজত এর কপালে। তারা যদি এই নাস্তিক ব্লগারদের বিচার চাইত তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের না করে ঢালাওভাবে সব ব্লগারদের বিচার চাওয়ার দরকার ছিল না। এর মধ্যে প্যাচ আর ঘোলাটে করতে তারা নিয়ে আসে তের দফার দাবি। দাবি গুলো সঠিক না বেঠিক তা নিয়ে কথা বলবনা। শুধু একটি প্রশ্নই করবো তেরো দফা কি তখনই উপস্থাপন করতে হতো?
যাই হোক এর পর আসলো ৫ই মে। হেফাজতের সমাবেশ ওইদিন ঠিক কতজন মারা গেছে তার কোন সঠিক হিসেব হেফাজত দিতে পারেনি। প্রথমে হাজার হাজার বললেও তার কোন তথ্য প্রমান তারা দিতে পারেনি। অধিকার নামের সংস্থাটির প্রতিবেদনে ৬১ জন এর কথা বলা হলেও প্রতিবেদন টি তে অনেক ভুল ও মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হয় যা কয়েকটি বেসরকারি মিডিয়ার প্রতিবেদন এ উঠে এসেছে।
যাইহোক কথা হচ্ছে এই স্বাধীন বাংলার মাটিতে একটি প্রানই বা কেন যাবে। মানুষের জীবনের দাম কি এতই কম?
অন্যদিকে বিএনপি যখন আন্দোলন জমাতে পারছিলনা তখন ই হেফাজত মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। আর তাই বিএনপির নেত্রী এদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন ও ঢাকাবাসীকে আহবান করলেন খাবার ও পানি দিয়ে এদের সাহায্য করার জন্য। আশা ছিল মনে যে না সরকার এরা ফেলে দিতেও পারে। আশেপাশে থাকা দরকার।
ভুল প্রমানিত হল বেগম খালেদা জিয়ার আশা। আওয়ামীলীগ অই রাত্রিতে আন্দোলন দমনে চরম মুন্সিয়ানার পরিচয় দিলো।
৫ই মের পর থেমে থাকলো না জামাত শিবির চক্র ছড়াতে লাগল মৃতের সংখ্যা নিয়ে গুজব।
এর পরের কাহিনী সবারই জানা। আস্তে আস্তে মুখ থুবরে পরে শাহবাগ। দুঃখের বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর টানা হেঁচড়ার মধ্যে পরে অপমৃত্যু হল সম্ভাবনাময় এক চত্বরের। যে যুদ্ধ ও ছিল অন্যায় ও ন্যায়ের মধ্যে তাকে বেধে ফেলা হল ধরমের বেড়াজালে। হয়ে উঠল আস্তিক আর নাস্তিক এর যুদ্ধে। যেই যুদ্ধে জিতে না শাহবাগ কিংবা হেফাজত কিন্তু মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছে অনেকগুলি তাজাপ্রান।যার দায় বর্তায় সরকার বিরোধীদল দুদলের উপরেই। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদউর রাহমান ও দায়ি এই রক্তপাতের জন্য। আপনারা হয়ত অনেকেই বলবেন যে উনি সত্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু আমি ভুলি নি আপনার পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিলো কাবা শরিফ এর সামনে গিলাফ পরিবর্তনরত আলেমদের নিয়ে মিথ্যা সংবাদ। আমার ধর্ম নিয়ে খেলা করেছ তুমি মাহমুদউর। এই তোমার মতো নরপিশাচদের জন্য আমার বাংলা আজও রক্তে রঙ্গিন। গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তুমি আমার প্রিয় কোরআন নিয়ে নাটক করো তুমি আর যাই হোক মানুষ নয়।
ভুল ছিল আওয়ামীলীগ এর ও। তাদের উচিত হয়নি রাজিব কে শহীদ বানিয়ে ফেলা। কিন্তু বাংলাদেশ এর রাজনীতিতে যে ভুল শিকার কে অপনীতি হিসেবে দেখা হয়।
আমি বিশ্বাস করিনা আওয়ামীলীগ ইসলামের বিপক্ষের দল। তাদের উচিত ছিল ইসলামবিরোধী ব্লগারদের সঠিক প্রমান সাপেক্ষে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। যে সব ব্লগার ভাই এর বাক স্বাধীনতার কথা বলবেন তাদের কে বলি ভাই আপনি নাস্তিক আমাদের কোন সমস্যা নাই তবে আপনি আমাদের ইসলাম আর নবী নিয়ে কথা বলবেন আমরা মেনে নিব না। প্রতিবাদ জানাব আদালতে যাব বিচার চাইব।
আওয়ামীলীগ এর উচিত ছিল আন্তর্জাতিক ট্রাইবনাল কে আরও স্বচ্ছ করা। তবে যতটুকু হয়েছে তার জন্য তাদেরকে সাধুবাদ। এর মধ্যেই কাদের মুল্লার ফাশি কার্যকর করা হয়েছে। তবে ইদানিং মনে হচ্ছে বিচারের ব্যাপারে সরকার এর খুব একটা আগ্রহ নেই। শেখ হাসিনা মনে রাখবেন আপনাদের আবারও মেনে নিয়েছে জনগন। এমনি এমনি না যদি বিচার করতে ব্যর্থ হন বাংলার মানুষ ক্ষমা করবেনা আপনাদের।ছাত্রলীগের লাগাম সামলান। শামিম ওসমান এর গতি করেন। এত দলকানা হবেন না। গায়ের জোরে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।
হেফাজতে ইসলাম এর জন্য দুঃখ হয়। তাদেরকে রাজনৈতিক বলির পাঠা বানানো হয়েছে। তাদের কে বলব তেরো দফা দাবি যদি পূরণ করতেই চান তবে বাংলাদেশ এর মানুষকে দাওয়াত দিন। যেদিন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষ মেনে নিবে আপনাদের তেরো দফা সেদিনের অপেক্ষায় থাকুন।
আমার এই লিখা পরে আওয়ামীলীগ বিএনপি আর জামাতি ব্লগার রা অনেক চেতে যাবেন। আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনাদের কাছে। আমার বিশ্বজিত এর মতো মরার ইচ্ছে নেই। তবু পারি না নিজের ভাবনার কথা লুকিয়ে রাখতে।আমি এক সাধারন আস্তিক দেশপ্রেমিক যুবক।ক্ষমা করবেন আমায়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৪ রাত ১২:২২