দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে আলু-পটলের ব্যবসার সঙ্গে প্রকাশনা ব্যবসার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এ ধ্রুব সত্যটাই প্রতিনিয়ত প্রতীয়মান হয়, হচ্ছে। এবং এ সত্যকে সামনে নিয়ে আসতে আমাদের প্রকাশকরাই নিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে সৃজনশীল ধারার প্রকাশক। শেষ বিচারে প্রকাশনাও একটা ব্যবসা, অন্য ব্যবসার মতো এ ব্যবসাতেও মুনাফা অর্জন করার লক্ষ্য থাকে। এ লক্ষ্য থাকে বলেই, লক্ষ্য পূরণের দিকে এগিয়ে যান প্রকাশকরা। যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাঁকা পথে। কখনোবা জটিল-কুটিল পথ অবলম্বন করে।
বই কারা লেখেন?
নিঃসন্দেহে জ্ঞানী মানুষেরা।
বই কারা প্রকাশ করেন?
যিনি লেখেন তার চেয়ে বেশি বা সমপর্যায়ের জ্ঞানের মানুষ। যেহেতু যাচাই-বাছাইয়ের একটা ব্যাপার থাকে। কেউ একজন মনের মাধুরী মিশিয়ে বা না মিশিয়ে কিছু একটা লিখে আনলেন আর প্রকাশক তা ছেপে দিলেন বিষয়টা নিশ্চয়ই এমন না। যেহেতু একজন প্রকাশককে জানতে হয় তিনি কী বই প্রকাশ করছেন, কেন করছেন। এই বই কারা পড়বে, এটা দিয়ে ভবিষ্যতে কী হবে...। তাকে হতে হয় চৌকষ। প্রায় সবকিছুতে অল্পবিস্তর জ্ঞান রাখতে হয়। প্রকাশকের ভূমিকা এখানেই মুখ্য। কারণ চাইলেই যে কেউ বই প্রকাশ করে ফেলতে পারেন না। এর ভিতর-বাইরে অনেক ব্যাপার থাকে।
এ কঠিন কাজটাই একজন প্রকাশন সম্পন্ন করেন।
কিন্তু চোখ-কান খোলা রেখে, এ বিষয়ে একটু ভাবলে আমাদের হতাশ হতে হবে। কারণ এখন (এখন বলি কেন, এ ধারা বোধহয় আশির দশকেই জোরালোভাবে শুরু হয়েছে) যে কেউ বই লিখতে পারেন, যে কেউ ছাপতে পারেন। কোনো বাধা কিংবা নিয়মকানুনের বালাই নেই। বই লিখতে বা ছাপাতে ‘জ্ঞানী’ হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ হয়তো দুই চারটি লাইন লিখতে শিখেছে, নিজের চেনাজানা পরিমণ্ডলে এই ‘অনন্য কীর্তি’ দেখিয়ে বাহ্বাও পাচ্ছে। বাহ্বার পরিমাণ আরো বাড়াতে, এ সময় তার মনে জেগে ওঠে স্বপ্নচারা-বই!
বই করতে হবে। বইয়ের জনক না হলে প্রেস্টিজ বাড়বে না!
সমস্যা কী, মুদ্রণশিল্পে আমাদের দেশ এতো বেশি এগিয়েছে যে কেউ মফস্বলে থেকেও নিজের লেখা বই নিজেই ছেপে ফেলতে পারে। যদি খরচ করার টাকা থাকে। এর বাইরে যারা নিজেরা করবেন না, প্রকাশক দিয়ে করাবেন তাদেরও চিন্তার কোনো কারণ নেই। চাইলেই হয়ে যাবে। প্রকাশক এ জন্য দরকার, বইয়ের প্রচারের একটা ব্যাপার আছে, বাজারজাতও বড় বিষয়। কারো মনে যখন প্রচার, বাজারজাতের চিন্তা উদয় হবে তখন অবশ্যম্ভাবী তাকে প্রকাশকের দ্বারস্থ হতেই হবে। আর প্রকাশক মহোদয়রা তো এরকম ‘পার্টি’র আশায় থাকেনই। বলা যায়, বসেই থাকেন। ‘পার্টি’রা ‘মাল’ নিয়ে আসবে, সে ‘মাল’ হাতে পেলে তারা শুরু করবেন ব্যবসাযজ্ঞ। ভালো মাল বা খারাপ মাল বলে কথা না, ব্যবসাটাই বড়। টাকাটাই বড়। আর ব্যবসা করতে এসে এতো ভালো-খারাপ ভাবলে চলেও না। আর কে না জানে, খারাপ মালেই লাভ বেশি!
যার যা খুশি লিখছেন, আরেক পক্ষ নগদ অর্থপ্রাপ্তির বিনিময়ে তা প্রকাশ করছেন। তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ পাঠক এখানে গৌণ। পাবলিককে যা ‘খাওয়ানো’ হবে, তা-ই খাবে! এক-আধটু লিখতে-পড়তে জানলে আর পকেটে লক্ষ্মী দেবীর আনাগোনা থাকলে, ইচ্ছা করলেই লেখক হওয়া যায়। লেখক হওয়া কঠিন কোনো বিষয় নয়। কোনো লেখা যখন ছাপা হয়ে যায় অর্থাৎ কলমের বা কম্পিউটার কম্পোজের গণ্ডি ছাড়ায় তখন সেটা হয়ে যায় ‘অসাধারণ’। যা কিছু মুদ্রিত, তাই মানসম্পন্ন!
ভালোমন্দ মিলিয়েই সবকিছু। যারা লেখেন প্রায় সবারই দৃঢ় ইচ্ছা থাকে, ভালো কিছু সৃষ্টি করার। এ সৃষ্টির পথে সফল হন গুটিকয়েক মানুষ, অন্যরা কোনো রকমে থাকার মতোই থাকেন। নতুন নতুন লেখার মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। লেখালেখি একটা শ্রমসাধ্য কাজ। খুব কম সংখ্যক মানুষই পারেন, এই কঠিন শ্রমে নিজেকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখতে। নাম কামানো কিংবা হুজুগের বশবর্তী হয়ে নয়, শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টি করতে। অবশ্য প্রতিভাও একটা বিষয়। কারো প্রতিভা নেই কিন্তু চেষ্টা করেই যাচ্ছেন-করেই যাচ্ছেন এ-ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকে। আসলেই কতদূর যাবেন তিনি, কতদূর যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব?
সহজেই কাউকে ভালো বা খারাপ লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। কারণ ভালো খারাপ নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট কোনো মানদন্ড নেই। একজনের কাছে যা খারাপ, আরেকজনের কাছে তা-ই ভালো। আবার আরেকজনের কাছে যা খারাপ অন্যজনের কাছে সেটাই উপাদেয়! সুতরাং লেখকদের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন বা বিতর্কের অবকাশ নেই। তবু এসবের ভিতর থেকেই কেউ কেউ উৎরে যান। কোনো কোনো লেখক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পাঠকের, বোদ্ধাজনের।
উভয় পক্ষের লেখকদের জন্যই প্রকাশক বড় একটা বিষয়। লেখকবিমুখ প্রকাশক বলে একটা কথা বাজারে চালু আছে। লেখক সহজে প্রকাশকের কাছে ‘পাত্তা’ পান না। পাত্তি দিয়েই পাত্তা পেতে হয়। হাতেগোনা কিছু লেখক ছাড়া, যারা কিনা বাজার কাটতি লেখক, নবীন বা প্রবীণ লেখকেরা বরাবরই প্রকাশকের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হন। থাক না সে লেখকের অসামান্য প্রতিভা, কিছু যায় আসে না। পাঠক আছে কি না সেটাই মুখ্য বিবেচ্য। এ যেন ‘ডিম আগে নাকি মুরগি আগে’ ধাঁধার আসর! তাই বলে আগ্রহীদের কাজ আটকায় না। ‘উপায়’ একটা ঠিকই হয়ে যায়। প্রকাশক নানা কিসিমের ধুয়ো তুলে লেখকের কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করে ছাড়েন। ইদানীং শুরু হয়েছে নতুন কৌশল। বই প্রকাশের শর্ত হিসেবে লেখককে ১০০ থেকে ৩০০ কপি বই কিনতে হয়। ব্যাস, মাছের তেলে মাছ ভাজা। কখনো-সখনো মাছের উদ্বৃত্ত তেলটুকু ভবিষ্যতে ‘রান্নার’ জন্য মজুদ থাকে! বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ প্রাপ্তির যোগ্যতা হিসেবে মোট প্রকাশনা এবং বার্ষিক নির্দিষ্ট প্রকাশনার সংখ্যা দেখাতে হয়। এ ক্ষেত্রে বই ছেপে দেওয়া প্রকাশকের কাজে আসে। আঙুলগোনা গুটিকতক প্রকাশক ব্যতিরেকে অন্যরা বাণিজ্যপথের যাত্রী। ব্যবসাই থাকে একমাত্র লক্ষ্য। টাকার বিনিময়ে যাচ্ছেতাই প্রকাশ করে যাচ্ছেন তারা। ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না, বইটি আসলে ‘বই’ হয়ে উঠেছে কি না। কোনো সুস্থ, শিক্ষিতজন এটা হাতে নিতে পারবেন কি না। ব্যবসার কাছে দায়বদ্ধতার কোনো স্থান নেই। জানি না, কালের বিচারে এসব বই ও প্রকাশকের স্থান কোথায় হবে।
এ মানের প্রকাশকেরা পাণ্ডুলিপি পড়ারও প্রয়োজন বোধ করেন না। মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহার মতো প্রকাশক এখন কোথায়? সেই প্রকাশকও নেই, সম্পাদনা পর্ষদও নেই। হালের অনেক প্রকাশকের পাণ্ডুলিপি সম্পাদক, সম্পাদনা পরিষদ সম্পর্কে ধারণা আছে কি না সন্দেহ। পাণ্ডুলিপি পড়ার চেয়ে টাকা গোনার দিকেই ঝোঁক বেশি-এমন প্রকাশকও নেহাত কম নয়। প্রকাশনা সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে এ শিল্পের অনেককিছুই আমার জানা। কিছু-খুঁটিনাটি বিষয়ও। এমনও প্রকাশক দেখেছি যিনি প্রিন্টার্স লাইন তৈরি করার সময় প্রশ্ন করেন, প্রকাশক বানান কী-তালব্য শ নাকি মূর্ধন্য ষ? তখন টাস্কি খেতে হয় বৈকি!
সব সীমাবদ্ধতা, হয়রানি মাথায় নিয়েই উদ্যমী লেখক সামনে এগিয়ে যান, এগিয়ে যাওয়ায় চেষ্টা করেন। তবু বাণিজ্যিক ধারার প্রকাশকের কাছে তাকে নতজানু থাকতে হয়। লেখক বইয়ের যে নামকরণ করেন, সেই নামও অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশক বাতিল করে দেন। ‘টাচি’ নাম চাই; যাতে পাঠক ‘খায়’। লেখক তৈরি এবং যথার্থ পাঠক তৈরির উদ্যোগ কোনো প্রকাশকেরই নেই। তিনি যে মানের প্রকাশকই হোন না কেন। কেউ কেউ এসেই পুঁজির দাপটে হইচই রইরই বাঁধিয়ে দেন। ঢাউস, মোটা-তাজা বই হয়, ব্যবসা হয়, প্রকৃত কাজটা হয় না মোটেও।
প্রকাশকদের কাছে একটা শ্রেণী গুরুত্ব পান। অবশ্য এই গুরুত্বটুকুও কিনে নিতে হয়। ট্যাঁকে মালকড়ি থাকলে যে কেউই পারে। তথাকথিত জনপ্রিয় ধারার লেখকদের ‘হিট’ ঘটনার একটা কথা বলে ইতি টানবো। প্রকাশক কিংবা লেখক পত্রিকায় সে জমকালো বিজ্ঞাপন দেন, অমুক বইয়ের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শেষ! এখানে সহজেই ধরে নেওয়া হয়, প্রতি মুদ্রণ এক শ বা তার চেয়ে কম কপি! বই ছাপা হয় একবারই, শুধু ইনারটা, যেখানে বইয়ের নাম, লেখক, প্রিন্টার্স লাইন ছাপা হয় সেটার আলাদা প্লেট করা হয়। প্রতিটি ‘মুদ্রণের’ জন্য একটা প্লেট! ব্যস, তারপরই শুরু হয় বিজ্ঞাপনের বাগাড়ম্বর! জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন রকম পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে বিজ্ঞাপনভাষ্য, অমুক লেখকের অমুক বইয়ের প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় মুদ্রণ শেষ-মাত্র তিনদিনে! কোনো কোনো (কু)বুদ্ধিসম্পন্ন প্রকাশক প্রথমবারের মতো প্রকাশিত বইয়ের প্রিন্টার্সে লেখেন, দ্বিতীয় মুদ্রণ : অমুক মাস, অমুক সাল। যদিও প্রথম মুদ্রণটাই বাজারে আসেনি! এতে করে পাঠকের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে সহজ হয়। কারণ হুজুগে পাঠক সহজেই বুঝে নিতে বাধ্য হবেন, যেহেতু প্রথম মুদ্রণ শেষ, আবার ছাপতে হয়েছে না জানি কত্ত ভালো বই! বই ভালো না হলে তো দ্বিতীয় মুদ্রণ পর্যন্ত গড়ায় না!
প্রতি বছরই ছাপা হচ্ছে অসংখ্য বই। একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয় মোটামুটি পঞ্চাশ থেকে সত্তর হাজার নতুন বই। এ সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। সে হারে পাঠক বাড়ছে না। পাঠকের এখন ব্যস্ত হওয়ার, বিনোদন উপকরণের কমতি নেই। তারপরও কিছু পাঠক ঠিকই আছেন, যারা গড্ডালিকাপ্রবাহে ভেসে যাননি। এখনো বইয়ের পাতায় খুঁজে নেন যাপিতজীবনের কাঙিক্ষত-অনাকাঙিক্ষত ছবি। গভীর জীবনবোধ।
প্রকাশকদের গালমন্দ কিংবা রুচিশীল হওয়ার অনুরোধ করেও আসলে তেমন একটা লাভ নেই। কারণ বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প আসলে এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। যে কোনো বই ছাপার সংখ্যা এখন শ’য়েই সীমাবদ্ধ। গুটিকয়েক ব্যতিক্রম। যাদের বই হাজার কপি বিক্রি হয়। নবীন কোনো লেখকের তিনশ কপি বই বিক্রি মানে ‘বেস্ট সেলার’-এর মর্যাদা পাওয়া। পনেরো কোটি জনসংখ্যার এই দেশে একজন লেখকের তিনশ কপি বই বিক্রি হয় না, ভাবতেই বা কেমন লাগে! আবার এটাও নির্মম সত্য, এমনও লেখক আছে পুরো বইমেলায় যার এক কপি বইও বিক্রি হয় না! এ জন্য লেখক দায়ী, না প্রকাশক দায়ী-এ বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, মূলত দারিদ্রতাই দায়ী। বেশির ভাগ মানুষের এখনো বই কেনা বিলাসিতার মধ্যেই পড়ে। আগে তো মৌলিক চাহিদা পূরণ, তারপর বই।
বাণিজ্যিক লাভালাভের কথা চিন্তা করেই প্রকাশকরা উল্টাপথে হাঁটছেন। তাই বলে এতোটা উল্টাপথ কারোই কাম্য নয়। একটা বইয়ের বানানের ঠিক নাই, বাক্যের ঠিক নাই, নামকরণে ভুল, সেটিং-মেকআপে সমস্যা আরো কত কী...। টাকা পেলাম আর অমনিই যেনতেনভাবে বই ছেপে দিলাম এটা নিশ্চয়ই একজন সৎ, বিবেকবান প্রকাশকের কাজ হতে পারে না। এ লাগামছাড়া হালের জন্য আমাদের, ভাষা ও সাহিত্যের যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে, হবে; তাতে কারো মাথাব্যথা নেই। বোধোদয় হবে বলেও মনে হয় না।