somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেটামরফোসিস: ফিনিক্স

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গল্পটা আমার না, আমার বন্ধুর...

খুব ঠান্ডা মাথার লজিক্যাল সুবোধ ছেলেটা বিরাট বিরাট ক্যালকুলেশন করে প্রেমে পড়লো এক ভুল মেয়ের। ফলাফল, দুই বছর পার হতে না হতেই বাস্তবতার হাতে গালের উপর বিরাশি শিক্কার এক চড়। ঘটনার শুরু এখান থেকেই...

"মন বেশি খারাপ?" সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করে বন্ধুদের একজন.. সুবোধ ছেলেটা উত্তর দেয়না... বটতলায় আসলে আগের মতো লাগে না আর... সব কেমন যেন বদলে গেছে.. কিন্তু এই জায়গারটার প্রতিটা ইঞ্চিতে কত কত স্মৃতি..

ভার্সিটি জীবনে ক্লাসে যতো না সময় কেটেছে, তার চেয়ে হাজার গুন বেশি কেটেছে এই বটতলায়... মেসে থাকার সুবাদে এই শেষ তিন বছরে ওর গৃহী জীবনের অভিজ্ঞতাও প্রায় শূণ্যের কোঠায়.. তাই শেষ পর্যন্ত বটতলাতেই সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাত দুনিয়া উদ্ধার শেষ, শুধু ঘুমটাই মেসের শক্ত বিছানায়...

প্রথম দিন ক্যাম্পাস ঘুরতে এসে এই একটা জায়গাই নাকি পছন্দ হয়েছিল ওর... অবশ্য আমারো তাই.. পড়ুয়া গুড বয় আর গার্লরা ক্লাসের শেষে লাইব্রেরী আর রিডিং রুমে যেত, আর বাকি সব পাস ফেলের টানা হেচড়ায় ছেঁড়া ফাটা আড্ডাবাজ গুলো একসাথে হত বটতলার চায়ের দোকান গুলোয়.. এই দোকান গুলোর কোন একটার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই আমাদের কয়েকজনের পরিচয়... তখনো জানতাম না, কতোটা বিশাল পথ আমরা একসাথে পার করবো...

আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠান হলো খুব ফর্মাল ভাবে.. বিরাট বিরাট লোকজনের ভারী ভারী কথা গুলো কোনরকমে বটতলা পর্যন্ত বয়ে এনে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম.. ভাবছি চা খেয়ে ঘুমটা কাটাবো, এমন সময় জলদগম্ভীর এক গলার আওয়াজ, 'এইযে, স্ট্রাইপ শার্ট!' ফিরে তাকিয়ে দেখি সুবোধ ছেলেটার দিকে চোখ এক টকটকে ফর্সা বড় ভাইয়ের... চকচকে এক বাইকের উপর জাঁকিয়ে বসে ছিলেন আর বিশাল এক জটলা তাকে ঘিরে, আড্ডার মধ্যমণি যে তিনিই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে.. বোঝা যাচ্ছে ডাক দেয়ার কারণটাও... সুবোধটাকে যেতে মানা করবো ভাবতে ভাবতেই উনি হাতের ফাইলটা আরেক জনের হাতে দিয়ে বল্লেন, 'যাই, একটু র‍্যাগ খাইয়া আসি!!'... গিয়ে কি বল্ল কে জানে, এরপর দেখি কয়েকজন এসে আমাদের সবাইকে একসাথে ধরে নিয়ে জটলার মাঝে ভরে নিল... দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ভাবলাম, শখ হয়েছে যখন একাই খা, আমাদের টানাটানির দরকার কি!!.. ব্যাটা সুবোধের এক দিন কি আমার একদিন!!.. যাই হোক, এরপর ম্যালা কাহিনী... এক সুন্দরী বড় আপু দয়া পরবশ হয়ে উদ্ধার না করলে কাহিনী আরো বড় হতো... সেটাও অবশ্য সুবোধের ই কল্যাণে, উনার ভাবুক চাউনী আর নাদান চেহারা দেখে সব সময়ই বড় আপুদের মনে মাতৃত্ব অথবা বড় বোন ভাব জাগ্রত হতো.. এর প্রমাণ আমরা পরেও পেয়েছি..

সেদিন র‍্যাগ দেয়ার পরই ভাইয়ারা আমাদের চা, কোক আর ক্ষেত্রবিশেষে সিগারেট খাইয়ে, তাদের আদরের ছোট ভাই হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন... যার মাশুল তারা আজো দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোন ভাবেই তাদের আদরের কমতি হচ্ছে না.. পরিবার পরিজন ছেড়ে মন ভার করা আমরা এক এক ক্যাম্পাস ভর্তি বড় ভাই আর বোন পেয়ে ঘর ছাড়ার দু:খ অনেকটাই ভুলে গেলাম.. দিনে দিনে ক্যাম্পাসটা হয়ে গেলো আমাদের বাসা আর বটতলা হয়ে গেলো আমাদের বিশাল বাসাটার লিভিং রুম..

'অই, কি জিগাইলাম তরে!!.. কথা কস না ক্যান?!'.. বন্ধু এবার কনুই দিয়ে পাঁজরে খোঁচা দেয়... সুবোধ ছেলেটা নিচু গলায় বলে, 'জালাইস না তো, ভালো লাগে না...'

বেলা অনেক গড়িয়েছে, পেট খালি এখনো, কিন্তু খিদেটা আজো নেই... বন্ধুটাকে কিছু না বলেই উঠে পড়লো ছেলেটা.. পুরোন ডিডিসি বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে এগোনোর সময় দেখলো জুনিয়রদের একটা গ্রুপ আড্ডা জমিয়েছে ছড়ানো সিঁড়িটাতে... কতোদিন হয়ে গেছে, এই সিঁড়িতে মেসের বন্ধুদের সাথে গভীর রাতের গানের আসরে বসে না ও... সুর, তাল, লয় আর গানের গলা একেকজনের একেক দিকে কামানের গোলার মত ছুটতো... কিন্তু তাতে কারোর ই কোন সমস্যা থাকতো না... রাত বাড়তো, গানের গলা হেড়ে থেকে ফাটা বাশের মত হতে থাকতো, সিড়ির গোড়ায় খালি চায়ের কাপের স্তুপ আর তার ভেতর সিগারেটের গোড়ার সংখ্যা বাড়তে থাকতো... সেই রাতকে ভোর করে দিয়ে, বটতলার আল আমিনের দোকানের প্রথম ব্যাচের পরোটা আর আগুন গরম ডাল ভাজিতে নাস্তা সেরে এরপর সারাদিন ক্লাসে বসে ঝিমানো... এমন দিন আর রাত কাটানো কি শেষ হয়ে গেলো?...

বটতলার পার হয়ে একটু সামনে যেতেই লায়নটা দৌড়ে এসে সুবোধ ছেলেটার হাটু জড়িয়ে ধরল... পিচ্চিটা এমনিতেই সাইজে ছোট আর সুবোধটা আবার ঢ্যাংঢ্যাংগা লম্বা, তো হাটুই ভরসা লায়নের জন্য.. সিংগারা, সমুচা আর পুরির দোকানের দুইটা পিচ্চি কর্মচারী.. বেশি পিচ্চিটা লায়ন, কম পিচ্চিটা টাইগার.. আমাদেরই দেয়া আদরের নাম.. সামনে পড়লে পিচ্চি দুটোর হাতে ৫/১০ টাকা দেয়া সুবোধের অভ্যাস.. আজকেও মলিন একটু হেসে পকেট থেকে খুচরো টাকা বের করতেই পিচ্চি বলে, 'মামা, তোমার কি মন খারাপ না শরীর খারাপ?''.. সুবোধ ওকেও জবাব দেয়না, আবার একটু হেসে ৫ টাকার নোটটা বাড়িয়ে ধরে.. 'থাক, আজকে লাগবো না মামা, মন ভালো হইলে দিও', বলেই পিচ্চি দৌড় দিলো দোকানের দিকে...

সূর্যের আলোটা কি একটু বেড়ে গেলো নাকি?...কোন ফটো এডিটিং এ্যাপ দিয়ে কেউ যেন ব্রাইটনেসটা বাড়িয়ে দিলো সুবোধ ছেলেটার চোখের সামনের সব কিছুর.. আগের চেয়ে একটু উজ্জ্বল লাগলো আশে পাশের সব..

ওর মন খারাপের ব্যাপারটা সবাই ধরে ফেলছে কিভাবে?.. যেই স্যার তার মেজাজের জন্য আগে থেকেই বিখ্যাত, সেই স্যার একদিন ডেকে বলে দিয়েছেন... 'তোমাকে তো এইভাবে মানাচ্ছে না'.. যদিও এই কথার আগে পরে স্বভাবসুলভ ঝাড়ি ছিলই.. আবার আরেকজন রাশভারী ম্যাডাম, যার কাছে ব্যাক্তিগত তো দূরের কথা লেকচার বিষয়ক কোন সমস্যার কথাও বলতে যাওয়ার সাহস হয়নি কখনো, সেই তিনিও একদিন রুমে ডেকে নিয়ে বল্লেন, 'যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে, বুঝেছ?... দুই রাকাত নফল নামায পড়ে ফেল'..

প্রতিদিনই এমন দুই একটা ছোট খাটো ঘটনা, অল্প একটু কথা, ওকে দিনটা পার করার শক্তি যোগায়... ভাবতে ভাবতে মনটা বেশ হালকা লাগল.. বটতলায় ফিরে যাবে চিন্তা করলো, এতোক্ষণ 'কি হইসে, কি হইসে' জিজ্ঞেস করা বন্ধুটাকে নিয়ে একসাথে নাশতা করবে.. বেচারা কতবার জিজ্ঞেস করলো অথচ একবার উত্তরও দেয়নি ও, ভেবে খারাপই লাগছে এখন..

পরোটা ভাজির দোকানটা পার হওয়ার সময় গরম পরোটার গন্ধটা নাকে যেতেই পেট মোচড় দিয়ে উঠলো.. নাহ, আজকে আল আমিনের স্পেশাল লটপটি দিয়ে গোটা দশেক পরোটা না মারলে চলবে না..

জামাল মামার চায়ের দোকানের বেঞ্চটাতেই বন্ধু সিগারেট ফুকে যাচ্ছে, সাথে আরো জনা পাচেক আমাদের সকল ক্রাইমের অবধারিত পার্টনার... কাছাকাছি হতেই সিগারেটওয়ালাটা ঠোটে মিচকা শয়তান মার্কা হাসি দিয়ে ওকে দেখিয়ে সবাইকে বলে উঠলো, 'ওই জানোস, এই শালা ছ্যাক খাইয়া মুণী ঋষী হইয়া গেসে!!.. মৌন ব্রত অবলম্বন করতাসে আর বটতলায় বেঞ্চে বইসা ঝিমাইতাসে ...!!' খ্যাক খ্যাক শব্দে পিত্তি জালানো হাসির রোল উঠলো একটা... একজন বিরাট আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করলো, ' মামা, তুই এখন কোন স্টেজ এ আসোস?... কাচা না সিদ্ধ??'... বিজ্ঞ আরেকজন উত্তর দিল, ' আধা সিদ্ধ, তাই কথা কওয়া বন্ধ করসে, সিদ্ধ হইয়া গেলে প্যান্ট খুইলা মাথায় বাইন্ধা রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করা শুরু করব'... আবার খ্যাক খ্যাক হাসি...

'আল্লাহ যেন তোদের মতো বন্ধু আমার শত্রুরেও না দেয়...' খুব হালকা লাগতে থাকে মনটা.. অনেক ভারী একটা কিছু বুকের ওপর থেকে উবে গেলো যেন... 'তোরা মানুষ ই না, সব শালা রাজনীতিবীদ!!' 'পিপ পিপ পিপ'... জবাবে আরো, 'পিপ পিপ পিপ!!'...

বটতলাটাকে সুবোধের আবার আগের মতো লাগতে থাকে... কি শান্তি... কি শান্তি...



বি. দ্র. : উপরের সকল ঘটনা, চরিত্র ও পটভূমি সত্য... শুধু প্রথম লাইনটা মিথ্যা...

মেটামরফোসিসঃ শুরুর কথা
মেটামরফসিসঃ যখন ভদ্রলোক ছিলাম
মেটামরফসিসঃ তখনও ভদ্রলোক ছিলাম
মেটামরফোসিসঃ যখন আমার স্কুলে পা ও মাথায় হাত
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৫৮
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×