আমার ফেসবুক পেইজ ওয়ান মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার ক্রস করেছে। কেকটেক কাটার প্রোপোজাল ছিলো.... ভিডিওতে ক্লিক পড়তেই এই কথা দিয়ে শুরু হলো। কেন বা কিভাবে ক্লিক করেছি জানি না। সোজা সাপ্টা উত্তর উনার নাম খেয়াল করলে কখনোই ভিডিওতে ক্লিক করতাম না।
চারিদিকে মোটিভেশনাল স্পীকারদের জয়জয়াকার। মানুষকে মূলত নিজের উন্নয়নের জন্য মোটিভেট করাই তাদের কাজ। দেশে যেমন তেমন, বিদেশেতো এর ছড়াছড়ি!
একটা সময় আমি খুব শুনতাম এনাদের কথা। শুনলেই খুব চার্জডআপ মনে হতো নিজেকে। মনে হতো এক্ষুনি কাজ কাম করে ফাটিয়ে ফেলবো। তাদের কথা শুনে উপকার হয়নি এমন বললে ডাহা মিথ্যা কথা বলা হবে। তবে এখন আর শুনি না! কেন? কারণ এনাদের কথা আপনাকে আপাতদৃষ্টিতে সেই মাপের চার্জডআপ করলেও দিনে দিনে আপনাকে হীনমন্যতার মধ্যে ডুবিয়ে দেয়।
প্রায় ৯৯.৯৯% মোটিভেশনাল স্পীকারদের মুখের কথা হচ্ছে, আমি, আমি, আমি, আমি, আমি আর আমি, আমি, আর তিনি, তিনারা......!
যে কোন মোটিভেশনাল স্পীকার তার মোটিভেশনের ক্যারিয়ারের প্রথমে গল্প বলে বেড়ান অমুক, তমুক ইত্যাদি লোকের। এরপর এক সময় উনাদের মুখে 'আমি'র জোয়ার চলে। আমার কি আছে, আমি কি করে ফেলেছি, আমাকে কে কি বলেছে, আমার এই হয়েছে, আমার ঐ হয়েছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি এবং আমি!
আমার ফেসবুক পেইজ ওয়ান মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার ক্রস করেছে। কেকটেক কাটার প্রোপোজাল ছিলো.... ভিডিওতে ক্লিক পড়তেই এই কথা দিয়ে শুরু হলো। কেন বা কিভাবে ক্লিক করেছি জানি না। সোজা সাপ্টা উত্তর উনার নাম খেয়াল করলে কখনোই ভিডিওতে ক্লিক করতাম না। কারণ আমি এই লোককে খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলি। ফার্ষ্ট ইপ্রেশনটাই উনার সাথে আমার খারাপ ছিলো।
যাই হোক, উনার বিষয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য ফুল মোটিভেশন বিজনেস ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে নিজের কয়েকটা কথা বলা।
প্রত্যেক মোটিভেশনাল স্পীকারদের কাজই হচ্ছে নিজে কি কি অর্জন করেছে সেটা খুব ভালো মত জাহির করা; তাদের সেটা করার যোগ্যতা অবশ্যই আছে; তবে অর্জন করার চাইতে অর্জন বলে বেড়ানোর যোগ্যতা অবশ্যই তাদের বেশী। এটাও একটা যোগ্যতা।
এবং তারা এই যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েই মূলত ভাও বেঁচে বেড়ান।
এর সাথে সাথে তারা যোগ করেন পৃথীবির বুকে নামীদামী মানুষেরা কি করেছে। তারা কিভাবে করেছে। তারা কত টাকা কামিয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবার কথা হচ্ছে তারা পেরেছে, তুমিও পারবে; ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা.......
এগুলি আপাতদৃষ্টিতে আপনার খুব ভালো লাগলেও মূলত এগুলির লংটার্ম ইফেক্ট বেশীরভাগ মানুষের উপরেই খারাপ। আমি নিজে আগে প্রচুর সভা-সেমিনারে ঘুরতাম। মূলত এটাই ছিলো আমার ব্যবসার মার্কেটিং এর এক ভিন্ন ধারা। সেখান থেকে ছোট ব্যবসা বা স্মল এন্টারপ্রেনরদের বহু বহু মানুষের সাথে কথা হয়েছে।
বেশীর ভাগেরই অভিজ্ঞতা খারাপ! সবারই কথা মোটিভেশনাল স্পীচ শুনলে এখন আর রক্ত গরম হয় না। বরং নিজেকে ছোট লাগে। এত এত মানুষ এত এত কিছু করে ফেলালো, আর আমি কিছু করতে পারলাম না!
আমি এখন পর্যন্ত তেমন ভাবে কোন মোটিভেশনাল স্পীকার পাই নাই, যারা মানুষকে সুখী হতে মোটিভেট করে। সকলের মোটিভেশনের মূল হচ্ছে সাকসেস নামের এক ভ্রান্ত ধারণা! যে সাকসেসকে তারা 'কতটা জনপ্রিয়', 'কত টাকা কামায়', 'কত বড় কম্পানীর সিইও', 'কত কি করে ফেলেছে' ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রাসঙ্গিক ভাবেই একটা প্রচলিত ছোট্ট গল্প বলি। এক শিক্ষক ক্লাসের সকলকে তাদের জীবনের লক্ষ্য লিখতে বলেছেন। কেউ লিখেছে ডাক্তার হতে চাই, কেউ লিখেছে ইঞ্চিনিয়ার হতে চাই, কেউ বা এ্যাস্ট্রোনাট হতে চায়! বাবু লিখেছে, 'আমি সুখী হতে চাই'। শিক্ষক এটা দেখে একগাল হেসে বললেন, 'বাবু, তুমি প্রশ্নটা বুঝনি। সুখী হওয়া জীবনের কোন লক্ষ্য না'। বাবু ধীর গলায় বলল, 'শিক্ষক, আপনি তাহলে জীবনটাই বুঝেন নি'।
ধরেন আজকে আপনাকে টাকা দেওয়া হলো, ৫কোটি কিংবা ১০কোটি। বিনিময়ে আপনি আপনার জীবনের সবাইকে হারাবেন। কারও সাথে থাকতে পারবেন না, কোন বন্ধু থাকবে না; এমনকি নিজের মত করে সময় কাটানোর সময়ও থাকবে না। গভীরে গিয়ে ভাবলে দেখবেন আপনি এই ৫কোটি কিংবা ১০কোটি টাকা চাইবেন না।
২০১৬ সালের কথা। আমার এক ভাই-বন্ধুর সাথে বসে আছি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। তার বউয়ের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, সে নাকি তাকে ভালো বাসে না! একটু দূরেই বসা এক মহিলার মাথার উকুন বাঁছছেন তার স্বামী। স্বামী রিক্সা চালক, স্ত্রী কি করেন জানি না। তারা কথা বলছেন, হাসছেন। আমার এই ভাই-বন্ধুর ৩/৪টা শোরুম, দামি বাইক, একটা বিষয়ে বেশ ভালোই খ্যাতি; সর্বোপরী তিনি ধনী। কিন্তু তার জীবনে 'সুখ' বিষয়টি নেই।
কেউ হয়ত মজা করে বলতেই পারেন, কম টাকা ওয়ালা দুঃখীর চাইতে বেশী টাকা ওয়ালা দুঃখীই তো ভালো! কিংবা সাইকেলের উপর বসে না কেঁদে বিএমডাব্লিউতে বসে কাঁদা তো বেশী ভালো। কিন্তু ওটা আসলে মজাই।
মোটিভেশনাল স্পীকাররা বেঁছে বেঁছে আপনাকে শুধু তুলনা করা শেখায়। আপনাকে তুলনা করা হয় বিল গেটস, স্টিভ জবস, ওয়াল্ট ডিজনি, ম্যাডোনা, মাইকেল জ্যাকসন, রজার ফেদারার, সাকিব আল হাসান, শচিন টেন্ডুলকার সহ বহু বহু 'সফল' মানুষের সাথে। শুধু কোন সুখী মানুষের সাথে তুলনা করা হয় না। আপনাকে বলা হয় এটা হতে, ওটা করতে, এত এত টাকা কামাতে; কিন্তু কখনও সুখি হতে বলা হয় না।
এ সব কারণেই মূলত আমি মোটিভেশনাল স্পীকারদের এড়িয়ে চলি। খুব ঘনিষ্ঠ কেউ হলে তাকে মানা করি এগুলি শুনতে। এর থেকে বরং ভালো আরও অনেক কিছু করে সময় কাটানো যায়।
ছোট বেলায় পড়া একটা ছোট গল্প ছোট করে বলে যাইঃ
রাজার ভীষণ অসুখ। রাজ বৈদ্য এসে বললো সুখি মানুষের জামা পরালেই এই রোগ সেরে যাবে। রাজ্যময় খোঁজ শুরু হলো সুখি মানুষের। প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করা হলো সে সুখি কিনা। সবারই কোন না কোন অভিযোগ আছে। অবশেষে পাওয়া গেলো এক সুখি মানুষকে। তার কোন দুঃখ নেই, কারও প্রতি কোন অভিযোগ নেই। সমস্যাটা বাধলো, তার জামাও নেই!
আমি এড়িয়ে চলি তাদের, যারা ক্ষণে ক্ষণে আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে আমার এই ছোট্ট চাকরীটা বিল গেটসের সামনে কিছু না। চাকরীতে আমার অর্জনটা স্টিভ জবসের অর্জনের কাছে কিছু না। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে বউ-সন্তান নিয়ে এক সাথে ভাত খাওয়া জ্যাক মা এর কোন ফাইভ স্টার রেষ্টুরেন্টের ডিনারের কাছে কিছু না। আমি তাদের সুকৌশলেই এড়িয়ে চলি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৩:৪৪