আমাদের বাড়ির সামনে ছোট্টো একটা মাঠ ছিলো। মাঠ ছোট হলে কি হবে, একই মাঠে এক পাশে আমরা খেলতাম স্যাডো ক্রিকেট, অন্য পাড়ার ছেলেরা খেলতো স্যাডো ক্রিকেট। আর এক পাশে এলাকার ছোট মেয়েরা খেলতো গোল্লাছুট কিংবা ডিম কুসুম কিংবা অন্য কিছু।
এলাকায় মিজান নামে একজন ছিলো; সবাই তাকে মিজান নেতা বলে ডাকতো। সব কিছুতেই তার নেতাগিরি; শুধু কাজের সময় খোঁজ থাকতো না। ভোটের সময় সে কোন দলের হয়ে কাজ করবে এটা হিসাব করে শেষ করতে করতেই ভোট পার হয়ে কেউ একজন নির্বাচিত হয়ে যেতো। তারই মেঝ ভাই মিলন, আমার ক্লাসমেট, প্রতি বছরই গোটা ৩/৪ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করতো। মোটামুটি এটা তার হেমন্ত থেকে বৃষ্টির আগ পর্যন্ত আয়-ইনকামের পথ। বৃষ্টির সময় ঐ একই মাঠে কখনও কখনও ফুটবলের টুর্নামেন্ট আয়োজন করতো সে।
মাঠের মাঝে ক্রিকেট বল প্রাক্টিসের জন্য একটি কনক্রিটের ক্রিজ তৈরী করেছিলাম আমরা।
হোক সে গ্রীষ্ম, বর্ষন, শরৎ, হেমন্ত, শীত কিংবা বসন্ত; আমাদের মাঠ খালি পড়ে থাকতো না। এমনকি পরীক্ষার সিজনেও ছেলে-মেয়েদের মাঠে যেতে না দিলে কান্নাকাটি পড়ে যেতো।
গ্রীষ্মে প্রায় প্রতিদিনই বিদ্যুৎ যেতো; লোড সেডিং। বিদ্যুৎ যাওয়া মানেই ছেলে মেয়ের আর এক দফা বাইরে বের হওয়া। এই মাঠের দক্ষিন পাশটা বেশ খোলা বলা চলে, মফস্বলে যেমন হয় আরকি। দক্ষিন খোলা, তাই ফুরফুরে বাতাস। বিদ্যুৎ চলে গেলেই যেন সবাই আনন্দ, শুধু ছোটদের নয়, বড়দেরও। আর বিদ্যুৎ চলে আসলেই যত কষ্ট।
যদ্দুর মনে পড়ে, তখন বিটিভি ছাড়া চ্যানেল ছিলো না। বড় একটা এ্যান্টেনা লাগালে ভারতের ডিডি১ চ্যানেল আসতো, তাও ঝির ঝিরে। খুব বেশী স্ক্রীণ টাইম আমরা পেতাম না।
আমাদের পুরা একটা নয়, চোখের সামনে প্রায় দেড়টা জেনারেশন এই মাঠ কেন্দ্রিক গড়ে উঠতে দেখেছি। আমাদের হাসি-দুঃখ-আনন্দ সবই ছিলো এই মাঠ কেন্দ্রিক।
ক্রিকেটের পাশাপাশি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারীর মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের সকাল বেলার ক্রেজ ছিলো ডান্ডা কুলুপ বা ডাঙ্গুলি খেলা। এর সাথে চলতো লাটিম খেলা। এই সময়টাতে স্কুল বন্ধ। আমাদের আর মাঠের থেকে ঘরে ফেরায় কে?
দুপুরে কৃষি কলেজের পুকুরে এক সাথে গোসল, কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফেরা। তিনটা বাজতেই আবার মাঠে। খুব বিরক্ত লাগতো শীতের সময় দিন ছোট হয় বলে।
বৃষ্টিতে প্রায়ই আমাদের মাঠ তলিয়ে যেতো। সেটা ছিলো আর এক আনন্দের বিষয়। কোন এক অবাক করা কারণে এলাকার প্রায় সব বয়সী ছেলে-ব্যাটা-বুড়ো এবং কিছু ছোট মেয়েরা প্যান্ট ভাজ করে কিছু দূর উঠিয়ে এই পানির ভিতরেই হেটে বেড়াতো। কাউকে কাউকে দেখা যেতো কারও পুকুর ভেসেছে খবরে জাল মারছে মাঠের মধ্যে। একটা মাছ ধরা পড়লেই সবাই হই হুল্লোড় করে দেখতে আসতো। কখনও কখনও পুকুরের মালিককেও নিজের মাছ অন্য ধরেছে দেখে আনন্দ করতে দেখতাম।
এক-দুই-তিন করে বহু বছর পেরিয়ে গেছে। আমাদের বাড়িটাও গত ৬ বছরের মাঠের অন্য পাশে চলে গেছে। ঢাকায় এবং বিদেশে থাকার ফলে মাঠের দিকে চোখ পড়েনি তেমন। এ বছরের শুরুতে দেশে গিয়েছিলাম ছুটিতে। সেই জানুয়ারী..... কিন্তু মাঠে কেউ নেই। ঘাস বড় হয়ে গেছে, এত বড় যে সেই চির চেনা কনক্রিটের ক্রিজও দেখা যায় না আর। মাঠের একপাশ দখল করে নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। এলাকার সব ময়লা এখানে ফেলা হয়।
ধীর পায়ে ক্রিজের কাছে গেলাম, ক্রিজের উপরের ময়লা বলে দেয় কেউ আর ক্রিকেট খেলে না এখানে। আশেপাশের মাঠ গুলিতে টুকটাক কিছু খেলা হলেও এখানে কিছু নেই।
যখন সংসার শুরু করেছিলাম, অনেক রঙ্গীন স্বপ্নের মধ্যে একটা ছিলো এই মাঠেই আমার ছেলে মেয়ে দৌড়াবে তাদের গুটি গুটি পায়ে। আমি মাঠের এক পাশে বসে তাদের আনন্দ দেখবো।
মাঠে আর কেউ নামে না। সবার দৃষ্টি এখন মোবাইলে। এই গেম, সেই গেম আর ভিডিও বানাতেই সবাই ব্যস্ত। এক সময় ফটোগ্রাফী করতাম, সেই সুবাদে মাঝে মধ্যে এলাকার ছোট ভাইয়েরা নক করে। জিজ্ঞাসা করে কোন রিং লাইটটা কিনলে টিকটকে ভিডিও বানাতে সুবিধা হবে। ক্যামেরা কিনবে নাকি দামী মোবাইল কিনবে।
দেশ থেকে চলে আসার আগে মাঠের দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজে উঠেছে। ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়েছে। রিক্সায় বসা স্ত্রী আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। কিছু না বলেও একটা শান্তনার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।
--------------------------
ছবিটি আমার তোলা। ২০১৩ সালে, খুব সম্ভবত কুমিল্লা, অথবা বাগেরহাটে। আমার খুব প্রিয় কিছু ছবি আছে; মাঝে মধ্যেই বের করে দেখি সেগুলি। কিন্তু তেমন করে কখনও প্রকাশ করা হয় নি। এই ছবিটি সেই প্রিয় ছবি গুলিরই একটা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ৩:৩৬