শীতের কুয়াশায় আবছা সকাল, রোদ এখনো নিস্তেজ সোনালি,বড় সুন্দর সকালটি। কফির মগ হাতে বারান্দায় দাড়িয়ে সকালটি উপভোগ করছিল আনিস, হঠাৎই শৈশবের স্তৃতি মনে পড়ে যায় আনিসের, সে ব্যথা ভুলবার চেষ্টা করে, সুন্দর শীতের বেলাটিকে দেখে।
স্কুলে পড়ার সময় বাবার উপর রাগ করে আনিস বাড়ি থেকে পালায়। পালিয়ে প্রথম চট্টগ্রাম ডক ইয়ার্ডে কিছুদিন শ্রমিকের কাজ করে, আনিসকে মোটামুটি সুদর্শনই বলা যায়,তাই বন্দরের এক সমকামী নাবিক তাকে জাহাজের খালাসীর চাকরি দেয়, প্রায় এক বছর আনিসকে সেই সমকামী নাবিকের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তারপর জাহাজ একদিন আমেরিকা ভিড়লে আনিস সুযোগ বুঝে পালায়। ফ্লোরিডার উপকূলের মৎস আড়তে আনিস কাজ নেয়,সেখানেই সহকর্মী ববের সাথে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়, বব ম্যক্সিকান ক্ষাপাটে তরুন,সবসময় ঈশ্বর নিন্দা করেে ,আনিস শুধু শুনে যায়।
প্রায় এক বছর আনিস আর বব এসাথে কাজ করার পর তারা ঠিক করল দুজনে মিলে একটা ফিশিং ট্রলার ইজারা নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাবে,নিজেদের ভাগ্যকে পরীক্ষা করবে। দুজনেরই কোন পিছুটান নেই,তাই এক বছরের জন্য একটি ফিশিং ট্রলার চুক্তি করে সমুদ্রে নেমে পড়ে।ববের ঈশ্বর নিন্দার কারনেই হয়তো ঈশ্বর তাদের একদিন দেখা দিলেন, আনিস আর ববের ছোট্ট ফিশিং ট্রলার,সেখানে কোন রেডিও লিংক নেই যে তারা সামুদ্রিক ঝড়ের পূর্ভাবাস শুনবে, হঠাৎ এক সামুদ্রিক ঝড়ে উপকূলে থাকা সবগুলো ফিশিং ট্রলারই মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্থ হলো, কিন্তু আনিস আর বব ছিল সমুদ্রে তাই কেমন করে যেন শুধুমাত্র তাদের ফিশিং ট্রলারই অক্ষত রইল,এবং বেশ কয়েক মাস তারা একচেটিয়া ব্যবসা করল। এখন ভাড়া করা ফিশিং ট্রলার ছাড়াও তাদের নিজস্ব দুটি ফিশিং ট্রলার।
ফ্লোরিডার রাস্তায় হাটতে গিয়ে হঠাৎই আনিসের স্কুল জীবনের বন্ধু পারভেজের সাথে দেখা,পারভেজই প্রথম আনিস কে চিনল, আনিস তাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। অনেক কথা বলার পর যাবার সময় পারভেজ বললো :
দেখ আনিস, তোর মন খারাপ হবে তাই প্রসঙ্গটা এতক্ষন তুলিনি,তবে যাবার আগে বলে যাই, তোর বাবার উপর আর রাগ করে থাকার কোন মানে হয় না,কারন তিনি এখন আর নেই,তোর শোকেই মনে হয় তোর মা মারা যান, আর তোর রড় ভাইও সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে।
আনিস বললো ,তবে কি আমার তিন কূলে কেউ নেই।
না,তোর বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন,তাই সৎ মাকে যদি মা ভাবিস,তবে আছে। এতদিন পর দেখা হয়ে তোকে একসাথে অনেকগুলো খারাপ সংবাদ দিতে নিজেরই খারাপ লাগছে,কিন্তু তোর তো দেখছি টাকা পয়সার কোন অভাব নেই,তোর বাবা মারা যাবার আগে তেমন কোন সম্পত্তি রেখে যেতে পারেন নি,শুধু তোদের বাড়ীটা ছাড়া, শুনেছি তোর সৎ মা তার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে কষ্ট করেই দিন পার করছেন। তাই যদি পারিস তাদের কিছু সাহায্য করিস। তিনি খুব আত্নমর্যাদা নিয়ে চলেন,কারও সাহায্য নেন না,তবে তোর সাহায্য হয়তো নিতে পারেন।
পারভেজ চলে যাবার পর,আনিস অনেকক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল,মনে হচ্ছিল জীবনটা যেন থেমে গেল,আর কিছুই করার নেই।
কয়েকদিন পর.......
এয়রপোর্ট থেকে বের হয়ে আনিস হাটা শুরু করল, আনিস এর কাধে ছোট্ট একটি ব্যাগ,প্রথম বারের মত এই নোংরা দেশের সবকিছুই তার অসম্ভব ভাল লাগতে লাগল,ঘন্টা বাজাতে বাজাতে রিক্সা যাচ্ছে- আহা কি সুন্দর লাগছে দেখতে....
এদিকে আনিস নিজের পরিচয় গোপন করে তার সৎ মা অরুনার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেললো।
এটিই বোধয় প্রকৃতির নিয়ম,প্রকৃতি অকারনে কিছু করে না। তার সবকিছুর পেছনে কারন থাকে।যুক্তি থাকে। বর্তমান নিয়ে প্রকৃতির তেমন কোন মাথাব্যথা নেই,প্রকৃতির দৃষ্টি সবসময় ভবিষ্যতের দিকে। প্রকৃতি দেখে মানবজাতির ভবিষ্যৎ কি। এবং সেই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্যই বোধয় প্রকৃতি অরুনার সাথে আনিসের সম্পর্ক তৈরি করল।
আনিসের বাবা রেজওয়ান সাহেবের সাথে বিয়ের আগে অরুনার আর একবার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, ইন্জিনিয়ার লম্বা-চওড়া ছেলে, অরুনারা নিস্নবিত্ত পরিবার, ছেলের কোন ডিমান্ড নেই, তাই ছেলেটির সাথে বিয়ে দেবার জন্য অরুনার পরিবার একেবারে হুমরি খেয়ে পড়ল। এনগেজমেন্ট এর পর ছেলে একদিন অরুনাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুল। নিয়ে গেল জয়দেবপুর ফরেস্টের এক বাংলোতে। নির্জন বাংলো। শুধু একজন কেয়ারটেকার এবং দারোয়ান। কেয়ারটেকার ঘর খুলে দিল।কাঠের বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল,অরুনার ভয় ভয় করছিল। ছেলেটি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে বলল, কি খুকি ভয় লাগছে ( লোকটা মজা করে অরুনাকে খুকি ডাকত) ।
সেই ডাকবাংলোয় অরুনা লোকটির সাথে রাত এগারোটা পর্যস্ত ছিল। অরুনাকে পরে বাধ্য হয়ে গর্ভপাত করতে হয়েছিল। মেয়েদের কলঙ্ক নিয়ে আমাদের সমাজ কথা বলে খুব মজা পায়। নিম্নবিত্ত ঘরের অরুনার তাই রেজওয়ান সাহেবের মত বিপত্নিক বৃদ্ধ ছাড়া বিয়ে হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। ডাকবাংলোয় তার অভিজ্ঞতার গল্প অরুনা কাউকে বলেনি। কিন্তু কেন যানি আনিসকে গল্পটা বলতে ইচ্ছে করছে। আজকে সে আনিসকে বাসায় দাওয়াত করেছে।
নিজের বাড়ীতেই আনিসের নিজেকে অপরচিত মনে হতে লাগল। বারান্দায় সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে বসে ছবি আঁকছে। আনিস কাছে গিয়ে ছবিটা দেখতেই স্তভিত হয়ে গেল। ছোট্ট একটা মেয়ে দু’হাত বাড়িয়ে তার বাবার কাছে ছুটে যাচ্ছে।
আনিসের মনে হলো ছবিটা রঙে আকা হয়নি। আঁকা হয়েছে চোখের জলে। আনিস মনে মনে ভাবল একটা ছবি সবকিছু ভন্ডুল করে দিল নাকি, তার বাবার প্রতি ছোট্ট মেয়েটির প্রগার ভালবাসা দেখে ,মনে হলো বাবাকে সত্যিই সে কখনো বুঝতে পারেনি বা বুঝবার চেষ্টাই করে নি। আনিস কাঁদছে, মেয়েটি আনিসের কান্না দেখে বলল কাঁদছেন কেন ?
আনিস দু’হাতে মেয়েটিকে কাছে টেনে বলল ,সব মানুষই একা রে মা। সংসার ,স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে বাস করে ।তারপরও সবাই একা ।
কথাগুলো শেষ করেই আনিস বাড়ী থেকে বেড়িয়ে গেল।
হোটেলে ফিরে আনিস অরুনাকে চিঠি লিখতে বসল ।
শ্রদ্ধেয় মা ,
................................।
০৬.০৩.১৭
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৫০