জুলাইয়ের শুরুতে একটি বিজ্ঞাপন দেখা গেল একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের । তারা ৫০ পারসেনট কমে ফ্লাট বিক্রি করছে । মুখ চেপে হাসলাম এত দুঃখের মাঝেও । এই ভুঁইফোঁড় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়েছে ইতিমধ্যেই । যারা দু তিন বছর আগে টাকা দিয়ে ফ্লাট কেনার বায়না করেছিলেন তাদের আর কখনো ফ্লাটে ওঠার সৌভাগ্য হবে না । কারন হয় তাদের ফ্লাট শুরুই হয়নি বা আধা সমাপ্ত হয়ে কয়েক মাস আগেই নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। আশ্চর্য হবেন জেনে এই প্রতারনার বিপক্ষে কোন আইন নেই দেশে । বনানিতে বিশাল এক দালানের ভিডিও ফেসবুকে দিয়ে একজন তার সুসজ্জিত ফ্লাট বিক্রির প্রস্তাবনা দিয়ে মোবাইল নাম্বারও দিয়ে দিয়েছে। করোনা কালেই ঢাকা থেকে ৫০ হাজার পরিবার তাদের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন । ঢাকাতে তাদের কোন কাজ ছিলনা , ছিলনা আয় । ঢাকা শহরে বাসস্থান নির্মাণে কোন রকম বাছ বিচার করা হয়নি । যেই চেয়েছে সেই বড় দালান হাকিয়েছে এবং এখন তারা সবচে বড়রকম বিপদের মধ্যে আছে ।
একটু পেছন দিকে যাই দেখতে ঠিক কি কারন ছিল এইসব দুর্ভাগ্যের পেছনে । ৯৮ সালে অফিসে বসে আমি । বিদেশী দুজন আমায় বলল তারা যে নির্মাণ ব্যাবসায় নামতে চেয়েছিল তা হচ্ছে না । তারা আমার হাতে একটা ফ্যাক্স কপি ধরিয়ে দিল । তাতে বাংলাদেশ তথা ঢাকার আবাসন ব্যাবসা কেমন হবে তার একটা রিপোর্ট দিয়েছে । হংকং ভিত্তিক এই কনসালটেশন কোম্পানি লিখছে এই দেশের মুল আয় বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে । শিল্পবান্ধব কোন পলিসি না থাকায় এই মানুষদের প্রথম টার্গেট একটুকরো জমি । এই দেশে জমির মুল্য বিশেষত ঢাকা শহরে বেড়েছে কয়েকগুন । সবার নজর একখানি আবাসস্থল তৈরি করে নিজের পরিবার , অথবা ভাড়া বা বিক্রি করে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হওয়া । আগামি দশ বছরে ঢাকা শহরে আবাসন বৃদ্ধি পাবে বহুগুন । মানুষের জীবনধারন , কর্ম , অন্যান্য সুবিধা প্রপ্তিতে ঢাকা অগ্রগন্য । শিল্পে বিনিয়োগ না হয়ে বাইরের আয়ের টাকায় প্রায় সকল প্রবাসী একটি জমি বা বাড়িতে বিনিয়োগ নিরাপদ মনে করেন । এক্ষেত্রে জমির দামে ঊর্ধ্বগতি বা আবাসনের মুল্য বেড়ে যাবে । আবাসন প্রক্রিয়া ২০০৮ নাগাদ প্রায় হকারি ভিত্তিতে বিক্রির চেষ্টা হবে । আমাদের যারা এইরকম আবাসন ব্যাবসায় নামতে চেয়েছিলেন তারা মুহূর্তেই তা বাতিল করলেন ।
২০০৯ সালে অর্থমন্ত্রী একাধিক ফ্লাট মালিকদের ছাড় দিলেন বাজেটে । সবাই সুযোগ নিলেন এবং যারা কালো টাকা হাতে রেখেছিলেন তারাও দশ বিশটা ফ্লাট কিনে টাকা সাদা করে ফেললেন । কি অদ্ভুত যোগাযোগ তাইনা । ৯৮ সালেই আমি ধারনা পেয়েছি কি ঘটতে যাচ্ছে আর ২০০৮ পেরিয়ে এখন আমি দাড়িয়ে ২০২০ সালে । ঢাকা শহরে এখন মহামারী ফ্লাট বাড়ি নিয়ে । উচ্চমুল্যের ভাড়া থেকে মধ্যম ভাড়ায় যাচ্ছেন অনেকে । মধ্যম থেকে ছোট দুরুমের বাড়িতে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে । আর ছোট আয়ের মানুষ ছোট ঝুপড়ি ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন । এভাবেই বাড়িওয়ালারা একটা নিখুঁত ফাঁদের মধ্যে পড়ে গেছেন । আয় না থাকলে রুটির জোগান কেমনে হবে । ঢাকাতেই প্রায় সব আছে এরকম ফাঁদ সমাজের পরিচালনা কারিরাই তৈরি করেছেন । ঢাকা নিয়ে এক মাস্টার প্লান দেখেছি রাজউকের ছাপানো দুখানা বই যার মুল্য এক লাখ বিশ হাজার টাকা । এটি পাকিস্তানের সময় তৈরি । এতে বিশাল ঢাকা শহর আর উপ শহরের ম্যাপ ছিল । আমি ৭৬ সালে পল্লবীতে এসেছিলাম বাসে চড়ে । ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে সেই একতলা দালান সমৃদ্ধ উপ-শহর পল্লবী এখন বহুতল বিশিষ্ট পল্লবীতে রূপান্তরিত , ধানক্ষেত খাল উধাও । রুপনগরে একটি খাল ছিল যা দখল হয়ে ভয়াবহ দুষিত পানির আধার এখন। নগর বিকেন্দ্রীকরণ আর প্রশাসন সরিয়ে জেলা শহরে নেওয়া অনেক আগের ব্যাপার ছিল । আপনি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ গাড়ি চালিয়ে গেলে মাঝে কোন ছেদ পাবেন না, মনে হবে বিশাল এক শহরেই আছি কয়েক ঘণ্টা। এভাবেই নগর আর শিল্পাঞ্চল বাড়ছে ঢাকাকে ঘিরেই । ঢাকাতে জনসংখ্যা এমনিতেই বেশী । ঢাকাতে আয়ের সুযোগ বেশী । লেখাপড়ার মান ছোট শহর থেকে উন্নত । উচ্চমুল্যের জীবনযাত্রা হলেও নিন্ম ও মধ্যবিত্ত ঢাকাকেই উপযুক্ত ভাবেন । আমি ধানমণ্ডিকে দেখেছি এক তলা থেকে বড় জোর দোতালা ছিমছাম শহর । ৪০ বছরের বেশী সময় বাদে সেই ধানমণ্ডি এখন হাই রাইজে পূর্ণ । এত মানুষের জন্য ড্রেন নেই পয়নিষ্কাশনের জন্য । মধ্য ঢাকা রীতিমত বর্বর তার চেহারায় । বর্ষা শুরু হলে ওখানে জমে থাকা পানি নিস্কাশনের খাল দখল হয়ে দালান হাকিয়েছে । অতএব ভেনিসের মত বসবাস । এখানে দেখেছি আগে দালান হয় তারপর পানি জমলে ড্রেনের পাইপ কেনে বাড়ির মালিকেরা , গ্যাস লাইন টানতে বেশ খরচ করতে হয় । নাগরিক সুবিধার সবটুকু টেন্ডারবাজ ঠিকেদার ছিনতাই করে নিয়ে গেছে । আমি যেহেতু পরিকল্পিত নগরে বাস করেছি তাই আমার আওয়াজ একটু বেশিই হবে।
কি হবে এই যে বিপুল সংখ্যক দালান বানিয়ে রেখে এখন খালি হয়ে যাচ্ছে বা আগেই খালি ছিল । গেল ডিসেম্বরে ঢাকায় চল্লিশ হাজার অবিক্রিত ফ্লাট বাড়ি ছিল । বৈশ্বিক পরিস্থিতি এমন হতে যাচ্ছে যে পঞ্চাশ হাজার পরিবার ঢাকা ছেড়ে গেছেন তারা আমার থেকে জীবনের ক্যাল্কুলেশন বেশী বোঝেন । গ্রামে গেছেন তারা , খাবেন কি ? অক্সফাম আজকের হুশিয়ারিতে বলছে ভাইরাসে যে পরিমান মানুষ মারা যাচ্ছে তার থেকে বেশী মারা যাবে খাদ্যসংকটে । কি ভীষণ ব্যাপার । আমার মেয়ে বাসার বাজার সদাই করে । আজ জিজ্ঞাসা করলাম সবজি কেমন দাম ? বিষণ্ণ কণ্ঠে জানাল ৫০ টাকার নিচে সবজি নেই । দাম বাড়ায় মধ্যসত্ত্বভোগী দালাল যাদের দৌরাত্ন রাষ্ট্রে সবচে বেশী তারাও নিশ্চিন্তে নেই । দালানওয়ালারা এরপর মাগনা থাকতে দিলেও কেউ থাকবেনা । দালান বাড়ির মালিকেরা ব্যাঙ্ক লোণ পরিশোধে অক্ষম আর মাসিক আয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক ভয়ানক সমস্যার মধ্যে পড়বেন । ব্যাঙ্ক এই সম্পদ নিয়ে পড়বে আরেক সংকটে । পিপলস মানির এখানেই হবে অপচয় । দালান মালিক জেলে গেলেও সমাধান আসছে না । নতুন করে কেউই ফ্লাটে বিনিয়োগে করবেন না । সবার এখন সঞ্চয়ী হবার সময় । সঞ্চয় ফুরিয়ে গেলে খাদ্য লুট । কি বিশাল এক সংকট আমরা সেধেই টেনে এনেছি আমাদের ঘাড়ে । তবু একটা আশা আছে তা হচ্ছে ধান উৎপাদন এখন তুলনামুলক ভালই হয় । খাদ্য সামগ্রী যদি ক্রয়সীমার মধ্যে রেখে সরকার সেনাবাহিনী ব্যাবহার করে বিক্রি করতে পারেন তবু মানুষ দুটো ভাত খেতে পারবে হোকনা একবেলা ।
সবাই মুক্তকণ্ঠে তাদের থিওরি দেবেন এখানে কি করে এই দুঃসময় পার করা যায় । অতি উর্বর এই পলির দেশে আমি ক্ষীণ হলেও কিছুটা আশার আলো দেখি , কি জানি ভ্রম কিনা ।।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:২২