somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাহ আজিজ
চারুশিল্পী , লেখক

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গল্প "মোহাজির"

১৩ ই জানুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতীকী ছবি



আমরা শেরাটনে লাঞ্চ মিটিং শেষ করলাম । আমরা চীনা কোম্পানির কর্মকর্তাদের তাদের গাড়ীতে উঠিয়ে দিলাম । পিছনে আমাদের কালো বেঞ্জ । কাইয়ুম সাহেব ও আমিন সাহেব পিছনে উঠলেন । কাইয়ুম সাহেব ঘড়ি দেখলেন এবং বললেন তাকে ধারে কাছের কোন মসজিদে নিয়ে যাবার জন্য । আমি জানালাম স্যার, এটা আমাদের প্রোগ্রামের মধ্যে আছে, আজ শুক্রবার বেলা ১.৫০ মিনিটে নামাজ। গাড়ি অফিস মুখো । উনি বললেন আমরা তো অফিসে ফিরছি, তাহলে আমায় একটি ট্যাক্সি করে ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দাও, আজ হয়তো জুম্মা পড়া হবে না। আমিন সাহেব বললেন কাইয়ুম সাহেব গাড়ি আপনাদের নিয়ে মসজিদে যাবে।
আর আপনি?
আমার একটু কাজ পড়ে আছে অফিসে।
না না তা কি করে হয়, আপনিও চলুন ।
আমিন সাহেব যাবেন না এবং কাইয়ুম সাহেব ছাড়বেন না ।
আমিন সাহেব তার হাদীস শুনালেন ঘর থেকে হাজার মাইল দুরে---- আল্লাহ মাফ করে দিবেন । উল্টা হাদীস এলো এটাই এখন ঘর আপনার ক’বছর হলো ? গাড়ি অফিসের পার্কিং থামল এবং আমিন সাহেব নামতে নামতে বললেন জিন্দেগি এক লম্বা সফর হ্যায়। গাড়ি এবার মসজিদগামী আমি পিছনের সিটে চলে এলাম। কাইয়ুম সাহেব গল্প শুরু করলেন । তিনি এই প্রতিষ্ঠানের হংকংয়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা । কালো আফ্রিকানদের মতো দেখতে । বলে চলছিলেন তার যৌবনের কাহিনী । দুর্ধর্ষ সময়, ৪৭ এর বিভক্তি । কেন তিনি আমায় এই কাহিনী শুনাচ্ছিলেন তার কারণ আমিও বুঝতে পারছিলাম । আমার স্বাধীন বাঙালী আর তিনি উত্তর প্রদেশে অনার্য এক মুসলিম যিনি পিতা মাতার সাথে পাকিস্তানে পাড়ি দিয়েছিলেন । আমি তাকে প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনই বুঝেছি তিনি প্রাক্তন ইন্ডিয়ান । কায়দা করে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আপনার আত্মীয় স্বজন ওখানে কেউ নেই ?
হ্যা আছে, আছে । অনেকেই তখন পাকিস্তানে যেতে চায়নি । আমরা যারা গিয়েছিলাম রোমহর্ষক দৃশ্যের মধ্যে পড়েছি, সারা জীবন তা ভোলার নয় । তিনি চশমা খুলে চোখের কোন মুছলেন। আজ একা আমায় পেয়ে কেন তিনি মন উজাড় করে সব বলছেন, হয়ত তারা বঞ্চিত ।


লুট তরাজ, ধর্ষন পথে পথে। আমি ভীষন কালো এবং আমার বাবা মাও তাই । ফলাফল আমাদের সৌভাগ্য এনে দিল । কয়েকদিন লাগাতার যাত্রার পর আমরা পৌছলাম পাকিস্তানে । করাচির ঘেটো ভাঙ্গা চোরা ঘরবাড়ি হলো আমাদের মাথা গোজার ঠাই । এটাও ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের ।
স্যার কে কে আছেন ওখানে?
চাচাতো ভাই, মায়ের পক্ষের আত্মীয়রা ।
যান না মাঝে সাঝে?
হ্যা বছরে এখন এক দফা নিয়মিত হয়ে গেছে ।
কেমন লাগে পুরানো স্মৃতি?
দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে বললেন, সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমাদের অংশ দখল হয়েছিল, পরে চাচারা ম্যানেজ করেছে। আমার বন্ধুরা, সহপাঠীরা সবাই আমার মত বুড়ো হয়ে গেছে। গেলে ওইযে একবার বসি- পুরো বিকেল, রাত গভীর হয়ে যায় আড্ডায় আড্ডায় । বড় সম্পদ কী জানো? আমি তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই। আমাদের কৈশোর আর যৌবন শুরু সময়টি। ওই শিক্ষা,আনন্দ সারা জীবনের বড় সম্পদ । আমার সম্পদ পড়ে আছে ইউপির গ্রামে, আমার জম্মস্থানে।
৪৭ এর পর ঠিক কত দিন বাদে গ্রামে গিয়েছিলেন?
৬৫র যুদ্ধের পরে । পাসর্পোট পাওয়াটাও ঝামেলা, ইন্ডিয়াতে জম্ম, আবার রিফিউজী! ঠিক কী করতে যেতে চাও ইন্ডিয়াতে। গায়ের রং কালো বলে সন্দেহ বেশি । প্রথম দফা যাওয়ার পর গোয়েন্দাদের আনাগোনা, কত কি ।
আমি তার হৃদয়ের ক্ষরন বুঝতে পারছিলাম । আমাদের অফিস ও হংকংয়ের বৃহৎ স্থাপনায় পাকিস্তানী ও সামান্য কিছু বাঙালী কর্মরত । আর্য পাকিস্তানীরা পাঞ্জাবকেই মূল পাকিস্তান এবং পাঞ্জাবিই হচ্ছে পাকিস্তানীদের ভাষা । কদিন আগে পাক রাষ্ট্রদূত এক জলসায় এমনই ভাষন দিলেন । ভাষনটা অবশ্য উর্দূতেই ছিল। যাক বাবা বাচা গেল, প্রথম টার্গেট ছিল বাঙলা ভাষা, উর্দূর বিপরীতে ৪৮ সালে । ৭১ এ তা বেজোড় । ১৯৮৯ তে উর্দূর বিপরীতে পাঞ্জাবি ভাষা । সময়ের কি নিদারুন খেলা । ৮৯ গিয়ে ঠিক কত সালে দাড়াবে তা দেখার বিষয়।


আবেগতাড়িত কাইয়ুম একাধারে বলে চলছিলেন তাদের বঞ্চনার কাহিনী । হংকং চলে আসার পর এখন নিয়মিত যান জম্মভূমিতে। পাকিস্তানে এখন খুব কমই যাওয়া হয়। ছেলেরা ব্যবসা এবং পড়াশুনা, নিজের টপ চাকরি । পুরোপুরি রিফিউজি হয়ে গেলাম সারা জীবনের তরে ।
তুমি জানো আজিজ, আমার দিকে ঘুরে তিনি বলতে লাগলেন আমরা ঘর বাড়ি বিষয় সম্পত্তি সব ছেড়ে খালি হাতে আরেক ভূখন্ডে হিজরত করলাম । পাকিস্তানীরা আমাদের হিজরতের মূল্যায়নতো করেনি এবং বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলেনি ‘তুমি আমার ভাই তুমি পাকিস্তানী বরং বলেছে“ তোম মোহাজির হো”। কি নিমর্মতা........। কাইয়ুম সাহেব কাঁদছিলেন, আমি স্তব্দ এবং আমার উপলদ্ধি জেগে উঠলো স্বাধীন এবং পরাধীনের মধ্যেকার পার্থক্যে।
মসজিদের গেটে গাড়ি পৌছে গেছে, চীনা ড্রাইভার তড়িৎ নেমে তার দরজা খুলে ধরল।

কপিরাইটঃ শাহ আজিজ

ছবি-গেটি ইমেজ
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:১১
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×