


বুধবার ষষ্ঠ দিনে পা দিয়েছে ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ। যুযুধান দু’পক্ষই একে অপরকে আক্রমণ করছে। গত শুক্রবার থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ ভেঙে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালানোর অভিযোগ উঠেছে ইরানের বিরুদ্ধে।ইরান দ্রুত পরমাণু বোমা তৈরি করার জায়গায় চলে আসবে বলে আশঙ্কা করছে ইজ়রায়েল। যদিও ইরানের দাবি, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের জন্যই তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চলছে।
আশঙ্কা থেকেই ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে গত শুক্রবার হামলা চালায় ইজ়রায়েল। প্রত্যাঘাত করে ইরানও। দু’পক্ষই একে অন্যের উপর লাগাতার হামলা চালাতে শুরু করে। শুরু হয় সংঘর্ষ। সেই সংঘর্ষ এখনও চলছে। সংঘর্ষের আবহে পশ্চিম এশিয়ায় এক উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সামরিক পরিকাঠামোয় ইজ়রায়েলি হামলার প্রতিশোধ হিসেবে মঙ্গলবার মধ্য ইজ়রায়েলে হামলা চালিয়েছে ইরান। অন্য দিকে, ইরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্রকে লক্ষ্যবস্তু করে চলেছে ইজ়রায়েলও।
তবে ইজ়রায়েল এখনও বাগে আনতে পারেনি ইরানের ‘ফোর়ডো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট’। কারণ, ইরানের ওই পরমাণুকেন্দ্র রয়েছে পাহাড়ের নীচে। সুরক্ষিত সেই জায়গা এমন ভাবেই তৈরি যে সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অনায়াসেই সহ্য করে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইজ়রায়েল অতীতে গোপন সামরিক অভিযান এবং রণকৌশল দেখিয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিলেও ইরানের ফোর়ডো পরমাণুকেন্দ্র ধ্বংস করার মতো অস্ত্র তাদের হাতেও নেই। বিশেষজ্ঞেরা এ-ও মনে করছেন, ইরানের সেই ‘পাতালঘরে’ হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করার মতো অস্ত্র যদি কারও কাছে থাকে, তা হলে তা রয়েছে আমেরিকার কাছে।
কিন্তু কেন এত সুরক্ষিত ইরানের ফোরডো পরমাণুকেন্দ্র? ফোরডো ইরানের সবচেয়ে গোপন এবং সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি। ইরানের কোম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং তেহরান থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে ফোরডো গ্রামের কাছে একটি পাহাড়ের নীচে রয়েছে পরমাণুকেন্দ্রটি।
কিন্তু কেন এত সুরক্ষিত ইরানের ফোরডো পরমাণুকেন্দ্র? ফোরডো ইরানের সবচেয়ে গোপন এবং সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি। ইরানের কোম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং তেহরান থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে ফোরডো গ্রামের কাছে একটি পাহাড়ের নীচে রয়েছে পরমাণুকেন্দ্রটি।
ফোরডো পরমাণুকেন্দ্রটি এমন ভাবেই তৈরি যে, শত্রুপক্ষের হামলা অনায়াসেই সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে তার। এমনকি বিমানহামলার পরেও অটুট থাকতে পারে সেই কাঠামো। পরমাণুকেন্দ্রটি মূলত ইরানের ‘ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির অংশ ছিল। পরে সেখানে তৈরি হয় পরমাণুকেন্দ্র।
২০০০ সালের গোড়ার দিকে গোপন ‘আমাদ পরিকল্পনা’র আওতায় ফোরডো নির্মাণ শুরু করে ইরান, যার লক্ষ্য ছিল দেশের অন্দরে পরমাণু অস্ত্র তৈরি। বছরের পর বছর ধরে এর অস্তিত্ব বিশ্বের কাছে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল তেহরান।
২০০৯ সালে পশ্চিমি গোয়েন্দারা ফোরডোর খোঁজ পায়। এর ফলে ইরান আনুষ্ঠানিক ভাবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সি বা আইএইএ)-র কাছে বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে। সেই সময়ে বিষয়টি ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি করেছিল। তার পর থেকে অনেক দেশেরই নজর রয়েছে ইরানের সেই পরমাণুকেন্দ্রের দিকে।
কিন্তু ফোরডো পরমাণুকেন্দ্রকে ধ্বংস করা খুব একটা সহজ নয়। অনেক তাবড় অস্ত্র সুরক্ষিত সেই পরমাণুকেন্দ্রের একটি ইটও নড়াতে পারবে না। অন্তত তেমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু কেন?
ফোরডো এত সুরক্ষিত হওয়ার কারণ হল সেটির অবস্থান এবং গভীরতা। পাহাড়বেষ্টিত পরমাণুকেন্দ্রটি ভূগর্ভের ৮০ থেকে ৩০০ ফুট গভীরে অবস্থিত বলে মনে করা হয়। সাধারণ বোমা, এমনকি উন্নত ইজ়রায়েলি যুদ্ধাস্ত্রও সেটির সামনে তুচ্ছ।
পাশাপাশি ফোরডো পরমাণুঘাঁটি বর্তমানে রাশিয়ার এস-৩০০-সহ ভূমি থেকে আকাশ (সারফেস টু এয়ার) নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত। শত্রুপক্ষের লাগাতার বোমাবর্ষণ থেকে সুরক্ষিত রাখতেই সেই পরমাণুকেন্দ্রকে অতটা শক্তিশালী করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট-এর প্রতিবেদন অনুযাযী, পরমাণুকেন্দ্রটি নিয়ে গর্বের অন্ত নেই ইরানেরও। তেহরান নাকি নিশ্চিত করেছে যেন ফোরডো পরমাণুকেন্দ্রটি বিমান হামলা থেকে অনায়াসে রক্ষা পেতে পারে। ফলে অন্য পরমাণুকেন্দ্রগুলির তুলনায় ফোরডোকে ধ্বংস করা শত্রুপক্ষের কাছে অনেকটাই কঠিন।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ফোরডোর। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির অধীনে, ফোরডো শান্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহার করার কথা ছিল। বন্ধ করার কথা ছিল আইসোটোপ উৎপাদন এবং উদ্বেগজনক পরমাণু কার্যক্রম।২০১৮ সালে আমেরিকা সেই চুক্তি থেকে সরে আসার পর, ইরান পুনরায় ফোরডোয় পরমাণু কার্যকলাপ শুরু করে। ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হচ্ছে সেই পরমাণুকেন্দ্রে, যা পরমাণু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ সীমার কাছাকাছি।
ফোরডোকে এখন ইরানের শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমৃদ্ধকরণ পরমাণুকেন্দ্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি তিন মাসে আনুমানিক ১৬৬ কেজি ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করে, যা আরও সমৃদ্ধ করা হলে চারটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু পুরো বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে ইজ়রায়েল? ইজ়রায়েলি কর্তারা ইরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষা শেষ করে দেওয়ার জন্য ফোরডোকে ধ্বংস করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। আমেরিকায় নিযুক্ত ইজ়রায়েলি রাষ্ট্রদূত ইয়েচিয়েল লেইটারের কথায়, ‘‘ফোরডো ধ্বংসের মাধ্যমে পুরো অভিযান শেষ করতে হবে।’’এই সংঘাতের পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে এসেছে চাঞ্চল্যকর অন্য এক তথ্য। তেহরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্র উড়িয়ে দিতে নাকি বন্ধু আমেরিকার দ্বারস্থ হতে পারে ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। খবর, তেহরানের ওই সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্র ধ্বংস করার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমা ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি) খুঁজছে ইজ়রায়েল। আর তা রয়েছে আমেরিকার হাতে। আর সে কারণেই নাকি আমেরিকার দ্বারস্থ হতে পারে দেশটি। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বা এমওপি হল একটি ৩০ হাজার পাউন্ডের (প্রায় ১৩,৬০৯ কেজি) বোমা, যা রয়েছে মার্কিন বায়ুসেনার হাতে। মনে করা হয়, নির্ভুল ভাবে শত্রুপক্ষের ঘাঁটি বা বড় কোনও ব্যবস্থাপনা বা বাঙ্কার ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে সেই বোমার। তাই এর অপর নাম ‘বাঙ্কার বাস্টার’। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের ওই সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্র ধ্বংস করতে পারে শুধুমাত্র ১৪ টন ওজনের এমওপি-ই। কারণ, ২০০ ফুট শক্তিশালী পাথর ভেদ করে লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত হানতে সক্ষম আমেরিকার ‘বাঙ্কার বাস্টার’। ইজ়রায়েলের কাছে মহাশক্তিশালী সেই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ নেই। তাই এমওপি পেতে নেতানিয়াহুর সরকার আমেরিকার কাছে ধর্না দিতে পারে বলে খবর।
কিন্তু কী এই এমওপি বা বাঙ্কার বাস্টার? আমেরিকার সেই মহাস্ত্রের পোশাকি নাম ‘জিবিইউ-৫৭এ/বি’। এটি মার্কিন সেনার হাতে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী অপারমাণবিক বোমা। প্রায় ১৪,০০০ কেজি ওজনের বোমাটি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার এবং পরমাণুকেন্দ্রের মতো শক্ত বুনিয়াদ অনায়াসে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। মাটির অনেক গভীরে থাকা বাঙ্কারকেও ধ্বংস করতে পারে নিমেষে।
আনন্দবাজার
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০২৫ রাত ৮:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




