২৭ শে মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে পাক হানাদার বাহিনী প্রথম নারায়ণগঞ্জে ঢুকে । প্রথমেই তারা দেওভোগে তৎকালীন জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমেদ চুনকার বাড়ীর উদ্দেশ্যে আসে । তার বাড়ী মনে করে তার দক্ষিণ পাশের জনৈক আহমদ আলীর বাড়ীতে আগুন দেয় । আমাদের বাড়ী চুনকার বাড়ীর পূর্ব পার্শ্বে । আগুন দেখে আশপাশের সকল বাড়ীর লোকজন যে যেদিকে পারছে আত্মগোপন করতে ছুটে গেছে । আমাদের বাড়ীর অনেকের সাথে আমার মা আমাদের বাড়ীর উত্তর পাশের কালাম সাহেবের একতলা দালানে আশ্রয় নেয় । ততক্ষণে মিলিটারীরা চতুর্দিকে আগুন দেয়া শুরু করেছে । কালাম সাহেবের বাড়ীর ভাড়াটেদের টিনের ঘরে যখন আগুন দিয়ে চতুর্দিকে ব্রাশ ফায়ার করছে, তখন সেখানে অনেক হতাহত হয় ! অনেকের সাথে সেখানে আমার মা আহত হন !
সে রাতের ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ৫ জন শহীদ হন ! আহত হন আমার মা সহ আরো ২৫/৩০ জন । আমার মায়ের ডান পায়ের হাঁটুতে গুলি লেগে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় ! ঘটনার পরে কে বা কারা আমার মাকে আমাদের ঘরে ফেলে রখে যায় । রক্তে কাঁথা কাপড়, বালিশ, বিছানা, মশারী সবকিছু ভিজে যায় ! আমরা যখন ২৯ শে মার্চ মিরকাদীম থেকে ফিরে এসে ঘরে ঢুকি তখন রক্তের দূর্ঘন্ধে টিকা যাচ্ছিলনা ! আমার মা তখনও কাঁতরাচ্ছিলেন ! অস্ফূট শব্দ বের হচ্ছিল তার কণ্ঠে ! কি ভয়ংকর ! কি করুন ! কি মর্মান্তিক সে দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় ! আজো আমার গা শিউরে উঠে ! সত্য কথা, যখন এই টাইপ করছি, তখনও !
নারায়ণগঞ্জ হাশপাতালে মিলিটারীরা অবস্থান করছিল । তাই, আমাদের বাড়ীর জামাল উদ্দিন নামক এক যুবক ও আমার মাকে মুন্সিগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যাই । সেখানে জামাল ভাইয়ের পা হাঁটু থেকে হ্যাকস্ ব্লেডের করাতে কেটে ফেলে ! আমি ছোট মানুষ তবুও আমাকেই পা টি জোর করে ধরে রাখতে হয়েছিল ! কি ভয়ংকর চিৎকার করছিলেন জামাল ভাই ! আমিও অনেক ভয় পেয়েছিলাম । আজো সেদিনের ঘটনা ভুলতে পারছিনা । কোন ডাক্তার সেখানে ছিলেন না । যিনি কাজটি করছিলেন তিনি হাশপাতালেরই কোন সহকারী হবেন হয়তো । আমাদের অনেক অনুরোধের মুখে তিনি ওই কাজটি করেছিলেন ।
দীর্ঘদিন কষ্ট ভোগ করে ১ লা সেপ্টেম্বর আমার মা দেওভোগের বাড়ীতেই মারা যান ! আর সেই জামাল ভাই, আজো বেঁচে আছেন কাটা পা নিয়ে ! তাকে দেখতে হলে দেওভোগ সাকিম আলী মসজিদের পাশে গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন সবাই তাকে চেনে পা নাই বলেই । তার কাছ থেকেই শুনতে পারেন আরো বিস্তারিত । সময় পেলে আমারও আরো লিখার ইচ্ছে আছে ।