আমার সমবয়সী বন্ধু তথা খেলার সাথী, লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়ার স্কুলে আমরা একসাথে পড়েছি, তার নাম "অমর" । সে নিজের রক্ত দিয়ে "অমর"লিখে রেখে যায় মৃত্যুর পূর্বে ! সে শহীদ হয়েও আজও আমার স্মৃতিতে অমর হয়ে আছে । লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়ার মোড়ে তার বোনের বাড়ীতে থাকতো । ২৭ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে দেওভোগে পাকসেনারা ঢোকার মুখে ঐ বাড়ীতে গান পাউডার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় । ঘুমন্ত সকলে জেগে উঠে আত্মরক্ষার চেষ্টাকালে এলোপাতারি ব্রাশ ফায়ারে আশেপাশের আরো কয়েক জনসহ এবং পরিবারের সকলের সাথে সেও গুলিবিদ্ধ হয় ! লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়ার মোড়ের রাস্তায় আগুনে পোড়ানো তার লাশ পাওয়া যায় ! নিজের রক্ত দিয়ে তখনকার ইট বিছানো রাস্তায় "অমর" লিখে রেখে যায় মৃত্যুর পূর্বে ! নয়তো লাশ সনাক্ত করা সম্ভব ছিলনা । বহুদিন পর্যন্ত সেই রক্তলেখা দেখাগেছে । নারায়ণগঞ্জের দেওভোগের প্রথম শহীদ সে । সাকিম আলী মসজিদ সংলগ্ন খন্দকার বাড়ীর ছেলে । তাকে দাফন করা হয়েছিল পশ্চিম দেওভোগ নাগবাড়ী সংলগ্ন কুড়িবাড়ীর মাঠের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে হিজল গাছ তলায় । আজ সেখানে বাড়ীঘর । যখন পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়, তখন আমি তার কবর দেখতে গিয়ে খুব কাঁদি ! সে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল বলে প্রায়ই তার কবর জেয়ারত করতাম, কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করতাম । আজো করি । আল্লাহ্ তাকে বেহেশত্ নসীব করুন ।
এরপর পাকসেনারা আমার মায়ের ও জামাল ভাইয়ের হতাহতের ঘটনা ঘটায় । কালাম সাহেবের বাড়ীতে সেদিন রক্তের স্রোত বয়ে যায় । নারায়ণগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার ৪ জনই দেওভোগের । তারা হলেন, সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম (তিনি এখন দেওভোগ থাকেন না), সদ্য প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ দুলাল, সামিউল্লাহ্ মিলন এবং কমাণ্ডার আমিনুল ইসলাম । এই কমাণ্ডার আমিনুল ইসলামের বাড়ী কালাম সাহেবের বাড়ীর খুব কাছেই । এছাড়া, নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব আনোয়ার হোসেনের বাড়ীও কালাম সাহেবের বাড়ীর খুব কাছেই । সর্বশেষ সেই আলী আহমেদ চুনকার যোগ্য উত্তরসুরী আওয়ামী লীগ নেত্রী বিপুল ভোটে বিজয়ী মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর বাড়ী কালাম সাহেবের সীমানা লাগোয়া । তথা আমাদের বাড়ীর পাশেই । সে যদিও তখনকার প্রত্যক্ষদর্শী নয়, তবুও সেসব তার অজানা থাকার কথা নয় ।
১৯৭১ এর হতাহতের অনেক করুন কাহিনী আছে ! কিন্তু "অমরের" কাহিনীটা এজন্যই ব্যতিক্রম যে, সে মৃত্যুর পূর্বে নিজ হাতে নিজের রক্ত দিয়ে "অমর" লিখে রেখে যায় ! সে জীবন দিয়ে নামের সার্থকতা প্রমান করেছে ! শহীদ হয়ে শুধু আমার স্মৃতিতে নয় সত্যিকারের অমর হয়ে আছে আমার বন্ধু "অমর"।