somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজাদ রহমানঃ পোস্টার বিক্রেতা থেকে কোটিপতি।

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আযাদ রহমান। আযাদ প্রোডাক্টসের কর্ণধার। পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে শুণ্য থেকে হয়েছেন কোটিপতি। তার পথ চলাটা এত সহজ ছিল না। কিন্তু শত বাধাও তাকে দমাতে পারে নি। আজ আমরা বলব সেই আযাদ রহমানের কোটিপতি হওয়ার গল্পই। তিনি আমাদের শুনালেন তার সংগ্রামী দিনের কাহিনীগুলো।

প্রশ্নঃ শূন্য থেকে ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছেন।আপনার সাফল্যের মূলে কী?
আই লাভ কমিটমেন্ট। ব্যবসার জন্যও মিথ্যা বলি না। আরেকটা জিনিস পছন্দ করি, আমি ভালো একজন পেমেন্ট মাস্টার। মানে পেমেন্ট দিতে পছন্দ করি, কেউ যদি আমার কাছে টাকা পায়। সফলতার পেছনে এটাও একটা কারণ। আমার তো ধরো পেপার, কেমিক্যাল, প্লেট, ইঙ্ক-এসবের বেশি প্রয়োজন পড়ে, কম্পানিতে ফোন দিয়ে কেউ কখনো বলে না ‘টাকা কবে দেবেন স্যার?’ কারণ জানে, আমাকে কোনো মাল দেওয়া মানে সে তার টাকাটা ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে।

প্রশ্নঃ আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্টটা কী? কিভাবে করলেন?
মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে ভাড়া ছিলাম, কত, মনে নাই। মনে হয় পঞ্চাশ বা চল্লিশ টাকা। একটা ছেলেকে নিলাম। ওকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে পোস্টার বিক্রি করতাম। কখনো নিউ মার্কেট, বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম, গুলিস্তান, সদরঘাট। পোস্টার বিক্রি করতে করতে একদিন বায়তুল মোকাররম আসি। এসে দেখি, জুয়েলারির দোকানগুলো সব বন্ধ। কারণ জানি না, তখন করলাম কী-দড়ি টাঙিয়ে, পোস্টার টাঙিয়ে, ক্লিপ সিস্টেমে পোস্টার বিক্রি করা আরম্ভ করলাম। মার্কেটের এক ছেলে এসে লাগল। বিক্রি করতে দেবে না, ‘আপনার তো এখানে জায়গা নেই, কোত্থেকে আসছেন?’ কিন্তু আই এম ভেরি মাচ লাকি, এ জন্য বলব, ওই সময়ে দেখি, এল রহমান জুয়েলার্সের মালিক, আনিসুর রহমান দুলাল, বায়তুল মোকাররম ব্যবসায়ী সমিতির ১৩ বার প্রেসিডেন্ট।

ওনার দোকানের সামনে থেকেই আজকের আজাদ প্রোডাক্টসের সৃষ্টি। দুই দিন আগেই উনি আমার কাছ থেকে মদিনা শরিফ, কাবা শরিফের দুটি পোস্টার কিনে নিয়েছেন ৩৫ টাকা দিয়ে। ওটা যে ওনার দোকান ছিল জানতাম না। বলছিলেন, ‘৩৫ টাকা? পাঁচ টাকা কম হইলে হয় না?’ ‘না স্যার, পাঁচ টাকা কম হইলে হয় না।’ পরে তো ভাবলাম, ওনাকে কেন ফ্রি দেই নাই! দুলাল ভাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। বললেন, ‘তোমার কী সমস্যা? এখানে পোস্টার বিক্রি করছে, করতে দাও।’ বলল, ‘স্যার ওনাকে তো আগে এখানে কখনো দেখি নাই, নতুন আসছে। ‘ঠিক আছে, নতুন আসছে অসুবিধা কী, তার পরেও টাঙাইতে দাও।’

উনি আমাকে পোস্টার টাঙিয়ে বিক্রি করতে দিলেন। তিন মাস কন্টিনিউ ওখানে পোস্টার বিক্রি করলাম। মনে হয়, জীবনের একটা ধাপ উঠে গেছি। ওই তিন মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা ক্যাপিটাল হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে জানতে পারলাম, দোকান কেন বন্ধ ছিল? গভর্নমেন্ট ট্যাক্স-ভ্যাট ধরে না? ওই সময়ে গভর্নমেন্ট সোনার ওপর কী যেন ভ্যাট ধরেছিল, তার প্রতিবাদস্বরূপ ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট ডেকেছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। যখন ধর্মঘট শেষ হলো, দোকানপাট খুলে গেছে, আমি আর পোস্টার টাঙিয়ে বেচতে পারি না। দুই দিন দাঁড়িয়ে ছিলাম এসে, কী করব চিন্তাভাবনা করতে পারছি না, কোনো জায়গা নাই। এখানে ব্যবসা বেশ ভালোই করছিলাম।

প্রায় নির্দিষ্ট একটা ঠিকানা হয়ে যাওয়ার মতো। দুলাল ভাই তৃতীয় দিন ডাকলেন। বললেন, ‘ভেতরে আসেন।’ শুরু থেকে আপনে কইরা বলতেন আমাকে। ভেতরে গেলাম, ‘দেখেন, দেখলে তো মনে হয় শিক্ষিত মানুষ, আপনাকে আমি এই মুহূর্তে কোথাও বসতে জায়গা দিতে পারতেছি না, তবে এইখানে একটা খাম্বা দেখছেন না? ওইখানে কাঠের বক্স তৈরি করে বসতে পারেন।’ আমার মনে হয় ওনারে আল্লাহ বলেছেন, ‘তুমি এটা আজাদকে বলো।’ গুড আইডিয়া। ছোট একটা কাঠের বক্স তৈরি করেছি, এই এতটুকু, দড়ি দিয়ে পোস্টার টাঙানোর ব্যবস্থা করলাম, যাতে দূর থেকে মানুষ দেখতে পারে। মনে হয় জীবনের দ্বিতীয় ধাপ পার করলাম।

বায়তুল মোকাররম বসে পোস্টার বিক্রি আরম্ভ করেছি, তখন একটা পত্রিকা ছিল তারকালোক, আরেফিন বাদল ভাইয়ের, সায্যাদ কাদিরও ছিল। আরেকজন ভালো ক্যামেরাম্যান ছিল, মাঝি ভাই। ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ আমরা দেখি তাই না? হঠাৎ করেই দেখি, প্রচ্ছদে সকাল-সন্ধ্যা সিরিয়ালের শিমু-শাহেদের ছবি, ভাবছি-হায় রে, এঁদের ছবিই তো খুঁজতেছি। উল্টালাম, আফজাল-সুবর্ণার ছবি ভেতরে, রাজ্জাক ফ্যামিলির ছবি, আরো নায়ক-নায়িকাদের ছবি। মনে মনে ভাবছি, এঁদের ছবির যদি ভিউকার্ড, পোস্টার তৈরি করতে পারতাম, তাহলে কিছু করে ফেলতে পারতাম। যাঁরা সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান, বায়োনিক ওম্যানের পোস্টার কেনে, তারা মনে হয় আমাদের দেশের শিমু-শাহেদ, আফজাল-সুবর্ণার পোস্টার, ভিউকার্ড কিনবে।

ছবি দেখছি আর ভাবছি, এ রকম ছবি যদি আমার থাকত তাহলে ভিউকার্ড, পোস্টার তৈরি করতে পারতাম। তিন দিন ঘুম নাই, শিমু-শাহেদ কত বড় টিভি স্টার, এঁদের ছবি পাব নাকি? পাগল নাকি? মনে কত প্রশ্ন! বুঝেছ? সাহস করে একদিন ভাবলাম, এই পত্রিকার যে মালিক, তাঁর সঙ্গে যদি যোগাযোগ করি, তাহলে মনে হয় ছবিগুলো কালেকশন করতে পারব। পত্রিকার অফিস ছিল নীলক্ষেত। তারকালোকের অফিসে গিয়ে দেখি বাদল ভাই নেই। ছিলেন সায্যাদ কাদির। বললেন, ‘সম্পাদক সাহেব তো নেই। উনি এলে বলতে পারবেন।’ পরের দিন গেলাম, পাইনি। তৃতীয় দিন গিয়ে বাদল ভাইকে পেলাম। বললেন, ‘আইডিয়া তো ভালো, একটু চিন্তা করে দেখি। আরো দুই দিন পর আসেন।’ অত্যন্ত জেন্টেলম্যান। বেশি কথা বলেন না। দুদিন পরে গেলাম। ছবিগুলো দিয়ে দিলেন। আমি অবাক। হুর রে, কী করব! পোস্টার বিক্রি করতে করতে প্রায় লাখখানেক টাকার মালিক হয়ে গেছি।

প্রশ্নঃ নায়ক-নায়িকা বা কপিরাইট বিষয়ে কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়েননি?
আরে শোনো না, নায়ক-নায়িকাদের ভিউকার্ড তৈরি করার পর পোস্টার আনার জন্য ব্যাংকক যাই। যে পোস্টারটা আগে আমরা এখান থেকে কিনতাম ১২-১৩ টাকা করে, ওখানে দাম তিন বাথ! যেটা বাংলাদেশি টাকায় কাছাকাছি। তখন আমরা এক ডলার কিনতাম বাংলাদেশি ১৮ টাকায়, ওখানে ২০ টাকা, আমাদের টাকার মূল্য বেশি। আমিই প্রথম বাংলাদেশে ভিউকার্ড বিদেশ থেকে প্রসেস করে নিয়ে আসি। এখানে একটা ভিউকার্ড প্রসেস করতে পাঁচ হাজার টাকা নেয়। অথচ সেই ভিউকার্ড ব্যাংককে প্রসেস করেছি নিয়ার অ্যাবাউট ৪৫০ বাথ, ৫৫০ টাকায়। টার্নিং পয়েন্ট হলো, ব্যাংকক থেকে ভিউকার্ড এনে এখানে একটা প্রেস ছিল, প্রেস বাংলা, প্রেস বাংলার যাঁরা মালিক, তাঁদের একজন আমেরিকায় আছেন, আরেকজনকে হয়তো চেনো তোমরা, জাহেদুজ্জামান ফারুক। অর্থনীতির টক শো করতেন। সেই প্রেসে ছাপালাম, সুন্দর ছাপা, চকচকে-ঝকঝকে।

তখন ‘৮২-র ওয়ার্ল্ডকাপের পোস্টার চলছিল। এগুলো ব্যাংকক থেকে আনতাম। এই ধারণা থেকে আজকের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট আমাদের প্রিয় স্টার সালাউদ্দিন, সালাম মোর্শেদী, বিজেএমইএর নেতা, এঁদের পোস্টার তৈরি করি। ইন দ্য মিনটাইম জানতে পারলাম, তারকালোক পত্রিকায় ছবিগুলো মাঝি ভাইয়ের তোলা। মাঝি ভাই, আরেফিন বাদল, সায্যাদ কাদির, এ রকম পাঁচ-সাতজন মিলেই পত্রিকার মালিকানা। সাধারণত আমাদের দেশে ব্যবসা করলে মালিকানা নিয়ে যে রকম বিরোধ দেখা দেয়, এ রকম বিরোধ তাঁদের মধ্যে দেখা দিয়েছে। মাঝি ভাই ক্লেইম করলেন, ‘আমার এই ছবিগুলো কেন আজাদকে দেওয়া হলো?’ এ নিয়ে দারুণ উত্তেজনা।

‘আমরা তো আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করেই দিয়েছি।’ আমার সব ভিউকার্ড ছাপিয়ে কমেন্ট করা হলো-‘তথাকথিত বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতের ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ এ ধরনের ভিউকার্ড তৈরি করে বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি আমদানি করেছে। এদের শাস্তি হওয়া উচিত।’ চিত্রালী, সিনেমা, দৈনিক বাংলায় এভাবে যখন প্রচার হতে লাগল, আমার মনে হয় কপাল খুলে যেতে লাগল। বিনা পয়সায় এত প্রচার! ভিউকার্ড ছাপাইলাম পাঁচ হাজার, সাত হাজার করে। চকবাজারে দিলাম। কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। এ বলে ‘ভাই আমাকে ১০ হাজার দিয়েন।’ ও বলে ‘ভাই আমাকে ২০ হাজার দিয়েন।’ ‘ভাই আমাকে ৩০ হাজার।’ আরেকজন বলে, ‘ভাই এক লাখ টাকা রাখেন, কাউরে দিয়েন না, সব আমারে দেন ।’

সকাল থেকে টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ভিউকার্ড কেনার জন্য। ইন দ্য মিনটাইম চকবাজারের লোকেরা আমার প্রোডাক্ট নকল করা আরম্ভ করল। নায়ক-নায়িকারা কিছু বলেননি, বাট ওই সময়ে এখানে ‘অ্যাড বেস্ট’ নামে একটা অ্যাড ফার্ম ছিল। পীযূষদা আর ফারুক নামে একজন ওখানে বসতেন। যখন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি আরম্ভ হলো, ফারুক আমার ওপর চড়াও হলো। এই দিতে হবে, এই টাকা, ওই টাকা-মানে বহুত কিছু। তোমরা তো চিনবা, আমাদের বাচ্চু ভাই, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুক্তিযোদ্ধা, আমার খুব ভালো বন্ধু, এখনকার বন্ধু না, ওই সময়, যখন আজাদ ছোট ছিল। বাচ্চু ভাই একদিন আমাকে ডাকালেন। গেলাম। বললেন, কী হইছে? ঘটনাটা কী? তখন বলল, এই এই। তিনি বললেন, ‘ব্যাটা, তোদের সৌভাগ্য আবুল কালাম আজাদ তোদের ভিউকার্ড তৈরি করছে। তোরা স্টার হয়ে গেছিস। জীবনে কখনো কল্পনা করতে পারছিস, বাংলাদেশে তোদের ভিউকার্ড হবে? আজাদকে ধন্যবাদ দে, গ্রেট আজাদ তোদের ভিউকার্ড তৈরি করছে, এই দেশে নতুন একটা সংস্কৃতি আরম্ভ করেছে।

ভিউকার্ড সংস্কৃতি। দেখবি এই লোক একদিন অনেক বড় হবে।’ বাচ্চু ভাইয়ের সেই কথা এখনো আমার স্পিরিট। এনিহাউ, অনেকে অনেক কিছু ধরে রাখতে পারে না। জীবনে আমি কোথায় ছিলাম, কোটি টাকা দেখেছি; কিন্তু নষ্ট হয়ে যাইনি। আমার বয়স যখন সাত, তখন মা মারা যান। আই অ্যাম অ্যালোন, আমার আর কেউই নাই। ছোটকালে যাদের মা-বাবা মারা যায়, ওই সন্তানরা কত কষ্ট পায়, নষ্ট হয়ে যায়, তাদের মধ্যে সম্ভাবনা খুব কমই থাকে।

প্রশ্নঃ শূন্য থেকে উঠে আসার গল্প অনেক জায়গায় বলেছেন। ব্যাপারটি কিভাবে নিয়েছিল আপনার পরিবার?
একটা ঘটনা বলি-রেজানূর রহমান যখন আমাকে নিয়ে ইত্তেফাকের তারুণ্য পাতা করলেন, তখন আমার বড় মেয়ে ভিকারুননিসায় ক্লাস এইটে পড়ে। ও ক্লাসে গেল, বান্ধবীরা বলছে, ‘তানজিনা, তোমার বাবা নাকি ফুটপাতে ব্যবসা করেছেন, এটা কি সত্য?’ মেয়ে তো ছোট মানুষ, এইটে পড়ে, বুঝবে কী? কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে চলে এসেছে। আমি অফিসে ছিলাম, ওর মা আমাকে ফোন দিল। বললাম, ‘কী হয়েছে?’ ‘লাবণী তো স্কুল থেকে চলে এসেছে। আর যাবে না। ‘কেন? কী হয়েছে?’ বউ আমাকে আপনি করে বলে-‘আপনি নাকি পত্রিকায় বলেছেন, ফুটপাতে ব্যবসা করেছেন, এসব বলার কোনো দরকার আছে? ওর বান্ধবী নাকি ওরে এসব বলেছে, ও কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছে। বলে, আমি আর স্কুলেই যাব না।’

ভিকারুননিসার প্রিন্সিপাল ছিলেন হামিদা আলী। তাঁকে ফোন করলাম। ঘটনাটা বললাম। তিনি আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন, ‘ঠিক আছে, কোন কোন মেয়ে তোমাকে এসব কথা বলেছে আমাকে কালকে স্কুলে এসে দেখিয়ে দেবে।’ পরদিন তিনি ক্লাসে গেছেন, আমিও গেছি, লাবণীও আছে। ও বলল, ‘আপা, এই চারটা মেয়ে বলেছে।’ ওরা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আপা, আমরা তো সত্যিই বলেছি। পেপারে আছে, এই দেখেন।’ আমি বললাম, ‘গুড, তোমরা বসো।’ হামিদা আলী বললেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত, খুবই খুশি, তানজিনার বাবা ফুটপাতে ব্যবসা করে আজকে এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন।’ আরো বললেন, ‘তোমরা কি জানো আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই?’ মেয়েরা বলল, ‘জি আপা, জানি।’ ‘আজ থেকে আজাদ আমার ছেলে। যে আজকে এই পর্যায়ে এসেও বলতে পারে-সে ফুটপাত থেকে ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করেছে। লাবণী হলো আমার ছেলের মেয়ে। এখন কার সম্মানটা বেশি?’ মেয়েরা বলছে, ‘আপা লাবণী, আপনার নাতনি।’ এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। এ গল্পটা সোনারগাঁয়েও করেছি। এই মে মাসের ২০ তারিখে, হামিদা আলী ছিলেন এ বছরের ‘রত্নগর্ভা মা’ অনুষ্ঠানের সভাপতি। রেজানূর রহমানও ছিলেন।

প্রশ্নঃ এভাবে সবখানে জায়গা করে নেওয়ার জন্য আপনাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে?
আমার মেয়ে তানজিনা আজাদ লাবণীর কথা বললাম। লাবণী ২০০১ সালে ঢাকা ক্লাবে স্নুকারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। যদিও আমি ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করেছি, কিন্তু ঢাকা ক্লাবের মেম্বার হয়েছি আজ থেকে ১৮ বছর আগে। সেখানে এত এত বড়লোকের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে, বাট সে সবাইকে হারিয়ে ২০০১ সালে যখন চ্যাম্পিয়ন হয়, তখন এটা ছিল আমার জীবনে একটা বিরাট পাওয়া। মেয়ে চ্যাম্পিয়ন, ছেলে রানার্স আপ। সেকি আনন্দ! আনন্দ এ জন্য-যখন ঢাকা ক্লাবের মেম্বার হওয়ার জন্য প্রথম আবেদন করি, অনেকে অনেক কথা বলেছেন। আজাদ সাহেব তো ফুটপাতে ব্যবসা করে, ওনাকে ঢাকা ক্লাবের মেম্বার বানালে ইজ্জত থাকবে না। কিন্তু সেই আবুল কালাম আজাদের ছেলেমেয়েরাই ২০০১ সালে চ্যাম্পিয়ন-রানার্স আপ হলো।

প্রশ্নঃ সবার মাকে পুরস্কার দেন। আপনার মায়ের কথা মনে পড়ে?
মনে আছে, ছোটবেলায় অনেক দুষ্ট ছিলাম। বাবা ছিলেন বড় মাপের আলেম। ‘উলা পাস’-নাম শুনছ? উলা পাস মানে মেট্রিক। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমার জন্ম চাঁদপুরে, ফরিদগঞ্জ। মা-বাবার কাছ থেকে শুনেছি, লেখাপড়া করতাম না, বেশি বেশি দুষ্টমি করতাম। মা-বাবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাত বছর বয়সেই আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের বাড়িতে দুটি পুকুর, একটা দক্ষিণের পুকুর, আরেকটা উত্তরের পুকুর। উত্তরের পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মা বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার ছেলেকে দেখিয়ো।’ আমিও মাকে হাত নাড়াচ্ছি। তখন তো মায়ের অনুভূতি অতটা বুঝতে পারিনি। বাবার সঙ্গে যাচ্ছি শরিয়তপুর, ওই বয়সটা তো ওই রকমই ছিল। ওই-ই মাকে লাস্ট টাইম দেখেছি। পরবর্তী সময়ে মাকে আর দেখিনি। মা মারা গেছেন।

প্রশ্নঃ রত্নগর্ভা মার ১৪তম আসর হয়েছে। শুরুর দিকে কী রকম রেসপন্স পেয়েছিলেন? এখন কেমন পান? আপনার নানা অভিজ্ঞতাও আছে। যেমন কারো বাসায় এক কাপ চাও খান না, যাতে বিতর্ক তৈরি না হয়…

তুমি ওয়েবসাইট দেখেছ আমাদের রত্নগর্ভা মায়ের? ২০০৩ সাল থেকে প্রত্যেক মায়ের ছবি সাইটে আছে। ২০০৩ সালে গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে আমরা প্রথম অনুষ্ঠান করি। প্রাথমিক পর্যায়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিই। ২৫ জন মাকে অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করি। তখন ধরো, প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০-৬০ জনের মতো অ্যাপ্লাই করেছেন। ওখান থেকে বেছে ২৫ জনকে অ্যাওয়ার্ড দিই। এরপর যতই দিন যাচ্ছে, এর জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন একটা সময় এলো, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে ২০০-৩০০-৪০০ আবেদন আসে। এবার এসেছে ৮৫০। সন্তানরা তাঁদের মায়েদের নির্বাচিত করার জন্য এমনভাবে আবেদন করেন, তাঁদের আবেদন-নিবেদন, অনুভূতি, বলার স্টাইল-তাঁদের মা যেন রত্নগর্ভা মা হন, এটা আমাকে দারুণভাবে অভিভূত করে।

আমি আনন্দিত, আমরা তাঁদের জন্য কিছু করতে পারি আর না-ই পারি, বাট আমরা যখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিই রত্নগর্ভা মায়ের জন্য, অনেকেই বলেছেন, আপনার বিজ্ঞাপন পড়ে আমার সন্তানরা আমাকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে। অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর তাঁদের পরিবর্তন এসেছে। গতবার একজন মা অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর তাঁর অনুভূতি জানালেন, ‘বাবা, আমার তিন মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েরা বড়, বিয়ে দিয়েছি, এক ছেলে ছোট, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, আরেকটা বাবা, মেট্রিক পাস করার পর আর লেখাপড়া করেনি। নষ্ট হয়ে গেছে।’ ‘নষ্ট কী রকম?’ ‘বাবা, খারাপ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে চলে। আসক্ত হয়ে গেছে, কত ডাক্তার দেখালাম, ভালো করতে পারলাম না। বাবা আপনাকে আমি কিভাবে ধন্যবাদ দেব? আপনি আমাকে রত্নগর্ভা মা অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার পর ছেলেমেয়ে, হাজব্যান্ডসহ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে সেলিব্রিটিং অনুষ্ঠান করছি। তখন যেটা খারাপ ছিল, মদটদ খেত, আড্ডা দিত, ওই ছেলেও ছিল। ও বলছে-‘মা, তুমি আমাদের জন্য রত্নগর্ভা হয়েছ।

তুমি তো আমাকে অনেক ডাক্তারের কাছে নিয়েছ, অনেক হাসপাতালে দেখিয়েছ, ভালো করতে পারোনি। আমি তোমার মাথায় হাত দিয়ে বললাম, মা, আর খারাপ পথে চলব না। মাদকাসক্ত হব না। কারণ তুমি একজন রত্নগর্ভা মা।’ সেই মাকে গতবার আবার ফোন করেছিলাম, ‘মা, তুমি কেমন আছ?’ বলেছেন, ‘বাবা, আপনাকে আমি কী বলব? জায়গাজমি, সম্পত্তি সব আপনাকে দিয়ে দেব। আপনি আমার জন্য যা করেছেন। বাবা আমার ছেলেকে বিয়ে করাইছি। এখন একটা নাতি হয়েছে, ছেলে পুরাপুরি সুস্থ।’ কী যে আনন্দ! আই লাইক ইট, আই লাভ ইট। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এই অনুষ্ঠান করি কেন জানো? আনন্দের জন্য। আমার দেশকে মনে হয় কিছু দিতে পারছি। এটা আমার আনন্দ, এতে আমি খুব খুশি। এমন একটা অনুষ্ঠান করি, মায়েদের নিয়ে অনুষ্ঠান! ইভেন এ অনুষ্ঠানে আমি আজাদ প্রোডাক্টসের একটা বিজ্ঞাপন পর্যন্ত করি না। মায়েদের নিয়ে আমি বিজ্ঞাপন করব? প্রশ্নই আসে না।

প্রশ্নঃ আপনার ব্যক্তিগত জীবন, আপনি তো খুব সংগ্রাম করে উঠে আসা মানুষ, বিয়ে করেন কত সালে?
২৪ মে ১৯৮০, তখন আমি সদ্য গ্র্যাজুয়েট, বেকার যুবক। ও মতিঝিল আইডিয়ালের ক্লাস এইটের ছাত্রী। দূরসম্পর্কের মামাতো বোন। তখন এজিবি কলোনিতে ভাড়া থাকতাম। ওভাবে দেখা-সাক্ষাৎ-পরিচয়, মামাকে বলা। ৩০০ টাকা দিয়ে কলোনিতে ঘর ভাড়া করে উঠেছিলাম। ওই ঘরেই আমার প্রথম মেয়ে লাবণীর জন্ম। আমার দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে থাকে ক্যালিফোর্নিয়ায়। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে হাজব্যান্ডের সঙ্গে আছে। জামাই পিএইচডি করছে মেডিসিনে আর মেয়ে এনভায়রনমেন্টে। আমার মেয়ে এবার রত্নগর্ভা মা অনুষ্ঠানে বলেছে, ‘আমরা আগামী বছর বাবার কাছে অ্যাপ্লিকেশন করব, আমাদের মাকে ‘রত্নগর্ভা মা’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য।’ মানুষ যে তালি দিছে না, অসংখ্য তালি!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×