somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: সড়ক

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শাহপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে 'আসসালাতুল খইরুম মিনার নাউম' (ঘুম থেকে সালাত উত্তম), অনেক মুরব্বি মুসল্লি ইতিমধ্যে মসজিদে চলে এসেছে, অনেকে ওযু করছে, কেউ কেউ মেসওয়াক করছে কিন্তু এই মসজিদের একজন নিয়মিত মুসল্লি আজ আর আসবে না, গতকাল তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। প্রতিটি প্রানীর শেষ গন্তব্য এই একটি পথ। কিন্তু আলী মাষ্টারের মৃত্যু গ্রামে এক চাপা কষ্ট, আলোচনা জন্ম দিয়েছে কারণ তিনি স্বাভাবিকভাবে মারা যান নি! আত্নহত্যা করেছেন! হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন তিনি আত্নহত্যা করেছেন।
সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তার ছোট্ট একটি চিরকুট নিয়ে যা তিনি মৃত্যুর আগে নিজের নোট প্যাডে লিখে রেখে গেছেন। এক লাইনের একটি লেখা "এ সময় দেখতে হবে ভাবতে পারিনি, সহ্য অথবা ধৈর্য্য কোনটির শক্তি নেই তাই চলে গেলাম"।

আলী মাষ্টার নামে তিনি গ্রামে পরিচিত, বাবা মায়ের আকিদা করা নাম, শুকুর আলী। হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন, অবসর নিয়েছেন বছর পাঁচেক হবে। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি সব সময় সবার সাথে মিলেমিশে গল্প করতে ভালবাসতেন। গ্রামের সব ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে তার ছিল ভীষণ ভাব, কেউ নানাভাই, কেউ দাদাভাই বলে ডাকতেন। সময় পেলে ওদেরকে নিয়েই মেতে থাকতেন। কেউ হয়তো বলছে দাদাভাই বাঁশ বানান করেন তো, উনি এক ফালি হাসি দিয়ে বলতো কঞ্চিসহ নাকি কঞ্চি বাদে? কেউ হয়তো বলছে নানাভাই সুটকেস বানান করেন, উনি বরারবের মতই মুখে হাসি রেখে বলছে আংটাসহ নাকি আংকটাবাদে? এভাবে উনার অবসর সময় কাটতো।

উনার আরো একটি পরিচয় আছে, উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তবে কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া সরকারের কোন সুবিধা তিনি ভোগ করেননি, মধ্যবিত্ত মানুষ, বাবার রেখে যাওয়া কিছু ফসলের জমি, ভিটেমাটি আর নিজের বেতন দিয়েই দুই ছেলের পড়াশোনা করিয়েছেন, দুই ছেলেই এখন চাকরি করে, একজন সরকারি একটি ব্যাংকের হিসাবরক্ষক, অন্যজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ব্যবহার করে তিনি চাইলে বড় পদে চাকরির সুযোগ করে দিতে পারতেন তবে তিনি তা কখনো পছন্দ করতেন না, স্ত্রী, ছেলেরা অনুরোধ করেনি তা নয় তবে উনার একই কথা যুদ্ধে গিয়েছিলাম দেশকে ভালবেসে, ভালবাসার প্রতিদান নিলে ভালবাসার মহত্ত্ব কমে যায়।

কখনো কখনো বিকালে একটি ছোট নদীর ধারে এসে বসতেন, সাথী উনার মত অবসরপ্রাপ্ত কিছু মানুষ, গল্প গুজবে সময় পার করাই ছিল যাদের উদ্দেশ্য। নদীটির নাম সুরেলা, নদীর নাম নিয়ে গল্প আছে, অন্য একদিন সুরেলা নামের ইতিহাস নিয়ে বলবো। এক সময়ের খরস্রোতা নদী এখন মৃত্য প্রায়, দেশের আরো শত শত নদীর মতই। এটাকে এখন নদী না বলে খাল বললেও ভুল হবে না। নদীর দক্ষিণ পাড়ে দিকে একটি বাজার আছে, আশেপাশের চার পাঁচ গ্রামের মধ্য এই একটি বাজার, শনি ও মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট বসে তাছাড়া প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা বাজার থাকে। নদীর উত্তর পাশের মানুষের যাওয়ার জন্য নদীতে একটি বাঁশের সাঁকো দেওয়া, উত্তর পাশে এক সময় তেমন জনবসতি ছিল না তাই রাস্তা ব্রীজ নিয়ে তেমন কেউ কথা বলতো না, কিন্তু এখন উত্তর পাশে রীতিমতো বড় একটি গ্রাম তৈরি হয়ে গেছে। সরু সড়কে চলাচল কষ্টের তার উপর সাঁকোটি অনেক পুরানো তাই এলাকার মানুষের জোর দাবি সড়ক বড় করা হোক সাথে সাঁকো ভেঙ্গে ব্রীজ করার।

অন্য সব কাজের মতই এ কাজেও সবার সম্মুখে আলী মাষ্টার, অনেক দৌড়াদৌড়ির পর অবশেষে চেয়ারম্যান সাহেব কথা দিয়েছেন আগামী বছরের আগেই কাজ হয়ে যাবে, রাস্তা প্রশস্ত হবে সাথে সাঁকোর জায়গায় ব্রীজ।

গত সপ্তাহে চেয়ারম্যান কাজের উদ্বোধন করে গেছেন, কাজ বেশ জোরেশোরে চলছে, রাস্তা ও ব্রীজের কাজ এক সাথে।

আজ বিকালে যখন তিনি নদীর পাশে বসলেন, দেখলেন সাঁকোর উত্তর পাশে একটি বিলবোর্ড, সেখান লেখা "কেরামত সড়ক" ও "সুরেলা ব্রীজ" লেখাটি পড়ে তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, মনে অজান্ত মুখ থেকে একরাশ হতাশা নিয়ে বের হল, কেরামত সড়ক!

পুরো নাম কেরামত ব্যাপারী, এলাকায় ডাকাত কেরামত নামে সবাই চিনে, একাত্তরের দুর্ধর্ষ ডাকাত আজ সমাজ সেবক! কয়েকদিন আগেও সবাই তাকে এক প্রকার প্রকাশ্যে ডাকাত বলতো কিন্তু এখন সবাই সম্মান করে কারণ তার ছোট ছেলে এখন ক্ষমতাসীন দলের একটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা।
এই কেরামতই আলী মাষ্টারের বন্ধু সুবিরকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার সব সম্পদ নিয়ে নেয়, সুবির যুদ্ধের সময় জীবন বাঁচাতে সবকিছু বিক্রি করে ভারতে চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তার পূর্বেই তাঁকে হত্যা করে কেরামত ও তাঁর ডাকাত দল। পরিবারের মেয়েদের উপর চালায় নরকীয় কর্ম।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আলী মাষ্টার এই নামকরণ মানতে পারেননি, তিনি চেয়ারম্যানের কাছে, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে গেলেন, কোথা থেকে আশার আলো পেলেন না, সবার একই কথা অনেক উপরের হাত আছে এখানে, কোনভাবেই নাম বদলানোর সম্ভব নয়।

রণাঙ্গনের বীর আলী হেরে গেলেন, নিজেকে ধীরে ধীরে বন্দি করলেন ঘরের চার দেয়ালে, ছয় মাস পর কাজ শেষ হল, উদ্বোধনের দিন জেলা পর্যায়ের অনেক নেতার আসার নাম প্রচার হতে লাগল মাইকে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আছে। যেদিন উদ্বোধন হবে তার আগের রাতেই আত্নহত্যা করেন আলী মাষ্টার।

কেরামত নামক সড়কটি একদিন হয়তো আরো উন্নত হবে, হাজার হাজার মানুষ হয়তো চলবে এই রাস্তা দিয়ে, ব্যস্থতা থাকবে অনেক শুধু কারোর মনে থাকবে না একজন বীরের অভিমানের গল্প, কষ্টের গল্প জড়িয়ে আছে এই সড়কের সাথে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:২৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×