মাঝ চৈত্রের দুপুর বেলা। চিলের কান্না ছাপিয়ে, এক পসলা কান্নামাখা হাসি নিয়ে এসেছিল । কি এক নির্মল সে কান্না। নোয়ার প্রথম কান্না এটা, আজ সে পৃথিবীতে এসেছে। নানা এবং দাদা গোষ্ঠীতে তার প্রজন্মের সেই প্রথম। সমায়ের সাথে দোস্তি করে বাড়তে থাকে নোয়ার দোস্তির সীমানা।
দিনে নোয়া ঘুমায় আর আশেপাশে জেগে থাকে ডজন খানেক নিঃশব্দ চোখ। কখন নোয়া জাগবে আর আর গল্প হবে, আর হবে বুঝ আর অবুঝের ভাব বিনিময়। দু পক্ষের ভাষাই অবোধ্য অন্যের কাছে, তবু ভাবের কমতি নেই। এক বছরি নোয়ার সাথে বড়দের লক্ষ বছরি ভাব। ঘড়ের ছোট আসবাব গুলোর ঠাই হয়চে অন্য ঘড়ে, খেলনাগুলি নিয়েছে তাদের জায়গা। নোয়া হাঠচে , বাড়ছে, আর বাড়ছে তার ভাবের ও ভবের বাজার।
নোয়া বলতে শিখেছে।মাকে ডাকে মাই। নোয়ার নতুন বিছানায় শত কার্টুনের ছরাছড়ি। ডান দিকে কাঠের ঘোড়া, সামানে ছোট আরাম চেয়ার আরও কত কিছু।নোয়া আজ তিন পার করেছে। মায়ের ঘরটা ঠিকই আছে তারপর ও রাতে নোয়ার ছোট বিছানাই মায়ের আর নোয়ার বিছানা হয়ছে।
ফাগুনের এক রাতে কান্নার শব্দে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গে বাড়ির সবার। নোয়া চিৎকার করে কাঁদছে আর মাঝে মাঝে ভীত সূরে বলছে কাঁতু, কাঁতু। কারও জানা নেই কে সেই কাঁতু। বাড়ি ভরা মানুষ। সবাই চেষ্টা করছে নোয়া কে থামাবার। না থামছে কান্না , না কমছে জ্বর । ঘুমহীন রাত কাটে কান্না আর জ্বরে। সকালে ডাক্তার, হাস্পাতাল অবশেষে কান্না থেমেছে থামেনি ওই কাঁতু আর জ্বর। জ্বরের ঘোড়ে নোয়া চিৎকার দেয় কাঁতু, কাঁতু বলে। নোয়ার ভীত চিৎকার সবার বুকের মাঝে খামছে ধরে। কাঁতু যেন বিভীষিকার নাম, আজরাইলের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু।
মেডিকেল রিপোর্ট আসে, ভাক্তার বোঝায় মরণ ব্যাধিতে পেয়েছে নোয়াকে, পৃথিবীর সবোচ্চ চেস্টাও নিঃসন্ধেহ বৃথা হবে তার কাছে। আজ বিজ্ঞানের লজ্জা পাবার দিন। আধুনিক বিজ্ঞানও আজ হার মেনেছে কাঁতুর কাছে। নোয়ার দুরন্তপনা একটুও কমেনি কমেছে শুধু তার বয়সে বড় বন্ধুদের মুখের হাসি। কি আজব এক কাতু এসে তাদের সবার হাসির উপর শুকনো মলাট এঁটে দিয়েছে।
নোয়া মায়ের কোলে বসে আছে। “মাই তুমি আমার কে হও গো?” নোয়া জিজ্ঞেস করে মাকে। গো কথাটা শিখেছে তার বাবার কাছ থেকে। মা বলে “আমি তোর মাই রে বোকা, আমি তোর মাই”। নোয়া বলে “মাই তো বুঝিই। তাও তুমি আমার কে হও?” আরও বলে “ওই টা কাকা, ওইটা নিনি, ওইটা খালামনি, তুমি কে গো?”
কে বঝাবে নোয়াকে মাই তো মাই ই কোটি সম্পর্কে যার তুলনা হয়না। যে বাধনের কোন সমকক্ষ হয়না, হয়না না কোন সংজ্ঞা। নিরোত্তর মায়ের গন্ডবেয়ে অশ্রু গড়ে পড়ে। উত্তর না দেবার অশ্রু নায়, সজ্ঞাহীন অসীম কোন না জানা উত্তর না দিতে পারার অশ্রু।
নোয়া জিজ্ঞেস করে “ মাই মানুষ কি হয়?”
মা উত্তর দেয় “ বড় হয়” । নোয়া বলে “তারপর?”।
মাই বলে “বুড়ো হয়”।
নোয়া বলে “তারপর?”
মাই বলে “ তাঁরা হয়”।
“ মাই তুমিও তো একদিন তাঁরা হবে ?” নোয়া জিজ্ঞেস করে।
মা কিছু বলে না,চোখ মোছে। নোয়া বলতে থাকে “আচ্ছা মাই কে আগে তারা হবে তুমি , আমি, না বাবা?”
মা উত্তর দিতে পাড়ে না, হু হু করে কাঁদে। নোয়া বলে “তুমি কাঁদছ যে মাই?, আচ্ছা মাই তারার জীবন কি খুউউব কস্টের?”
কে বঝাবে নোয়াকে তাঁরারা নিজের আলোতে হাজার জনকে কাঁদায়, নিজেরা কাঁদে কি না কেও জানে না । কেউ না ।
চার পেরনো নোয়ার ছোট্ট শরীরখানা ভেঙ্গেছে বেশ। রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে কান্না করে। শরীরটা দিনকে দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। শরীরটাকে কুকরিয়ে বাকা চাঁদের মত হয়ে ঘুমায় সে। হাতদুটো থাকে বুকের সাথে শক্ত করে লাগানো, যেন কাতু তার বুকের কাছে আসতে না পারে।
কিছুদিন হল ব্যাথা বেড়েছে নোয়ার শরীরের । নরম বিছনায় ঘুমোতে পারে না তাই মা আর নোয়ার বিছানা হয়েছে মেঝেতে। ছোট একখানি তোয়ালের বিছানাতে নোয়ার শরীরটা এঁটে যায়।
আজ বৈশাখের রাত তুমুল কালবৈশাখী ছিল বাইরে । এখন বাতাস থেমেছে কিন্তু কিন্তু বৃষ্টি চলছে। নোয়া বলে বারান্দায় যাবে বৃষ্টি ধরতে। মা না করে না । নোয়ার দুর্বল হাত বৃষ্টি ধরার শক্তিটুকুও হারিয়েছে। মায়ের হাতে নোয়ার হাত রেখে বৃষ্টি স্পর্শ করে দুর্বল গলায় ফিসফিসিয়ে মাকে বলে “ মাই বৃষ্টি কেন হয়?” নির্বাক মা উত্তর দেয় না, কাঁদে । “ মাই তারারা কাঁদলে তবে কি বৃষ্টি হয়?” নোয়া বলে । মা এখন ও নিরত্তর।
শ্রাবণের রাত আজ। নোয়ার জীবনে সপ্তম শ্রাবণ হবার কথা ছিল। নোয়ার ঘড়ের মেঝেতে শুয়ে আছে মা । অসাড় দেহ , নড়তেও চায়না মন। পাসেই নোয়ার শূন্য তোয়ালে আর বালিশ পাতা। মা আর নোয়ার বিছানাকে ঘিরে আছে অসীম শূন্যতা, যা মায়ের মতই সংজ্ঞা হীন। বাইরে তারারা কাঁদছে। মা বারান্দায়া এসে বসে। বৃষ্টি হয়ে ঝরছে তারাদের কান্নাগুলো, মায়ের হাতে। কনাগুলো মার হাত স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করে “ মাই তুমি আমার কে হও গো?” । মা বৃষ্টির জল আর অশ্রু হাতের তালুতে এক করে বলে “ আমি তোর মাই ই রে বোকা ? আমিই তোর মা। যে সম্পর্কের সংজ্ঞা হয় না”।
মা তোমার নোয়া তো সংজ্ঞা কি তাই বোঝে না, চির অবুঝ।