‘জান্নাত পর্যন্ত সহযাত্রী’-এই শ্লোগানকে সামনে রেখে গত ১১ মার্চ তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২তম বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ৬০০ শিক্ষার্থী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রীহলে ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে নবজাতক উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। অথচ ইরানের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবাহ উৎসব’ এহেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াবার অন্যতম সুন্দর সমাধান।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হবার পর সেদেশের আলেমসমাজ তারুণ্যের নৈতিক উন্নতির প্রতি বিশেষ নজর দেন। সমাজ থেকে জেনা, ব্যাভিচার, একাধিক প্রেম, তাতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা, কিংবা অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক, ভ্রুন হত্যা, গর্ভপাতের মত জঘন্য বিষয়গুলো থেকে তরুণদের রক্ষা করতে প্রায় দুই যুগ ধরে এ ধরণের ‘বিবাহ উৎসব’ চলে আসছে। সাধারণত ইরানের সর্বোচ্চ নেতার অফিস ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে প্রতি বছর এই ‘বিবাহ উৎসবের’ আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ বছর ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১২ হাজার ছাত্রছাত্রীর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা অবিবাহিত ছেলেমেয়েদেরকে পরস্পরের কাছাকাছি আসার অনেক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এখানে পরস্পর চিন্তা বিনিময়ের সুযোগ ঘটছে; যেসব বিষয়কে একটি ছেলে বা মেয়ে গুরুত্ব দেয়, তার ভিত্তিতেই অপরজনকে পছন্দ করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কেবল এই বিষয়টিকে স্থায়ীবন্ধনে রূপ দিলেই তা সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনবে; যে প্রচেষ্টা ইরানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পক্ষ থেকে করা হয়ে আসছে গত দুই যুগ যাবত। বিপরীতে আমাদের বাংলাদেশে ছেলে-মেয়েদের কাছাকাছি আসার সুযোগ ঠিকই ঘটছে কিন্তু বিয়েকে সামাজিকভাবে আরো কঠিন করে দেয়া হয়েছে। যে সম্পর্কের কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেই প্রেমের সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তরুণদের, এতে যৌবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, প্রোডাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে। যে তরুণ নিজের আবেগ ও যৌনজীবন সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে, যা আমাদের অভিভাবক সমাজ দীর্ঘদিন যাবৎ উপেক্ষা করছেন।
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজারের বেশি স্বেচ্ছা-গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। তবে বিভিন্ন ক্লিনিকের সূত্রে যা জানা যাচ্ছে, তাতে এর মাঝে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অবিবাহিত ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি। এতো গেল গর্ভে সন্তান এসে যাবার পরিসংখ্যান। জন্মনিরোধক বিভিন্ন সামগ্রীর সহজলভ্যতার এই যুগে তাহলে প্রতিদিন কত হাজার কিংবা লাখ অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ঘটছে ষোল কোটি মুসলমানের এই দেশে, তা দেশের অভিভাবক মহলকে ভেবে দেখা উচিৎ। কোনো পিতামাতাই তার নিজের সন্তানকে চরিত্রহীন বলেন না কিংবা ভাবতে পছন্দ করেন না, এ কারণে তারা গোটা বিষয়টার দিকেই চোখ বুঁজে থাকেন। বাবা-মা’র কাছে সে সন্তান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ভদ্র ছেলে-মেয়েটিই হয়ে রয়েছে কিন্তু তার জীবনসঙ্গীর চাহিদা তো আর থেমে নেই। আল্লাহতায়ালা তো আর আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর অপেক্ষা করিয়ে রাখেননি যে, আদমের উন্নত ক্যারিয়ার হোক, তারপর হাওয়া (আ.)-কে এনে দিবেন তার কাছে! তিনি আদমকে সৃষ্টি করেই হাওয়াকে সৃষ্টি করে তাদেরকে সঙ্গী করে দিয়েছেন।
নারী’ কিংবা ‘পুরুষ’ হিসেবে বৈশিষ্ট্য, চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা বিশ্বের সব দেশ ও জাতির মানুষের মধ্যে একই রকম। কিন্তু আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় সেই আদম সন্তানদের গড়ে তুলছি, যেখানে মাঝখানে শিক্ষা ও ক্যারিয়ার নামক জিনিসকে প্রবেশ করিয়ে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ককে ব্যাহত করা হচ্ছে। মাঝখানে কেবল অবাধ মেলামেশার সমাজে তাদেরকে যথাবয়সে বিয়ে না দিয়ে অবৈধ সম্পর্কের সুযোগই করে দিচ্ছি। বাংলাদেশের সচেতন অভিভাবকরা ইরানের বিবাহ উৎসবের এই মডেল অনুসরণ করলে এদেশের তরুন-তরুণীরা মানসিকভাবে আরো স্থিতিশীল হবে; প্রেম, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যা কিংবা অবৈধ মেলামেশা আর ট্রাঙ্কের ভিতরে সন্তান- এ ধরণের বিষয় থেকে রক্ষা পাবে।
প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুর্বে বিয়ে দিলে নব দম্পত্তি চলবে কীভাবে বলে অনেকেই হয়ত চিন্তা করছেন। অথচ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পূর্বে কিন্তু তারা ঠিকই সন্তানদের সমস্ত খরচ বহন করে চলছেন। তাহলে ছেলে ও মেয়ের দুই পরিবারই যদি প্রতিষ্ঠিত না হবার পূর্ব পর্যন্ত দম্পত্তিকে একত্রে সহায়তা করেন তবেই কিন্তু আর কোন সমস্যা থাকে না। সবাই এক সময় নিজের মত করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় আজকের যে তরুন ২৫ বছর বয়সে অপ্রতিষ্ঠিত সেও ৪০ বছরের মধ্য বয়স্ক হবার সময় প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজে বৈধ সম্পর্কগুলোকে সহজ করে দিলেই অবৈধ সম্পর্কের প্রতি আর কারও আগ্রহ জন্মাবে না। সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
কার্টেসিঃ আশরাফুর রহমান, খণ্ডকালীন শিক্ষক, তালিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, এস্তোনিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:৩০