লাল কোর্তাধারী কেউ একজন সম্প্রতি আমার একটি পোস্টে মন্তব্য করেছিলেন যে, আমার ব্যবসা থেকে পাওয়া লভ্যাংশ যেন আমি কোন সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যয় না করি। বরং, সেটি যেন পূনরায় আমার ব্যবসাতেই বিনিয়োগ করি। একটু চিন্তা করলাম। লোভ মানুষকে ধ্বংস করে। আর, সম্পদ যত নিজের কাছে থাকবে, তা ততো লোভের সৃষ্টি করবে। তাই, নিজের ব্যবসায় লাভের টাকা ফিরিয়ে নেওয়া মানে লোভের কাছেই ধরা দেওয়া, পুঁজিবাদের দিকেই এগিয়ে যাওয়া।
সমাজ চিন্তাবীদ সৈয়দ মবনু'র মতে, পুঁজিবাদীদের মধ্যে আমরা প্রধানত চারটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই-
১) ব্যক্তির সম্পত্তিতে স্বত্বাধিকারী ব্যতীত অন্য কারো কোন অধিকার নেই।
২) অর্থোপার্জনের যে কোন পথ বা পন্থা সেই ব্যক্তি অবলম্বোন করে।
৩) সম্পদের মালিক যেখানে ইচ্ছে সেখানে সম্পদ খরচ করে।
৪) জনসাধারণের স্বার্থকে উপেক্ষা করে একজন যত ইচ্ছে তত সম্পদ সঞ্চয় করতে পারে।
পুঁজিবাদীদের কবলে পড়ে দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। শহরাঞ্চল থেকে ছটিয়ে পুজিবাদীদের সংস্থাগুলো আজ গ্রামের দরিদ্র মানুষদের হাস-মুরগী, ডিম, গরু এমনকি বৌ-ঝিদের ইজ্জতের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। পুঁজিবাদীদের অর্থ সমাজের উচ্চ শ্রেণীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। সবাই এখন ইয়া নফসি, ইয়া নফসি অবস্থা।
পুঁজিবাদীদের চরম শত্রু মার্ক্সবাদীরাও আজ মুখ বন্ধ করে বসে আছেন। জনগণের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উর্ধ্মূল্যের মধ্যে গুদামজাতকারী কালোবাজারীদের উৎপাতের দিক থেকে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। ঋণের ভারে জর্জরিত মানুষের স্বার্থ রক্ষা আর তাঁদের দিয়ে হয় না।
১৯৭১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, আমাদের বৈদেশিক ঋণ ছিলো প্রায় ২১২৫ বিলিয়ন টাকা। সরকার তার উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যে আরো ৭০,৫০২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার চিন্তা করছেন। ঋণ নিয়ে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, ঠিক আছে। কিন্তু, দেশের মানুষের মানসিকতার উন্নয়ন হচ্ছে কি? হেফাজতের তান্ডব দেখে তা মনে হচ্ছে না।
দাতা সংস্থাগুলো ঋণের বোঝা চাপিয়ে কিভাবে একটি দেশকে পরনির্ভরশীল করে তোলে, সেটার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা 'এন,এস,এ'-এর সাবেক এজেন্ট জন পার্কিন্সের লেখা একটি বই থেকে। সেই বইতে তিনি চাকুরীকালীন নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন-
প্রথমত বিশাল অংকের আন্তর্জাতিক ঋণ প্রদানকে ন্যায়সঙ্গত করার ব্যাপারে আমাকে কাজ করতে হবে...। দ্বিতীয়ত, সেই ঋণ নেওয়া দেশটিকে কিভাবে দেউলিয়া করা যায় আমাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে যাতে সেই দেশটি দাতা দেশগুলোর কাছে চিরতরে বাধা পড়ে। এতে করে যখন সামরিক ঘাটি স্থাপনে তাদের ভূমি, জাতিসংঘে ভোট দান কিংবা তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের কাছে দরকার পড়বে, তখন তারা আমাদের সহজ শিকারে পরিণত হবে।
তিনি আরো লিখেছেন-
আমার মতো মানুষদের কাজের ফলে ইকুয়েডরের মতো একটি দেশের দারিদ্র সূচক ৫০ থেক ৭০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্ব বা অর্ধ-বেকারত্ব ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশে। দেশের ঋণের পরিমাণ ২৪ কোটি ডলার থেকে বেরে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার কোটি ডলারে। দেশের জাতীয় সম্পদের মাত্র ৬ শতাংশ ব্যয় হয় দরিদ্র জনগণের জন্যে, যা আগে ছিলো ২০ শতাংশ।
নিজের ব্যবসার লভ্যাংশ আবার নিজের ব্যবসাতেই ফিরিয়ে নেওয়া আমাকে পুঁজিবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করারই নামান্তর। যদিও, আমি যে সম্পদ অর্জন করি বা করছি, সেটার সিংহভাগই মানুষের কল্ল্যাণে নিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রকল্পে দানের জন্যে। আমার প্রতিষ্ঠান কখনোই পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণায় দূষিত হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:১৩