এরমধ্যে আমাদের কবি বন্ধু পিয়াস মজিদের ফোন- নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া শহীদ মিনারে গঙ্গাফড়িং নামে একটা সংগঠন সূর্যগ্রহণ দেখানোর আয়োজন করেছে। যাবো নাকি?
এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। নারায়ণগঞ্জ তো ঢাকার বাইরে। সেখান থেকে দেখাটাও মেনে নেয়া যায়,তবে ঢাকা থেকে তো নাই-ই।
য্ইা হোক চাষাড়ায় বড় ভাই ইশতিয়াক আহমেদের বাড়ি। সেহেতু একটু আয়োজন করেই রওনা দিলাম। পরিকল্পনা করলাম আগের সারা রাত ইশতিয়াক ভাইয়ের বাসায় আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে সকালে সূর্যগ্রহণ দেখে ঢাকায় ফিরবো। মঙ্গলবার রাতে রওনা দিলাম রাত দশটায় গুলিস্তান থেকে। সঙ্গে পিয়াস মজিদ এবং আপেল মাহমুদ। ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে ইশতিয়াক ভাইয়ের সঙ্গে কোন বাসে উঠবো কোথায় নামবো কোথায় অপেক্ষা করবো সব ইশতিয়াক ভাই জানাচ্ছেন ফোনে ফোনে। বাসে উঠলাম গুলিস্তান থেকে বাস এসে থামলো নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায়। বাসের হেল্পার দরজায় দাড়িয়েগলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘ওস্তাদ গাড়ি থামবো, চাষাড়া নামবো...’
শুনে মনে হল এই এলাকায় যারা নামবে তারা সব চাষা (কৃষক)। নেমে ইশতিয়াক ভাই বর্ণিত স্থানে দাড়িয়ে তাকে ফোন করলাম। তিনি জানালেন দুই মিনিটেই আসছেন। দেশে এখন ডিজিটাল সময় চলে, সেই সময়ের হিসাব কার কাছে কী জানি না। কারণ ইতিয়াক ভাইয়ের দুই মিনিট শেষ হতে হতে অপেক্ষার সকল সৌন্দর্য্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি এসে বিগলিত হাসি দিয়ে এমন অভ্যর্থনা জানালেন যেতার দেরির কথা স্বেচ্ছায়ই ভুলে গেলাম। অতঃপর শহীদ মিনারে গিয়ে নাস্তা, স্থানীয় সাংবাদিক ইউনিয়নের অফিসে গিয়ে সবুজ ভাই আর শাওন ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা শেষ করে যখন ইশতিয়াক ভাইয়ের বাসায় পৌছলাম তখন মধ্যরাত। সারারাত না ঘুমানোর পরিকল্পনা থাকলেও ইশতিয়াক ভাই বারবার হুমকি দিতে লাগলেন, আমি কিন্তু ঘুমায়া পড়–ম। তোমরা আড্ডা দিতে থাকো।
কবি পিয়াস ঘুমে ঢলে পড়তে পড়তে বারবার বললেন, আরে এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে হবে নাকি??
আপেল মাহমুদ কিছুক্ষণ আগে খুব একচোট খেয়েদেয়ে এখন চুপচাপ বসে আছেন। যে যা বলুক এখন তিনি তাই করতে রাজি আছেন। যাই হোক ঘুমানো হবে কী হবে না এই হিসাব নিকাশ করতে করতেই রাত কেটে গেল। সকাল ছয়টা ঊনষাট মিনিটে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। আমরা সাড়ে ছয়টার দিকে শহীদ মিনারের দিকে রওনা দিলাম। শহীদ মিনারে এসে তো মাথা খারাপ। কেউ নেই। হায় হায়! সূর্যগ্রহণ কী তাহলে শেষ? এখন কী হবে? আমি ব্যাপক চিন্তিত। আপেল মাহমুদ এবং পিয়াস মজিদও দেখলাম চিন্তিত। ইশতিয়াক ভাই নির্বিকার। সূর্যগ্রহণ মিস হয়ে গেল নাকি আমি তা নিয়ে আশঙ্কায় আছি, এর মধ্যে ইশতিয়াক ভাই বললেন, চলো নাস্তাগ্রহণটা আগে কইরা আসি।
আপেল মাহমুদ দেখলাম এই বিষয়েও সম্মত। তার ভাবটা এমন যে গ্রহণ হলেই হল। সেটা সূর্য গ্রহণ বা নাস্তা গ্রহণ একটা হলেই হল। যাই হোক নাস্তা খেয়ে আবার শহীদ মিনারে চলে এলাম। এবার দেখা গেল আয়োজকদের মধ্যে কয়েকজনকে। সেই সঙ্গে কিছু স্কুল ড্রেস পরা মেয়েকে। বাংলাদেশে যে কোন আয়োজনেই এই স্কুল পড়–য়াদের বিশাল গ্যাঞ্জাম পোহাতে হয়। মন্ত্রী আসবেন তাদের ধরে এনে রাস্তার পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখা হয় অভ্যার্থনা জানানোর জন্য। টীকা দান কর্মসূচীর উদ্বোধন হবে ধরে আনা হয় তাদের টীকা দিয়ে উদ্বোধন করা হয়। এবার সূর্যগ্রহণ হবে সেখানেও তারা তাদের দিয়ে দেখানোর মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হবে!
ঘুম ঘুম চোখে স্কুল পড়–য়ারা দাড়িয়ে আছে। আছে আরো অনেকে। সবাই দাড়িয়ে আছে অধীর আগ্রহে। কিন্তু সূর্যতো দেখা যাচ্ছে না। কারণ আকাশ ঢেকে আছে মেঘে। এখন কী হবে। সময় বয়ে যাচ্ছে। একটু পরে দেখা গেল সবুজ ভাইকে। সপরিবারে এসেছেন তিনি। এর মধ্যে কয়েকজনকে দেখা গেল আয়োজকদের বরাদ্দকৃত বিশেষ সানগ্লাস নিয়ে আকাশের এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এক লোককে দেখলাম দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছন গ্রহণ দেখতে। চোখে সানগ্লাস দিয়ে তিনি কী দেখে তাড়াতাড়ি গ্লাস খুলে ছেলের চোখে দিয়ে বললেন, ওই দেখ। ওই দেখ। ছেলেকে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, আব্বা কিছু তো দেখি না।
সঙ্গে সঙ্গে বাবা ছেলের মাথায় বিশাল এক গাট্টা মেরে ধমকাতে লাগলেন। যেন ছেলে কিছু দেখতে না পেয়ে বিশাল ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু যাই হোক আকাশ থেকে তো মেঘ সরছে না। এখন কী করা? আয়োজকদের দেখা গেল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরি করতে। আকাশের এমন আচরণে তারা বিব্রত। আমার তো মন মেজাজ বিশাল খারাপ। পিয়াস চুপচাপ। আপেল নির্বিকার। ইশতিয়াক ভাই মিটিমিটি হাসছেন আমাদের অবস্থা দেখে। আকাশের মেঘ সরছে না। গ্রহণের সময় শেষ। একে একে সবাই চলে যেতে লাগলেন। গ্রহণ দেখা গেল না এখন কী করা? ভাবলাম একটা বিশেষ সানগ্লাস কিনে নিয়ে যাই, চাপা মারা যাবে। কিন্তু বিধিবাম। চশমা নাকি বিক্রি করার জন্য নয়। মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। এর মধ্যে হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, পঞ্চগড়ে বিষ্টি নামছে রে, ওইখানে কিছুই দেখা যায় নাই। এই বার্তা শুনে খারাপ মন অতীব ভাল হয়ে গেল। নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে হল। আমি না হয় নারায়ণগঞ্জ এসে দেখতে পারি নাই। তার উপর আবার আসার খরচ পিয়াসের। কোন খরচই নাই। আর যারা পঞ্চগড় গেছে তাদের তো অনেক টাকা লস। অন্যের লসের কথা ভেবে শত বর্ষের শেষ সূর্যগ্রহণ দেখা মিস করেও ব্যাপক খুশি মনে রওনা দিলাম ঢাকার পথে। সূর্য আমাকে গ্রহণ করল না। তবুও শান্তি। আমার যে বন্ধুরা গেছে দেখতে ওরাও তো দেখতে পারে নাই।
তবে সেই সুখ অবশ্য ঢাকায় পৌঁছানোর পরই ধ্বংস হয়ে গেল। পঞ্চগড় থেকে এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলল, ‘দোস্তরে যা দেখলাম না! অবিশ্বাস্য!’
আমার কাছেও অবিশ্বাস্যই মনে হল। জানতে চাইলাম, ‘ওখানে না বিষ্টি ছিল, দেখলি কেমনে?’
‘আরে ব্যাটা বিষ্টি তো অল্প সময় ছিল। তারপর থাইমা গেছে। তুই দেখছস???’
আমি তার এই প্রশ্ন শুনে নিজের দুঃখ চাপা রেখে খুব ভাব নিয়ে বললাম, ‘ধুর ব্যাটা আমার এইসব আজাইরা সময় নাই। কাজ- টাজ নিয়া ব্যাপক ব্যস্ত থাকি। সূর্য দেখার সময় কই???’
ছবি ক্যাপশন : সূর্যের কাছে প্রত্যাখ্যাত আমরা তিনজন!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৮:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




