শাকিল সরকার: দেশে এখন অ্যানথ্রাক্স’র সংক্রমণ ঘটছে। এর আগে সোয়াইন ফু, বার্ড ফু ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছিল। বার্ড ফুর সংক্রমণে দেশের পোলট্রিশিল্পে বিপর্যয় ঘটায়। মানুষের মধ্যে পাখির রোগ ছড়াতে পারে- এ আশঙ্কা ছিল। সোয়াইন ফুতে আক্রান্ত হন দেশের সাড়ে ৪ লাখ মানুষ। মাঝে নিপা ভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিলেন দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা। নিপা ভাইরাস ছড়ায় বাদুড়ে। এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু মানুষ অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণের শিকার হওয়ার পর এ নিয়ে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পত্রিকা এ দেশে সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার খবর ছেপেছে সম্প্রতি। এভাবে প্রতি আট মাস পর একটি নতুন রোগ দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। রোগগুলো আতঙ্কিত করে তুলছে আক্রান্তদের পাশাপাশি দেশের অনেককে। এসব রোগ প্রতিরোধে সরকারের নেই কার্যকর ব্যবস্থা। প্রতিরোধের জন্য সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। এই রোগ মানুষ ও গবাদিপশুতে বাড়ন্ত পর্যায় (ভেজিটেটিভ) ও স্পোর গঠন করে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্পোর গঠনে ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস রোগের জীবাণু শক্ত আবরণ তৈরি করে। এই ব্যাক্টেরিয়া অধিক সময় ধরে বেঁচে থাকে। অনেক সময় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও মারা যায় না। তবে এই রোগ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়। শরীরের যে জায়গায় এই ব্যাক্টেরিয়াটি লাগে সেখানে পচন পর্যন্ত ধরে যায়। রোগে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি আট মাসে নতুন একটি রোগে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষকেরা বলছেন, মনুষ্য প্রজাতি গত ২৫ বছরে ৩৫টি নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, মানুষের অতিমাত্রায় বিশ্ব ভ্রমণের কারণে সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, মেক্সিকোতে সোয়াইন ফুর সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়ল। মেক্সিকো থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ১৪ হাজার মাইল, কিন্তু সোয়াইন ফুর সংক্রমণে বাংলাদেশে মানুষের মারা যেতে ১৪ সপ্তাহ সময় লাগেনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। অ্যানথ্রাক্সের ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে যে হঠাৎ সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশ প্রস্তুত নয়।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, অ্যানথ্রাক্স সারা বিশ্বেই হয়ে থাকে। তিন ধরনের অ্যানথ্রাক্স রোগ হয়ে থাকে; এগুলো হয় শ্বাসনালীতে, পেটের মধ্যে এবং শরীরের চামড়ায়। এর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ অ্যানথ্রাক্স রোগ হয় চামড়াতে। তিনি বলেন, এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। গবাদিপশুর দেহে অ্যানথ্রাক্স রোগ হয়ে থাকে। গবাদিপশু থেকেই মানুষের মধ্যে ছড়ায়। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত অসুস্থ গবাদিপশু জবাই করা হলে তার রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এলে এই রোগ ছড়াতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর ত্বকে ত, ঘা, বিষফোড়া দেখা দেয়। অ্যানথ্রাক্স হলে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা করা না হলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, অসুস্থ গবাদিপশু জবাই করা যাবে না। সুস্থ গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স রোগ থেকে বাঁচানোর জন্য টিকা দিতে হবে। এই টিকার মূল্য মাত্র ৫০ পয়সা। প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে টিকা সংগ্রহ করা যাবে। এছাড়া স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মীদের সঙ্গে যোগযোগ করলেও এই টিকা পাওয়া যাবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গবাদিপশুর মৃতদেহ মাটিতে গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। আর সচেতনতার জন্য গবাদিপশুতে অ্যানথ্রাক্স রোগের লণ দেখা দিলে দ্রুত উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। মানুষের শরীরে এই উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই রোগে আক্রান্ত হলে জ্বরসহ ঠোঁট, মুখ কালো হয়ে যেতে পারে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে চিকিৎসা নিতে হবে।
ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, অ্যানথ্রাক্স রোগ মানুষ ও গবাদিপশুতে বাড়ন্ত পর্যায় (ভেজিটেটিভ) ও স্পোর গঠন করে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্পোর গঠনে ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস রোগের জীবাণু শক্ত আবরণ তৈরি করে। এ আবরণটি ৪০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকে। এ আবরণ পরে বিভিন্নভাবে মানুষ ও গবাদিপশুতে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আরও জানান, অ্যানথ্রাক্স মানুষের জন্য কোন সংক্রামক রোগ নয়। এটি শুধুমাত্র আক্রান্ত পশুর মাংস বা রক্ত ছোঁয়ার কারণে হতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত এলাকার মাটি বা ঘাস থেকেও হতে পারে। পশু ঘাস খায় বলে তাদের সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে মানুষের শরীরে ‘ফোসকা’ -জাতীয় ঘায়ের মতো হতে পারে। এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনে এ ঘা দূর হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব এ প্রসঙ্গে বলেন, অ্যানথ্রাক্সসহ আরও কিছু রোগের জীবাণু ছড়াচ্ছে পশু প্রাণীর মাধ্যমে। পশুকে টিকা দেয়ার দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নয়। এ দায়িত্ব অন্য মন্ত্রণালয়ের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এরকম অন্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় না থাকায় রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। রোগগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সরকারের উদ্যোগ তেমন নেই। আর প্রতিরোধের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধাও নেই।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদা আখতার বলেন, বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান রোগ ছাড়ানোর আগে গবেষণা করে রোগগুলো সম্পর্কে বলে দিচ্ছে। তাদের গবেষণার জন্য রোগের জীবাণুগুলো আমদানি হচ্ছে কিনা, এ প্রশ্নও আসছে। তিনি বলেন, অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গরুর মধ্যে বিদেশ থেকে আনা গরুর সংখ্যা বেশি। তাই বিদেশ থেকে গরু বা অন্য প্রাণীর আমদানির বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত। সতর্কতাই এখানে রোগটির প্রতিরোধের উপায়।
এদিকে অ্যানথ্রাক্স রোগ নিয়ে আতঙ্কিত না হতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি বলেন, বিষয়টি সরকার খুব ভালভাবে পর্যবেণ করছে। এ রোগের পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সরকারের কাছে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে তা সব জায়গায়ই পৌঁছানো হবে। এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করলে তা মোকাবেলার সামর্থ্যও সরকারের রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেখা দেয় নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ( আইইডিসিআর) গবেষণা মতে, দেশে আইটি নিপা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ভাইরাস ছড়ায়। তাতে ফরিদপুর, রংপুর ও রাজশাহী এলাকার মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আট মাস পর এখন ছড়াচ্ছে অ্যানথ্রাক্স (তড়কা)। দেশের বিভিন্ন জেলায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-এর (আইসিডিডিআরবি) ‘স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বার্তা’ ম্যাগাজিনের ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সংখ্যায় বলা হয়, অ্যানথ্রাক্স মারাত্মক সংক্রামক রোগ- যা ‘স্পোর-ফরমিং ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস’ জীবাণু দিয়ে সংঘটিত হয়। এ জীবাণু পশু থেকে মানুষে আর মানুষ থেকে পশুতে সংক্রমণ ঘটাতে সম। ফলে সংক্রামিত হচ্ছে এ রোগ। ২০০৯ সালের ১৮ জুনে প্রথম দেখা দেয় সোয়াইন ফু। ২০০৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত আইসিডিডিআরবি-এর ওই ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন মতে, ১৮ জুন থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে এ রোগে আক্রান্ত হয় ৪ লাখ ৫৬ হাজার জন। গত বছরের ৩০ আগস্ট এ রোগে একজনের মৃত্যুও হয়। এর আগে দেশজুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে বার্ড ফু। তার আগে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর ‘নিউ দিল্লি মেটালো-১’ সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে বিশ্বের সব মানুষকে সম্প্রতি সতর্ক করেছেন ব্রিটেনের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তারা ব্রিটেন, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন বলে দাবি করেন। তাদের মতে, এ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। এটা দ্রুতগতিতে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ, ডেইলি মেইল ও চিকিৎসাবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘লোসেট’সহ আন্তর্জাতিক অন্য পত্রিকায় এ খবর প্রায় ১৫ দিন আগে ছাপা হয়। ওই খবরে বাংলাদেশে ব্যাকটেরিয়াটির অস্তিত্ব বা সন্ধান সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। এর বিস্তারের কথা সরকারিভাবে এখনও স্বীকার করা হচ্ছে না। এ ব্যাকটেরিয়া মূলত হাসপাতালকেন্দ্রিক। তবে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি-এর যৌথ অনুসন্ধানে এ দেশে হাসপাতালকেন্দ্রিক ইনফুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে।
নতুন রোগ আসছে : রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক উলহাউস ২৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এই সময়ে মানুষ ৩৮টি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগ আগে মানুষের মধ্যে ছিল না। এসব রোগের ৭৫ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু ও পশু-পাখি থেকে। আমেরিকান ভেটেরিনারি মেডিকেল কলেজ তাদের প্রকাশনায় বলেছে, প্রতি আট মাসে পৃথিবীতে একটি করে নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটতে পারে এবং জীবজন্তু ও পশু-পাখির রোগ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বাস্তব। ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, বন উজাড় বা অন্য আরও অনেক কারণে জীবজন্তু ও পশু-পাখির আবাসন নষ্ট হওয়ায় নতুন রোগ আসছে। আবার বাণিজ্যিক কৃষিখামারের কারণেও নতুন রোগের উদ্ভব হচ্ছে। এগুলোর কিছু ঢুকে পড়েছে মানুষ্য প্রজাতিতে।
সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার নিয়ে পর্যালোচনা করেছে (গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস: এ রিভিউ অব দ্য লিংকেজ)। তাতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ৩০টি নতুন ও পুরোনো রোগ ‘নতুনভাবে’ আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, বড় বড় বাঁধ নির্মাণ, বন উজাড় হওয়া, বিস্তীর্ণ ভূমি ন্যাড়া হওয়া- এসব কারণে (সিলেকটিভ অ্যাডভান্টেজ) রোগের অবির্ভাবে হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, ঘনবসতি ও বিশ্বব্যাপী মানুষের চলাচল বৃদ্ধি সংক্রমণ বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬৫০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। আর ২০০৭ সালে গ্রামের চেয়ে শহরের জনসংখ্যা বেশি হয়ে যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে বিমানে বছরে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এক শহর থেকে অন্য শহর, এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি যেকোনো সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সহায়ক। তিনি আরও বলেন, সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকাটা জরুরি। তিনি দুটি বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেন। প্রথমত ব্যবস্থাপনা; এবং চিকিৎসকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিণ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, মানুষকে দ্রুত সচেতন করার জন্য প্রস্তুত থাকা।
প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় : আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন রোগে প্রতিহত, প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি (২০০৫) গৃহীত হয় এবং ২০০৭ সালের জুন থেকে তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বিধি বাস্তবায়ন করার জন্য তাতে স্বার করেছে। বিধি মোতাবেক সদস্য দেশগুলো অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল প্রশিণ ও আইন তৈরির েেত্র কী পদপে নিয়েছে তা ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানাতে হবে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫ কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা মূল্যায়ন করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রবেশদ্বারগুলোতে (পয়েন্ট অব এন্ট্রি) রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই। দেশে ইনফুয়েঞ্জা, পোলিও ও নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ নিরূপণের জন্য নির্দেশিকা ও জাতীয় কৌশলপত্র আছে। রোগের উপাত্ত ব্যবস্থাপনাপদ্ধতি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যথেষ্ট ভালো, কিন্তু জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্বল। এসব েেত্র অর্থ বরাদ্দ ও প্রশিতি জনবল কম। দেশের প্রবেশদ্বারগুলোতে (পয়েন্ট অব অ্যান্ট্রি) বিদেশি যাত্রীদের রোগ নির্ণয়ের অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নেই। স্থলবন্দরগুলোতে নেই চিকিৎসকদের বসার জায়গা, নেই পর্যাপ্ত লোকবল। আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মাহমুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রবেশদ্বারগুলোতে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী রোগ পরীার ব্যবস্থা জোরদার হয়নি। অনেক প্রবেশদ্বারের আশপাশ এলাকাতেও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। তবে বিধি অনুযায়ী কিছু ব্যবস্থা সরকার এরই মধ্যে নিয়েছে।
আমদানিকৃত পশু পরীা করানোর যথাযথ ব্যবস্থাও এ দেশে নেই। আইইডিসিআর বলছে, পশুদের টিকা দিয়েই অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ সম্ভব। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব মতে, দেশের গৃহপালিত পশুর জন্য মোট ৯ কোটি অ্যানথ্রাক্স টিকা দরকার। অথচ সরকারিভাবে উৎপাদিত হয় মাত্র ১৫ লাখ টিকা। বাকিগুলোর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। পশুপাখি থেকে এভাবে রোগ ছড়িয়ে পড়া এবং ছড়ানোর হুমকি থাকলেও এ নিয়ে গবেষণার বিষয়টিও সরকারের কাছে অবহেলিত। গবেষণার জন্য সরকারের একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পশুবাহিত মানুষের রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. এস এন সিদ্দিক একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। এসব রোগ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন না। অথচ তাকে এ বিভাগের প্রধান করে মতাসীন সরকার। তাতে বিভাগটিতে এসব রোগ সম্পর্কে গবেষণা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে।
প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগের ঝুঁকি :
প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়
শাকিল সরকার: দেশে এখন অ্যানথ্রাক্স’র সংক্রমণ ঘটছে। এর আগে সোয়াইন ফু, বার্ড ফু ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছিল। বার্ড ফুর সংক্রমণে দেশের পোলট্রিশিল্পে বিপর্যয় ঘটায়। মানুষের মধ্যে পাখির রোগ ছড়াতে পারে- এ আশঙ্কা ছিল। সোয়াইন ফুতে আক্রান্ত হন দেশের সাড়ে ৪ লাখ মানুষ। মাঝে নিপা ভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিলেন দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা। নিপা ভাইরাস ছড়ায় বাদুড়ে। এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু মানুষ অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণের শিকার হওয়ার পর এ নিয়ে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পত্রিকা এ দেশে সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার খবর ছেপেছে সম্প্রতি। এভাবে প্রতি আট মাস পর একটি নতুন রোগ দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। রোগগুলো আতঙ্কিত করে তুলছে আক্রান্তদের পাশাপাশি দেশের অনেককে। এসব রোগ প্রতিরোধে সরকারের নেই কার্যকর ব্যবস্থা। প্রতিরোধের জন্য সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। এই রোগ মানুষ ও গবাদিপশুতে বাড়ন্ত পর্যায় (ভেজিটেটিভ) ও স্পোর গঠন করে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্পোর গঠনে ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস রোগের জীবাণু শক্ত আবরণ তৈরি করে। এই ব্যাক্টেরিয়া অধিক সময় ধরে বেঁচে থাকে। অনেক সময় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও মারা যায় না। তবে এই রোগ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়। শরীরের যে জায়গায় এই ব্যাক্টেরিয়াটি লাগে সেখানে পচন পর্যন্ত ধরে যায়। রোগে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি আট মাসে নতুন একটি রোগে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষকেরা বলছেন, মনুষ্য প্রজাতি গত ২৫ বছরে ৩৫টি নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, মানুষের অতিমাত্রায় বিশ্ব ভ্রমণের কারণে সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, মেক্সিকোতে সোয়াইন ফুর সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়ল। মেক্সিকো থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ১৪ হাজার মাইল, কিন্তু সোয়াইন ফুর সংক্রমণে বাংলাদেশে মানুষের মারা যেতে ১৪ সপ্তাহ সময় লাগেনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। অ্যানথ্রাক্সের ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে যে হঠাৎ সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশ প্রস্তুত নয়।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, অ্যানথ্রাক্স সারা বিশ্বেই হয়ে থাকে। তিন ধরনের অ্যানথ্রাক্স রোগ হয়ে থাকে; এগুলো হয় শ্বাসনালীতে, পেটের মধ্যে এবং শরীরের চামড়ায়। এর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ অ্যানথ্রাক্স রোগ হয় চামড়াতে। তিনি বলেন, এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। গবাদিপশুর দেহে অ্যানথ্রাক্স রোগ হয়ে থাকে। গবাদিপশু থেকেই মানুষের মধ্যে ছড়ায়। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত অসুস্থ গবাদিপশু জবাই করা হলে তার রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এলে এই রোগ ছড়াতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর ত্বকে ত, ঘা, বিষফোড়া দেখা দেয়। অ্যানথ্রাক্স হলে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা করা না হলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, অসুস্থ গবাদিপশু জবাই করা যাবে না। সুস্থ গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স রোগ থেকে বাঁচানোর জন্য টিকা দিতে হবে। এই টিকার মূল্য মাত্র ৫০ পয়সা। প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে টিকা সংগ্রহ করা যাবে। এছাড়া স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মীদের সঙ্গে যোগযোগ করলেও এই টিকা পাওয়া যাবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গবাদিপশুর মৃতদেহ মাটিতে গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। আর সচেতনতার জন্য গবাদিপশুতে অ্যানথ্রাক্স রোগের লণ দেখা দিলে দ্রুত উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। মানুষের শরীরে এই উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই রোগে আক্রান্ত হলে জ্বরসহ ঠোঁট, মুখ কালো হয়ে যেতে পারে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে চিকিৎসা নিতে হবে।
ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, অ্যানথ্রাক্স রোগ মানুষ ও গবাদিপশুতে বাড়ন্ত পর্যায় (ভেজিটেটিভ) ও স্পোর গঠন করে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্পোর গঠনে ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস রোগের জীবাণু শক্ত আবরণ তৈরি করে। এ আবরণটি ৪০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকে। এ আবরণ পরে বিভিন্নভাবে মানুষ ও গবাদিপশুতে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আরও জানান, অ্যানথ্রাক্স মানুষের জন্য কোন সংক্রামক রোগ নয়। এটি শুধুমাত্র আক্রান্ত পশুর মাংস বা রক্ত ছোঁয়ার কারণে হতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত এলাকার মাটি বা ঘাস থেকেও হতে পারে। পশু ঘাস খায় বলে তাদের সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে মানুষের শরীরে ‘ফোসকা’ -জাতীয় ঘায়ের মতো হতে পারে। এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনে এ ঘা দূর হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব এ প্রসঙ্গে বলেন, অ্যানথ্রাক্সসহ আরও কিছু রোগের জীবাণু ছড়াচ্ছে পশু প্রাণীর মাধ্যমে। পশুকে টিকা দেয়ার দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নয়। এ দায়িত্ব অন্য মন্ত্রণালয়ের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এরকম অন্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় না থাকায় রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। রোগগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সরকারের উদ্যোগ তেমন নেই। আর প্রতিরোধের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধাও নেই।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদা আখতার বলেন, বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান রোগ ছাড়ানোর আগে গবেষণা করে রোগগুলো সম্পর্কে বলে দিচ্ছে। তাদের গবেষণার জন্য রোগের জীবাণুগুলো আমদানি হচ্ছে কিনা, এ প্রশ্নও আসছে। তিনি বলেন, অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গরুর মধ্যে বিদেশ থেকে আনা গরুর সংখ্যা বেশি। তাই বিদেশ থেকে গরু বা অন্য প্রাণীর আমদানির বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত। সতর্কতাই এখানে রোগটির প্রতিরোধের উপায়।
এদিকে অ্যানথ্রাক্স রোগ নিয়ে আতঙ্কিত না হতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি বলেন, বিষয়টি সরকার খুব ভালভাবে পর্যবেণ করছে। এ রোগের পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সরকারের কাছে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে তা সব জায়গায়ই পৌঁছানো হবে। এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করলে তা মোকাবেলার সামর্থ্যও সরকারের রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেখা দেয় নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ( আইইডিসিআর) গবেষণা মতে, দেশে আইটি নিপা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ভাইরাস ছড়ায়। তাতে ফরিদপুর, রংপুর ও রাজশাহী এলাকার মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আট মাস পর এখন ছড়াচ্ছে অ্যানথ্রাক্স (তড়কা)। দেশের বিভিন্ন জেলায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-এর (আইসিডিডিআরবি) ‘স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বার্তা’ ম্যাগাজিনের ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সংখ্যায় বলা হয়, অ্যানথ্রাক্স মারাত্মক সংক্রামক রোগ- যা ‘স্পোর-ফরমিং ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস’ জীবাণু দিয়ে সংঘটিত হয়। এ জীবাণু পশু থেকে মানুষে আর মানুষ থেকে পশুতে সংক্রমণ ঘটাতে সম। ফলে সংক্রামিত হচ্ছে এ রোগ। ২০০৯ সালের ১৮ জুনে প্রথম দেখা দেয় সোয়াইন ফু। ২০০৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত আইসিডিডিআরবি-এর ওই ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন মতে, ১৮ জুন থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে এ রোগে আক্রান্ত হয় ৪ লাখ ৫৬ হাজার জন। গত বছরের ৩০ আগস্ট এ রোগে একজনের মৃত্যুও হয়। এর আগে দেশজুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে বার্ড ফু। তার আগে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর ‘নিউ দিল্লি মেটালো-১’ সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে বিশ্বের সব মানুষকে সম্প্রতি সতর্ক করেছেন ব্রিটেনের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তারা ব্রিটেন, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন বলে দাবি করেন। তাদের মতে, এ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। এটা দ্রুতগতিতে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ, ডেইলি মেইল ও চিকিৎসাবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘লোসেট’সহ আন্তর্জাতিক অন্য পত্রিকায় এ খবর প্রায় ১৫ দিন আগে ছাপা হয়। ওই খবরে বাংলাদেশে ব্যাকটেরিয়াটির অস্তিত্ব বা সন্ধান সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। এর বিস্তারের কথা সরকারিভাবে এখনও স্বীকার করা হচ্ছে না। এ ব্যাকটেরিয়া মূলত হাসপাতালকেন্দ্রিক। তবে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি-এর যৌথ অনুসন্ধানে এ দেশে হাসপাতালকেন্দ্রিক ইনফুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে।
নতুন রোগ আসছে : রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক উলহাউস ২৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এই সময়ে মানুষ ৩৮টি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগ আগে মানুষের মধ্যে ছিল না। এসব রোগের ৭৫ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু ও পশু-পাখি থেকে। আমেরিকান ভেটেরিনারি মেডিকেল কলেজ তাদের প্রকাশনায় বলেছে, প্রতি আট মাসে পৃথিবীতে একটি করে নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটতে পারে এবং জীবজন্তু ও পশু-পাখির রোগ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বাস্তব। ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, বন উজাড় বা অন্য আরও অনেক কারণে জীবজন্তু ও পশু-পাখির আবাসন নষ্ট হওয়ায় নতুন রোগ আসছে। আবার বাণিজ্যিক কৃষিখামারের কারণেও নতুন রোগের উদ্ভব হচ্ছে। এগুলোর কিছু ঢুকে পড়েছে মানুষ্য প্রজাতিতে।
সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার নিয়ে পর্যালোচনা করেছে (গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস: এ রিভিউ অব দ্য লিংকেজ)। তাতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ৩০টি নতুন ও পুরোনো রোগ ‘নতুনভাবে’ আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, বড় বড় বাঁধ নির্মাণ, বন উজাড় হওয়া, বিস্তীর্ণ ভূমি ন্যাড়া হওয়া- এসব কারণে (সিলেকটিভ অ্যাডভান্টেজ) রোগের অবির্ভাবে হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. মো. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, ঘনবসতি ও বিশ্বব্যাপী মানুষের চলাচল বৃদ্ধি সংক্রমণ বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬৫০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। আর ২০০৭ সালে গ্রামের চেয়ে শহরের জনসংখ্যা বেশি হয়ে যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে বিমানে বছরে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এক শহর থেকে অন্য শহর, এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি যেকোনো সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সহায়ক। তিনি আরও বলেন, সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকাটা জরুরি। তিনি দুটি বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেন। প্রথমত ব্যবস্থাপনা; এবং চিকিৎসকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিণ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, মানুষকে দ্রুত সচেতন করার জন্য প্রস্তুত থাকা।
প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় : আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন রোগে প্রতিহত, প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি (২০০৫) গৃহীত হয় এবং ২০০৭ সালের জুন থেকে তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বিধি বাস্তবায়ন করার জন্য তাতে স্বার করেছে। বিধি মোতাবেক সদস্য দেশগুলো অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল প্রশিণ ও আইন তৈরির েেত্র কী পদপে নিয়েছে তা ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানাতে হবে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫ কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা মূল্যায়ন করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রবেশদ্বারগুলোতে (পয়েন্ট অব এন্ট্রি) রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই। দেশে ইনফুয়েঞ্জা, পোলিও ও নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ নিরূপণের জন্য নির্দেশিকা ও জাতীয় কৌশলপত্র আছে। রোগের উপাত্ত ব্যবস্থাপনাপদ্ধতি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যথেষ্ট ভালো, কিন্তু জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্বল। এসব েেত্র অর্থ বরাদ্দ ও প্রশিতি জনবল কম। দেশের প্রবেশদ্বারগুলোতে (পয়েন্ট অব অ্যান্ট্রি) বিদেশি যাত্রীদের রোগ নির্ণয়ের অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নেই। স্থলবন্দরগুলোতে নেই চিকিৎসকদের বসার জায়গা, নেই পর্যাপ্ত লোকবল। আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মাহমুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রবেশদ্বারগুলোতে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী রোগ পরীার ব্যবস্থা জোরদার হয়নি। অনেক প্রবেশদ্বারের আশপাশ এলাকাতেও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। তবে বিধি অনুযায়ী কিছু ব্যবস্থা সরকার এরই মধ্যে নিয়েছে।
আমদানিকৃত পশু পরীা করানোর যথাযথ ব্যবস্থাও এ দেশে নেই। আইইডিসিআর বলছে, পশুদের টিকা দিয়েই অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ সম্ভব। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব মতে, দেশের গৃহপালিত পশুর জন্য মোট ৯ কোটি অ্যানথ্রাক্স টিকা দরকার। অথচ সরকারিভাবে উৎপাদিত হয় মাত্র ১৫ লাখ টিকা। বাকিগুলোর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। পশুপাখি থেকে এভাবে রোগ ছড়িয়ে পড়া এবং ছড়ানোর হুমকি থাকলেও এ নিয়ে গবেষণার বিষয়টিও সরকারের কাছে অবহেলিত। গবেষণার জন্য সরকারের একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পশুবাহিত মানুষের রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. এস এন সিদ্দিক একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। এসব রোগ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন না। অথচ তাকে এ বিভাগের প্রধান করে মতাসীন সরকার। তাতে বিভাগটিতে এসব রোগ সম্পর্কে গবেষণা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




