ব্যাপারটা যে কাউকে বিশ্বাস করানো আসলেই কঠিন। ৭.১৫ থেকে ৮.১৫ এই এক ঘন্টায় ৬৮ বার কল করা। অতঃপর যার জন্য এই কল তার সম্বিত ফিরে আসা এবং জানানো, হুম আমি ঘুম থেকে উঠেছি। জানিনা কোন ধৈয্য বলে টানা একঘন্টা এভাবে কল করে যাওয়া সম্ভব, যেখানে কল ধরতে কেউ একটু দেরী করলেই আমার মেজাজ খিচড়ে যায়। আর কি অবলিলায় আম্মু প্রতিদিন এই কাজটি করে চলেছেন।
I am not lazy , i just rest before i get tired !!!
আমার মোবাইলের ওয়াল পেপার। বন্ধুদের ধারনা এই ওয়াল পেপারটা শুধুই আমার মোবাইলে মানায়। টানা অনেক রাত পর্যন্ত যেগে থাকা আমার জন্য কোন ব্যাপারই না। কিন্তু একবার যদি ঘুমিয়ে পড়ি তো সব শেষ। উত্তর কোরিয়ার মিসাইল কোন সাগরে পড়ল আর কত গুলা ট্রেন আমার জানালার পাশ দিয়ে গেল তাতে কি আসে যায়। তাই আমার রেষ্ট মানেই হারিয়ে যাওয়া। ঘুমটা কিছুটা ঐতিহ্যও বটে।আমার দাদীর কাছ থেকে পাওয়া। মনে পড়ে ছোট বেলায় আমার দাদা পানের বোঁটা হাতে দিয়ে বলত এটা তোর দাদীর নাকে ঢ়ুকিয়ে দে।দিয়েই ভোঁ দৌড়।সে এক মজার খেলা। তাই ঘুম নিয়ে আমি কি করতে পারি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গুনের সাথেত যুদ্ধ করা যায়না
আর এই গুনের যন্ত্রনা ভোগ করে চলেছেন আমার মা। মাঝে মাঝে অবাক হই কি করে ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোরে উঠে ফুটবল খেলতাম। এই গুনের বহিঃপ্রকাশ ৬ষ্ঠ শ্রেনী থেকে। দাঁত মাজতে মাজতে সোফায় ঘুমিয়ে পড়া দিয়ে শুরু। নাস্তা বানাতে বসেও আম্মুর শান্তি নাই।আমি যাতে ঘুমিয়ে না পড়ি সে পাহারাও দিতে হত।
ইন্টার থেকে শুরু হয় গভীর রাত অবধি জেগে থেকে পড়ার প্রবনতা।একঘন্টা পরপর আম্মু এসে দেখত জেগে আছি কিনা। নিত্য নতুন খাদ্যের ফরমূলা খুঁজতাম। কোনটা খেলে ঘুম চলে যাবে। এর মধ্যে নুডলস এতই হিট করল যে আমার অল টাইম ফেভারিট মেন্যু হয়ে গেল। আর বাসার ফ্রিজে নুডলস স্হায়ী আসন পেয়ে গেল। আম্মুত আছেনই সো ফ্রিজে নুডলস থাকবেই।এখনও বাসায় গেলে নুডলস কমন আইটেম। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত আবিষ্কার ছিল রাত একটাই ওরস্যালাইন টি। আম্মু একটার দিকে শেষ চা বানিয়ে দিতেন।আর আমি তাতে লবণ মিশিয়ে নিতাম। ফলাফল কি হয়েছে জানিনা তবে পরিণতি হচ্ছে আমার এখন দিনে ঘুমাতেই বেশী ভাল লাগে। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই চায়না।
আমার বাংলা হাতের লিখা যাদুঘরে স্হান পাবার যোগ্যতা রাখে। আব্বু বলেন তোর মায়ের হাতের লিখার আশপাশ দিয়ে হাঁটতে পারলে তোর লিখাও হত দেখার মতন। শুরু হল আম্মুর নতুন যন্ত্রনা। একাধারে আম্মু, , ছিলেন আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা (মায়ের বদৌলতে স্কুলে শিক্ষক কমন রুমের সব নাস্তার ভাগ জুটত আমার ) , নতুন দায়িত্ব নিলেন আমার ব্যাবহারিক খাতার লেখক। ইন্টার পর্যন্ত সব খাতায় আম্মুর লেখা।
এ জীবনে যত মিথ্যা কথা বলেছি তার ৯৫ ভাগ ই আব্বু আম্মুর সাথে।বিশ্বাস এই যে আর যায় হউক তারাত ক্ষমা করে দিবেন। ইন্টারের পরে বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম কক্সবাজার যাব। কিন্তু এই মৃত্যু কূপে বাসা থেকেত যেতে দিবেনা।আর তাই মিথ্যার আশ্রয়। আমি আর মিঠু বললাম ওলীর গ্রামের বাড়ী যাব।রাজু ও কি একটা বলেছিল। শুধু জুয়েলের বাসায় সত্য জানানো হল। কিন্তু জামিলকে বের করি কিভাবে। আবার সৈই মিথ্যা। ওর মাকে বলা হল আমার বোনের বিয়ে। জামিল তিন দিন আমাদের বাসায় থাকবে । অনুমতি হল। অসম্ভব মজা হল কক্সবাজার এ। কেন জানি মিথ্যা বলে আমি কখনও পার পায়নি। এবার ও তাই হল। আমাদের সবগুলা ছবিই নষ্ট হয়ে গেল। এখনও কষ্ট হয়, হিমছড়ির সেই সৌন্দর্য এরপর আর কখনোই তখনকার মত দেখিনি।
আম্মু প্রায় বন্ধুদের বলত ওদের মাকে নিয়ে আসতে।কূটনৈতিক কারনে আমরা তা কখনও বাস্তবায়ন করিনি।
পরের ধরা খাওয়া জামিলের মায়ের হাতে।মাসখানেক পরে ওনি বললেন তোমার মাত একদম একা হয়ে গেছেন, তোমার আপা দূলাভাই কেমন আছেন।আমিত আকাশ থেকে পরলাম।আমার বোন পরে সেভেনে, দূলাভাই আসবে কোথা থেকে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত আন্টির সাথে আম্মুর দেখা হবার আর কোন চান্স নেই। তাদের দেখা হয় এর আট বছর পর জামিলের বিয়েতে।মিঠুরা কাছাকাছি থাকলেও ওর মায়ের সাথে দেখা হয় তখন।
ভার্সিটি ভর্তি হয়ে চলে গেলাম দূরে।কি খায় কিভাবে চলি তার এসব দুশ্চিনতার সমাধান দেয় সাধ্য কার। মোবাইলের কল্যানে তিনি পেয়ে গেলেন নতুন লংডিসটেন্স দায়িত্ব। ফোন করে ঘুম থেকে উঠানো। এরপরও সকাল আটটার ক্লাশে খুব কমই স্যাররা আমার দেখা পেয়েছেন। আম্মুর এই চলতি দায়িত্ব এখনও চলছে। তিন বছরের চাকরি জীবনে এগার দিন আমার দেশের বাইরে থাকা আর একমাস হজের জন্য আব্বু আম্মুর বাইরে থাকা বাদে প্রতিটা দিন তিনি আমাকে ফোন করে ঘুম থেকে তুলে অফিসে পাঠান। চাকরীর ভাইভা দিবার দিন ও আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতে হয়েছে।
খেয়ে যে যায় বলুক আমার বিশ্বাস আমি খুব ভাল রান্না করতে পারি। গরুর মাংস , মুরগী , খিচুড়ী সবই, শুধু ভাতটা একটু ভর্তা হয়ে যায় এই আরকি। এখানেও আমার শিক্ষক আম্মু, মাধ্যম মোবাইল।
রাত এগার থেকে বারটার মাঝে আমার মোবাইল বেশ কিছুক্ষন বিজি থাকবেই। গত তিন বছরের প্রতিটি দিনই। বন্ধুদের কসম খেয়ে বিশ্বাস করাতে হয় আমি আম্মুর সাথে কথা বলছিলাম। আত্মীয়স্বজন সবাই চিটাগং এ আর আমি ঢাকায়। সেখানে ঘটে যাওয়া পারিবারিক সব ঘটনার আপডেট পেয়ে যায় আমি।আম্মুর পাশে বসে আব্বু ছোট বোন আর ভাইটি হাসাহাসি করে এই বলে, যে শুরু হল আজকের সারাদিনের ধারাবিবরনী। তখনই তাদের ভাত খাবার কথা মনে পড়ে।শুরু হয় ভাত দেয়ার জন্য তাড়াহুড়ো। আর চিটাগং গেলে আমাদের ডিনারের ব্যপ্তি প্রায় দুঘন্টা।পাশের আন্টিরা বলে শামসীর আসলেই বুঝা যায় রাত একটা পর্যন্ত আপনাদের হৈচৈ শুনে।
বাবা মার প্রতি ভালবাসা প্রকাশে আমাদের বাঙ্গালী সমাজ বেশ নীরব।ভালবাসাটা বুঝতে না দেয়ার মাঝেই যেন ভালবাসার সার্থকতা। আর তাই বাবা মাকে নিয়ে রচিত সব গানেই হারানোর হাহাকার ফুটে আছে তীব্রভাবে। এটা বুঝেছিলাম জেমসের মা গানটি একবার চলার পর আব্বু যখন বলেছিলেন আবার চালাত গানটা।
বাবা মাকে নিয়ে উচ্ছসিত আবেগ ভালবাসা প্রকাশের কোন গানই নেই আমাদের। অফিসে বসে ওয়লকাম টিউনের মডিওল দেখতে গিয়ে ইচ্ছা হল আব্বু আম্মুর জন্য দুটা আলাদা আলাদা টিউন সেট করব। আজকের আমাকে প্রতি মুহুর্তে গাইড করে যিনি এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন তার জন্য কোন ওয়েল কাম টিউন ই পেলামনা।
দেশমাতার জন্য অনেক গানই আছে। অথচ আম্মু , যার জন্য আমার এই পৃথিবী পাওয়া তার জন্য কোন সুইটেবল গানই নেই। পরক্ষনেই ঘুমই আবার ত্রান কর্তা হিসেবে আর্বিভূত হল। ওয়েল কাম টিউন সেট করলাম :
জন্ম আমার ধন্য হল মাগো
এমন করে আকূল হয়ে আমায় তুমি ডাক ।।
আম্মুর কাছ থেকে এখনও জানা হয়ে উঠেনি গানটা বেজে উঠে কিনা।