মা হবার এই পরিক্রমায় মেয়েদেরকে এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয় । আলফীর সময় যেমন কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল এবারও তার কোন ব্যতিক্রম নেই । এই শারীরিক পরিবর্তনের সময়কালে অস্হির একটা সময় পার করতে হয় তাদের । বিশেষ করে ভাল ভাবে খাবার খেতে না পারা আর সমান্য খেলেও সেটা বমি হয়ে বের হয়ে যাওয়া একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় , প্রথম তিন মাস এটা খুবই সিভিয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায় । আলফীর সময় যেদিন তোর মা নিশ্চিত হল সেদিনই সকালে ফোন করে সে তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল । ব্যাপারটা ভাবলে এখনও আমার কেমন জানি লাগে । ক্যারিয়ার যেখানে মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, কোন কোন ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, সে বিষয়টাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে তার মামনি কোন ধরনের দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ না রেখে সোজা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল । যাতায়াতের সমস্যাটা এখানে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল যদিও ।
কি যে কঠিন ছিল সে সময়টুকু তা এখন কল্পনা করলেও কেমন জানি লাগে । বাসায় তোর মার দেখাশোনা করা কিংবা কাজে সাহায্য করারও কেউ ছিলনা । আমি অফিসে যাবার সময় থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত পুরো সময়টুকু তাকে একা থাকতে হত । একেত সে কোন কিছু খেতে পারছিলনা, তার উপর কোন মসলার ঘ্রানও সহ্য করতে পারতোনা । ফলে কোন মতে দিন পার করাও ছিল কঠিন একটা বিষয় । দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে আমি চেস্টা করতাম বাসায় এসে অন্তত তাকে একবার দেখে যেতে । আর এই সময় আমিও মোটামুটি ভালই রান্নাবান্না করে হাত পাকিয়ে ফেলেছিলাম ।
পরবর্তীতে তোর মাকে সাহায্য করার জন্য একজন গৃহকর্মী পাওয়া গিয়েছিল । তোর মামী , তাদের ড্রাইভার হান্নানকে বলে এই ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন । মাজেদা খালা সেই থেকে আমাদের বাসার নিয়মিত সদস্য । তখন তার আগমনের পর আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারতাম, অন্তত বাসায় একজন মানুষতো আছে । সবচেয়ে বড় বিষয় হল খালা আমাদেরকেও আপন করে নিয়েছেন । আলফী ওনাকে নানু ডাকে, ইনশা আল্লাহ তুই ও তাই ডাকবি । আলফীর সাথেত তার চমতকার বোঝাপড়া । ক্রিকেট ফুটবল ব্যাডমিন্টন, লেগো সেট- সব খেলার সাথী এই নানু , তোর জন্য সেও কিন্তু অপেক্ষা করে আছে । তার সাথে তোর ও ভাল সময় কাটবে আশা করি ।
আল্লাহর রহমতে এইবার বলা চলে তোর মার সাহস কিছুটা বেড়েছে, সে চাকরি ছাড়ার মত ডিসিশান না নিলেও যথেস্ট পরিমান সতর্ক হয়ে চলাফেরা করছে । যাতায়াতেরও এইবার অবশ্য তেমন সমস্যা নেই । যদিও খেতে না পারা আর সামান্য একটু খেলেই বমি হয়ে যাওয়া থেকে মুক্তির কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা । বাসায় বেসিনের পাশে একটা প্লাষ্টিকের উঁচু মোরা মোটামুটি ফিক্সড হয়ে গেছে । ব্যাপারটা লিখতে তেমন কোন কষ্ট না থাকলেও দেখাটা ভীষন কস্টকর যেকারো জন্য । মোটামুটি জান যায়যায় অবস্হা হয়ে যায় তার বমি করতে করতে ।মাঝে মাঝে আলফীও ভয় পেয়ে যায় তার এইসব লক্ষন দেখে । তারপরও সে সব মেনে নিয়েছে কেবলমাত্র তোর জন্য । তার মুখে একটাই কথা যত কষ্টই হউকনা কেন সন্তানের মুখটা দেখার সাথে সাথেই সব মা তার গর্ভকালীন সব কষ্টই ভুলে যান । আর আল্লাহ মা কে কেন সব কিছুর উপর স্হান দিয়েছেন তা কোন মায়ের এই সময়টা দেখলেই বুঝা যাবে ।
আমাদের জীবন মোটামুটি গন্ডীবদ্ধ হয়ে গেছে । হুঠাট ঘোরাঘুরি, বাইরে যাওয়া আপাতত বন্ধ । অফিস আর বাসা এই হচ্ছে নিয়মিত রুটিন । অবশ্য মাঝে মাঝে তোর ভাইয়ের আব্দার মেটানোর জন্য আমরা যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং মলে যায় । সেখানে সে একটা নান খাবার পাশাপশি হালকা খেলাধূলা করে । মজার বিষয় হচ্ছে মার্কেটে গেলে সে মোটামুটি পারলে তোর জন্য পুরো মার্কেটের সব কিছুই কিনে ফেলে । এক একটা জিনিস হাতে নিয়ে তার কথা হচ্ছে ছোট বেবীর জন্য এটা কিনে ফেল । যদিও তার সব আব্দার আমরা রাখছিনা, কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের মাঝে আরো বেশী ভাললাগা ছড়িয়ে দিচ্ছে । এমনিতেই আমরা চেস্টা করছি তাকে আস্তে আস্তে তোর জন্য প্রস্তুত করতে , আর সেটার প্রতিফলন দেখতে পেয়ে খুব ভালও লাগে । তোর প্রতি তার ভালবাসা তৈরি হচ্ছে, সে তোকে ফীল করা শুরু করেছে , একটি সুন্দর আগামীর জন্য এটাই সবচেয়ে জরুরি ।
তোর মা হচ্ছে মুরগী প্রেমী আর আমি মাছ । বাচ্চারা যাতে কেবল মুরগী না খেয়ে নানা রকম মাছও পছন্দ করে তাই আলফীর জন্মের আগে তোর মাকে মোটামুটি বাজারে সহজে পাওয়া যায় এমন সব মাছই খাওয়ানোর চেস্টা করেছিলাম । নদীর মাছ সাগরের মাছ, ছোট বড় সব ধরনের । ঠিক যতটুকু আশা করে তোর মা পছন্দ না হলেও খাওয়ার চেস্টা করেছে, খেয়েছে, সম পরিমান হতাশা উপহার দিয়েছে তোর ভাই । সেও যথারীতি মার মত মুরগী প্রেমি । এমনিতেই তাকে দেখলে সবাই বলে আমরা নাকি তাকে না খাইয়ে রেখেছি , দুইজনই জব করি, তাই হয়ত তার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়না । কেউ এমন বললে মনে মনে মেজাজটা এত খারাপ হয়ে যায় যে সে কথা বলে বোঝানোর মত না । আমি জানি ঠিক কি পরিমান কস্ট কিংবা পরিশ্রম তোর মাকে করতে হয় প্রতিদিন তাকে খাওয়ানোর জন্য । তাকে খাওয়াতে নিয়ে বসলে দুই ঘন্টার একটা সিনেমা অনায়াসে শেষ হয়ে যাবে ঐ সময়ে , তবুও তার খাওয়া শেষ হয়না । অনেকের ধারনা সে ডে কেয়ারে থাকে, তাই মনে হয় তার ঠিক মত যত্ন হচ্ছেনা । অথচ তারা দেখলে অবাক হয়ে যাবে আমার অফিসের ডে কেয়ারে কি পরিমান যত্নের সাথে বাচ্চাদের দেখাশোনা করা হয় । বাইরের কোন ডে কেয়ারে এত যত্ন সম্ভব নয় । বাসায় তাকে খাওয়ানোর সময় প্রায় দেখা যায় তার সাথে আমি ক্রিকেট খেলি, কিংবা তোর মা গল্পের বই পড়ে শোনায় । সবই ঠিক থাকে কেবল তার খাওয়াটা ছাড়া । এই খাওয়াও মুরগী কেন্দ্রীক । মুরগী থাকলে সে দুটা ভাত খাবে না হলে সে এক বিশাল যুদ্ধ । ইদানিং অবশ্য সে একটু একটু মাছ খাওয়ার চেস্টা করছে, নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাকে মাছ খাওয়ানো হচ্ছে ।
যেহেতু প্রচুর মাছ খাওয়ার পরেও আলফীর মাছের প্রতি কোন আকর্ষন নাই, তাই এবার তোর মা ও মাছ খাওয়ার প্রতি কোন আগ্রহই দেখাচ্ছেনা । এমনিতেই খাওয়ার রুচি কমে গেছে, সেখানে মাছের পরিমানতো আরো কম । তবে একদিন কোথা থেকে পড়ে এসেছে সাগরের মাছ খেলে সেটা বাচ্চার জন্য ভাল, তাই আমাকে বলেছে কিছু সাগরের মাছ নিয়ে আসার জন্য ।
খাওয়া দাওয়া নিয়ে তুই যে কি করবি আর সেটা যদি আলফীর মত একই রকম হয় - ব্যাপারটা ভাবতেই আমার টেনশন বেড়ে যাচ্ছে । একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি !!! খাওয়া নিয়ে তার সিনেমা শুরু হয়েছিল হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার দুইদিন পর থেকেই । হঠাত করে সে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল । লম্বা একটা সময় ধরে সে কিছুই খাচ্ছেনা । বাসায় তোর মা, দিদা দুজনেই মহা টেনশনে । তোর মাত কান্নাকাটি শুরে দিয়েছিল। কিছুসময় পর তোর নানী ও এসে হাজির । শেষে রাত নয়টার দিকে তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হল । ডাক্তার দেখে নানা রকম টেস্ট ধরিয়ে দিল । এতটুকুন একটা পিচ্চি, এমনিতেই ওজন কম, তার শরীর থেকে পরীক্ষার জন্য একগাদা রক্ত বের করে নিল । তার কান্না আর এই দৃশ্য দেখে আমিই কেঁদে ফেললাম ।
যাই হউক তাকে খাওয়াতে যে অবস্হা এখনও, তোরা দুজন যদি একসাথে একই রকম কান্ড অব্যাহত রাখিস, আল্লাই জানে কি অবস্হা দাঁড়াবে ।
তোকে নিয়ে নানা ভাবনায় আমাদের দিন কেটে যায় । আলফী ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারছেনা তুই কোথা কিভাবে আসবি । কতদিন অপেক্ষা করতে হবে , সেটা এত লম্বা সময় কেন, এইসব তার ভাল লাগছেনা । সে যখন একদিন খালার (বাসার গৃহকর্মী)কাছ থেকে জানল তুই তোর মার পেটে আছিস, এই ব্যাপরটাত সে কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলনা । তোর মাও যখন বলল যে হ্যাঁ ব্যাপারটা তাই, তারপর থেকে সে তোর সাথে যোগাযোগের একটা উপায় পেয়ে গেল । কিছুক্ষন ঘুরে টুরে এসে সে তোর মার পেটে কান দিয়ে শোনার চেস্টা করে কিছু শোনা যায় কিনা । কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সে কতক্ষন ডাকাডাকি করে, নিজে নিজেই বলতে থাকে- ছোট বেবী তুমি কি ভাইয়ার কথা শুনছ । তার এসব কর্মকান্ড দেখে আমাদের মনটা কি অসীম মমতায় ভরে উঠে সেটা আসলে বলে বোঝানো যাবেনা । তোর সাথে কথা বলা তার নিত্য দিনের রুটিন হয়ে উঠে । সব থেকে মজার ব্যাপার হল তোর আগমনের খবর খুব কাছের মানুষজন ছাড়া কেউ না জানলেও তার স্কুলের সব বন্ধুরা এবং বন্ধুর মা রা জেনে গেছে !!! তারা সবাই আলফীর কাছ থেকে জেনেছে আমাদের একটা ছোট বেবী আসছে । বাসায় আমরা বসাই তোকে যেভাবে ছোট বেবী ছোট বেবী বলে সম্বোধন করছি, শেষে না জানি এটাই তোর নিক নেম হয়ে যায় !
১ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৩০