কোরবান এর ঈদ আর আর সপ্তাহ দুই বাকি । বছরে দুটা ঈদ ই আমরা চট্টগ্রামে তোর দাদা-দিদার সাথে করি । এই সুযোগে সেখানে থাকা সব আত্মীয় স্বজন এর সাথে দেখা হয় । দারুন সময় কেটে যায় । কিন্তু এইবার ডাক্তার তোর মাকে জার্নি না করার জন্য বলেছে সাবধানতার কারনে । আমরা দুজন একটু চিন্তিত কি করব । তোর মা কোন ধরনের রিস্ক নিতে চাচ্ছেনা । আমিও চাচ্ছিনা কোন ধরনের জটিলতা তৈরি হউক । কিন্তু মানুষ এক ধরনের অভ্যাসের দাস । ভাল মন্দ যায় হউক সে একধরনের নিয়মের মাঝে চলতে পছন্দ করে । প্রতিবছরের এই নিয়ম কি করে ভাংব সেটা নিয়ে চিন্তা করছি । তোর দাদা-দিদাকে কিভাবে বলব সেটাই ভাবছি । আমরা যাবোনা শুনলে , বিশেষ করে আলফী ঈদের সময় তাদের কাছে থাকবেনা এমন কিছু হলে যে তাদের আসলে ঈদ ই হবেনা । আবার তোর দিদা যদি বলে তোমরা আস তাহলে সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করে আমি চেস্টা করব যেতে । মার কোন কথা রাখবোনা এমনটা আমি এখনও কল্পনা করতে পারিনা ।
সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির হল তোর দিদা । আমি অফিসে বসে ভাবছিলাম তাদেরকে ব্যাপারটা জানানো দরকার । এমন সময় তিনিই ফোন করে জানালেন তোর দাদা-দিদা ঠিক করেছে এবার ঈদে তারাই ঢাকা চলে আসবে , সাথে তোর ফুপী আর চাচ্চু । মনটা কি ভীষন আনন্দে ভরে উঠল আমার । আমি কিছু বলা লাগলোনা, তারাই তোর ভালর কথা চিন্তা করে ডিসিশান নিয়ে নিয়েছেন, কবে কিভাবে আসবেন তাও ঠিক করে ফেলেছেন ।
জীবনে এই প্রথম আমরা চিটাগং এর বাইরে ঈদ করলাম । তোর নানী, মামা-মামীদের সাথে এইবারই প্রথম ঠিক ঈদের দিন দেখা হল । তোর মার জন্য এই ঈদটা ছিল আসলেই অন্যরকম। অনেক বছর পর সে তার মা-ভাইয়াদের সাথে ঈদ করল । এক্ষেত্রে আমাকে কিছুটা স্বার্থপর ভাবতেই পারিস, আসলে সারা বছরতো ঢাকায়ই থাকি , তাই বছরে এই দুবার চিটাগং যাওয়ার সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইনা কখনো । কিছুটা কষ্ট থাকলেও জানি তোর মারও ব্যাপারটা খারাপ লাগেনা । সেখানে আমার নানী, মামা, খালা, মামীরা সবাই যে তোর মাকে ভীষন রকম পছন্দ করে। তাদের সাথে কয়েকটা দিন দারুন কেটে যায় । সেখানে তোর মার চার ফুফুও থাকে, এই সুযোগে তাদের সাথেও দেখা হয়ে যায় । তবে সব আনন্দের মাঝে একটা অপূর্ণতা ঠিকি ছিল, সেটা হচ্ছে ঈদে আমার নানীর সাথে দেখা না হওয়া । এইবারই প্রথম এমনটা হল,নানুর সাথে দেখা হলোনা, সেখানে খাওয়া দাওয়া করা হলোনা । তবুও তোর যাতে কোন সমস্যা না হয় তার জন্য এমনটা করা ছাড়া উপায়ই ছিলোনা ।
রোযার ঈদের পরে তোর মার আর চিটাগং যাওয়া হয়নি । ইনশা আল্লাহ তুই সহ আমরা চারজন একসাথে যাবো আগামীতে ।
মায়ের পেটে তোর বয়স প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেছে । ভালই নড়াচড়া শিখে গেছিস । সব চেয়ে মজার বিষয় হল যখনই তোর মা জানায় তুই নড়ছিস, তখনই আলফী তার সব কর্মকান্ড ফেলে দিয়ে তোর মার কাছে হাজির হয়ে যায় । বিপুল বিষ্ময় নিয়ে সে বুঝে উঠার চেস্টা করে কি করে এই পেটের মাঝে আমাদের ছোট বেবী আছে, কিভাবেইবা সে নড়াচড়া করছে । তার কত শত প্রশ্ন । একটা বাচ্চা নাকি দিনে চারশত সাঁইত্রিশ বার কেন কেন বলতে পারে । তার যখন দুই বছর বয়স তখন থেকে শুরু হয়েছে এই কেন কেন । তুই ও ইনশাআল্লাহ এর ব্যতিক্রম হবি বলে মনে হয়না । তার এইসব কেনর জবাব দেয়ার জন্য শেষে তোর বর্তমান অবস্হা কি তা দেখার জন্য আমরা ইউটিউব নিয়ে বসলাম । সেখানে মায়ের পেটে এই বয়সে একটা বাচ্চা কি অবস্হায় থাকে, কি করে সেসব দেখা হল । তোর ভাইয়ের তবুও বিষ্ময় কাটেনা, একদিন সেও এমন ছিল এটা সে কিছুতেই হজম করতে পারছেনা ।
ডাক্তার তোর মা কে আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলেছেন । যথাসময়ে আমরা হাজির হলাম । প্রথমে রিগুলার কাজ সেরে শেষে ডাক্তার আমাকে আর আলফীকে মনিটরের সামনে ডেকে নিল । তোর সাথে আমাদের প্রথম সাক্ষাত হয়ে গেল । ডাক্তার বলে বলে দেখাচ্ছেন, এইটা তোর মুখ, এই যে হাত, পা !!! আমরা বিষ্ময় নিয়ে দেখছি । আলফীকে দেখতে যেমন লাগছিল তোকেও তেমনই লাগছে । আলফীত ডাক্তারকে বলেই ফেলল, তোকে কবে তার হাতে দেয়া হবে, কখন তুই তার সাথে খেলতে পারবি । সেখান থেকে অফিসে ফিরে আসার পর খালি তোর ঐ মুখ খানাই চোখে লেগে আছে । মনিটরে দেখার পর থেকে যেন তোর উপস্হিতি আরো বেশী বাস্তব হয়ে উঠল । তুই আমাদের প্রতিদিনের অংশ হয়ে উঠলি আরো বেশী করে ।
অফিস থেকে ফিরে রাতে যখন বাসার কলিংবেলটা বাজায় তখনই আলফী তার খেলাধূলা বাদ দিয়া জোরে বাবা বলে ডাক দিয়ে দরজার কাছে ছুটে আসে । দরজার ওপার থেকেই সে নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকে কিংবা তার কর্মকান্ড বলতে থাকে । সে কি করেছে, কি এঁকেছে কিংবা মা কেন তাকে বকেছে । বাবা বলে ডাকটা শোনার যে কি অনুভূতি তা আসলে লিখে বোঝানো যাবেনা, এটার জন্যই আরো অনেক অনেক দিন বেঁচে থাকার সাধ জাগে মনে । সারাদিনের সব ক্লান্তি একেবারে উড়ে যায় । তোরা দুইজন একসাথে বাবা বলে দরজার কাছে ছুটে আসছিস, ভাবতেই কেমন জানি লাগছে । অবশ্য তুই যখন বাবা বলে ছুটে আসবি তখন আলফী আর এমনটা করবে কিনা কে জানে, সেত তখন আরেকটু বড় হয়ে যাবে । এই জন্য বাসায় সবসময় একটা ছোট বাচ্চা থাকাটা মনে হয় মন্দ হয়না !!!
আলফীকে নিয়ে আমরা ব্যাপক পরিমান এক্সপেরিমেন্ট করেছি , অনেকটা বলা যায় নিজেদের স্বার্থে । আমাদের যেহেতু ঘুরতে ভাল লাগে তাই তাকেও ঘুরাঘুরিতে অভ্যস্ত করে নেয়াটা জরুরী ছিল । ঠিক যেদিন তার দুমাস হল সেদিন দুপুরের ফ্লাইটে তাকে নিয়ে আমরা কক্সবাজার চলে গেলাম । এয়ার হোস্টেস তো এতটুকুন বাচ্চা দেখে বলে , আল্লাহ আপনার এই বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছেন , এয়ার প্রেশারেত ওর কস্ট হবে । আল্লাহর রহমতে ওর তেমন কোন কস্ট হয়নি, বিকালে তাকে সাগরের পাড়ে আরাম চৌকিতে শুইয়ে দেয়া হল সাগরের বাতাস গায়ে মাখার জন্য । সাত-আট মাস পার করার পর তাকে নিয়ে আমরা গেলাম শরীয়তপুর, তোর বড় মামীর গ্রামের বাড়িতে । সেখানে তাকে উঠানের মাটিতে ছেড়ে দেয়া হল মনের মত ঘুরে বেড়ানোর জন্য । মোটামুটি যতটা সম্ভব স্বাধীনতা পেয়ে সে নিজেকে মনের মত গড়িয়ে নিয়েছিল মাটিতে । এরপর নয় মাসের মাথায় সিলেটে - লালাখাল, জাফলং, মাধবকুন্ড, আমার ভার্সিটি - ঝড়ো বেগের একটা ট্যুর ও সে দিয়ে এসেছিল । এটার ফলাফল হয়েছে এখন ঘোরাঘুরির জন্য আমাদের চেয়ে তার আগ্রহ বেড়ে গেছে কয়েকগুন, কিছুদিন পরপরই সে বলে উঠে, আমরা অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যায়না, চল ঘুরে আসি । তোকেও ইনশাআল্লাহ ঘোরাঘুরির জন্য ফিট করে তুলতে হবে দ্রুত । ।
তোমার মার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই এই সুযোগে আমরা সব বন্ধুরা একটা ব্যাচেলর ট্যুর করে ফেললাম সাজেকে । এর আগে আলফীর সময় ও এমন একটা ট্যুর করেছিলাম হামহাম জলপ্রপাতে । এবারও আসলে একই অনুভূতি । সেবার তোর মাকে একা রেখে গিয়েছিলাম, এইবার সাথে আলফীও আছে । তাকেও একগাদা ভুল বিঝিয়ে, যে অফিসের কাজে আমি যাচ্ছি বলে বের হতে হয়েছে । বন্ধুদের সাথে অনেক মজার সময় কাটলেও ক্ষনে ক্ষনে আসলে তোদের তিনজনের কথায় মনে পড়েছে বারবার । এর কিছুদিন পর ছিল আমাদের স্কুলের রিইউনিয়ন । সেটাতে আমি যাব, আলফীকে জিজ্ঞাসা করলাম সে যাবে কিনা । আমাদের অবাক করে দিয়ে সে ঘোষনা করল সেও যাবে ।
সত্যি সত্যি সে একা একা, এই প্রথম তোর মাকে ছাড়া কোথাও যাচ্ছে, সেখানে সে রাত কাটাবে তাও তিন রাত পরপর । আমার অফিসের পরিকনিকে সে গিয়েছিল তা ছিল সারাদিনের । আমাদের অবাক করে দিয়ে সে রওয়ানা দিল আমার সাথে, এই তিনদিন তোর মামনী তোর নানীর কাছে থাকবে । ব্যাপক আনন্দ নিয়ে ট্রেন জার্নি শেষ করে সে দাদআ-দিদার কাছে গিয়ে পৌঁছাল । তাদের আনন্দ দেখে কে , খেলনা -কাপড়চোপড় কিনে রাখা থেকে শুরু করে আমাগামী তিনদিন তাকে নিয়ে তারা কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে তার বিশাল পরিকল্পনাও তাকে জানানো হল । প্রথমদিন কেবল ঘুমানোর সময় একটু কান্নাকাটি করলেও পরে ঘোরাঘুরির কারনে কান্নকাটির কোন সুযোগই পায়নি সে । তোর জন্যও জমা থাকল এমন একটা এ্যাডভেঞ্চার , হা হা হা !!!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:৩১